টাঙ্গাইলে সরিষার হলুদ রঙে ছেয়ে গেছে দিগন্ত

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

মু. জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
পৌষের বিন্দু বিন্দু শিশির ভেজা মাঠভরা সরিষা ফুলের মৌ মৌ সুঘ্রাণ ও সৌরভ চারদিকে। ভোরের কাঁচাসোনা রোদে ম্রিয়মাণ বাতাসে দিগন্তজোড়া হলুদাভ ঢেউ। গাঢ় হলুদ বর্ণের সরিষা ফুলে মৌমাছিরা গুন গুনিয়ে মধু আহরণ করছে। বিস্তীর্ণ এলাকার ক্ষেতগুলো দেখে বিছানো হলুদ গালিচা বলে ভ্রম হওয়া বিচিত্র্য নয়। ভোরের মিষ্টি সোনারোদে ঝলমল করা হলুদ সরিষা ফুলের অবারিত সৌন্দর্য এখন গ্রামে গ্রামে লুটাপুটি খাচ্ছে। টাঙ্গাইলের যে কোনো এলাকায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে সোনাঝরা ফুলের সীমাহীন বাগান। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ- দু'পাশে দিগন্ত হারানো হলুদের সমারোহ। গাঢ় হলুদে সোনালি রোদ মিলেমিশে এক অনিন্দ্য ঝলমল সৌন্দর্য অবগাহনে হাতছানি দিচ্ছে প্রকৃতি। মিষ্টি রং হলুদে হলুদে সজ্জিত সরিষার প্রতিটি ফুলে দুলছে কৃষকের রঙিন স্বপ্ন। কৃষকের স্বপ্ন প্রসারিত হয়েছে মৌমাছি দিয়ে মধু আহরণকারী মৌয়ালদের মাঝেও- স্বপ্ন বুনছে তারাও। সরিষার ব্যাপক ফলনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে দিচ্ছে সম্ভাবনার অমীয় হাতছানি। চলতি মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৮৪০ মে. টন সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। মৌসুমের শুরুতে নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ায় সরিষা আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঝুঁকি দেখা দেয়। কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের তৎপরতা ও পরামর্শে কৃষকরা সরিষা চাষে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস পায়। ফলে ইতোমধ্যে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা চার হাজার ৭০০ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জেলার ১২টি উপজেলায় সরিষার আবাদ বাড়ানোর লক্ষ্যে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাঁচ সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। সার্চ কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন- জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার, অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য), অতিরিক্ত পরিচালক (উদ্যান) এবং স্ব স্ব উপজেলা কৃষি অফিসার ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার। সূত্রমতে, গত দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় কৃষকরা অধিকাংশ জমিতে আমন ধান চাষ করতে পারেনি- সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, গত বছর সরিষার বাজারমূল্য আশানুরূপ হওয়া, কৃষি প্রণোদনার আওতায় জেলার ২৪ হাজার কৃষককে বিনামূল্যে এক কেজি বীজ ও সার প্রদান এবং সার্চ কমিটির তৎপরতার কারণে কৃষকরা বেশি জমিতে সরিষা আবাদ করায় লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১২টি উপজেলায় মোট ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৮৪০ মে. টন সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় পাঁচ হাজার ২৯০ হেক্টরে ছয় হাজার ৩৪৮ মে. টন, বাসাইলে চার হাজার ৮২০ জেক্টরে পাঁচ হাজার ৭৮৪ মে. টন, কালিহাতীতে তিন হাজার ১৩০ হেক্টরে তিন হাজার ৭৫৬ মে. টন, ঘাটাইলে দুই হাজার ৩৫৫ হেক্টরে দুই হাজার ৮২৬ মে. টন, নাগরপুরে ১০ হাজার ১০০ হেক্টরে ১২ হাজার ১২০ মে. টন, মির্জাপুরে ৮ হাজার ৯৫০ হেক্টরে ১০ হাজার ৭৪০ মে. টন, মধুপুরে ৪৬৫ হেক্টরে ৫৫৮ মে. টন, ভূঞাপুরে এক হাজার ৮৩০ হেক্টরে দুই হাজার ১৯৬ মে. টন, গোপালপুরে তিন হাজার ৬০০ হেক্টরে চার হাজার ৩২০ মে. টন, সখীপুরে দুই হাজার ১৪০ হেক্টরে দুই হাজার ৫৬৮ মে. টন, দেলদুয়ারে দুই হাজার ৫৫০ হেক্টরে তিন হাজার ৬০ মে. টন, ধনবাড়ী উপজেলায় ৪৭০ হেক্টরে ৫৬৪ মে. টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্চ কমিটির তৎপরতা ও প্রণোদনার ফলে হাল জরিপে চার হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেড়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৯৩৫ হেক্টর, বাসাইলে ৫৭৫ হেক্টর, কালিহাতীতে ৪৭০ হেক্টর, ঘাটাইলে ৬৩৫ হেক্টর, নাগরপুরে ৮০ হেক্টর, মির্জাপুরে এক হাজার ২৩৫ হেক্টর, মধুপুরে ১৩৫ হেক্টর, ভূঞাপুরে ৩০০ হেক্টর, গোপালপুরে ৩৫০ হেক্টর, সখীপুরে ৩৮ হেক্টর, দেলদুয়ারে ২৩৫ হেক্টর এবং ধনবাড়ী উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেশি হয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের বারি-১৪ ও বারি-১৫ এবং স্থানীয় জাতের (পেচি/টরি-৭) সরিষা জেলায় বেশি আবাদ হয়ে থাকে। এছাড়া বারি-৯, বিনা-৯/১০, সরিষা-১৫, সোনালী সরিষা (এসএস-৭৫) জাতের সরিষাও আবাদ হয়। কৃষকরা জানায়, সরিষা চাষে প্রতি বিঘা জমিতে ব্যয় হয় ৪-৫ হাজার টাকা। ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘা জমিতে ১০-১২ হাজার টাকা লাভ করা যায়। সরিষা ক্ষেতে 'জাত' পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এঁটেল মাটিতেও সরিষা চাষ হয়। এঁটেল-দোআঁশ মাটিতে সরিষার চাষ সব চেয়ে ভালো হয়। জেলার মধ্যে নাগরপুর উপজেলার জমিতে এঁটেল- দোআঁশ মাটি বেশি হওয়ায় ফলনও অনেক ভালো হয়। কৃষকরা আরও জানায়, সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি ও প্রজাপতির আনাগোনা বেশি হলে সহজে পরাগায়ণ হয়। এতে ফলন অনেকাংশে ভালো হয়। ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘা জমিতে ৫-৬ মণ সরিষা পাওয়া যায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সরিষার বাম্পার ফলনের মাধ্যমে দিন বদলের স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। উচ্চফলনশীল বারি-১৪ ও বারি-১৫ জাতের সরিষার চাষ করায় কৃষকের স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ। জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের দিগন্তজোড়া হলুদরাঙা সরিষার রাজ্যে দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নাটোর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, পাবনা, নড়াইল ও সুন্দরবন এলাকা থেকে মৌয়াল বা মৌচাষিরা সারি সারি মৌবাক্স বসিয়ে সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে। এখান থেকে মধু সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ মধু সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ক্ষেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করলে সরিষায় পরাগায়ণের ফলে আবাদ শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ফলন বেশি হয়।সরজমিনে দেখা যায়, ক্ষেতের পাশে সারি সারি মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে কাজে ব্যস্ত মৌয়াল বা মৌচাষিরা। নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরিষা ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেখান থেকে মধু বিক্রিও করা হচ্ছে। প্রতি কেজি মধু বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে। মধু সংগ্রহকারী ময়মনসিংহের খোরশেদ আলম, আব্দুল করিম, সাতক্ষীরার কামরুল হাসান, রহমত আলী, ফরিদপুরের হায়দার মিয়া, বাদশা মিয়া, ইন্তাজ আলী, শরীয়তপুরের মো. বাবলু মিয়া, আজমত আলী, খায়রুল ইসলামসহ অনেকেই জানান, তারা ৬-৮ বছর যাবত মৌবাক্সের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করছেন। তাদের কারও কারও নানা নামে মৌ খামার রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে প্রতি বাক্সে চার থেকে সাড়ে চার কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। খুচরা ও পাইকারি দরে মধু বিক্রি করা হয়। তাদের প্রত্যেকের ৫০ থেকে ২০০টি মৌবাক্স রয়েছে। তারা জানান, এবার সরিষার ফলন ভালো হওয়ায় টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকায় মধু আহরণও আশানুরূপ হচ্ছে। তাদের দাবি, মৌচাষের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও সংরক্ষণের জন্য মৌচাষের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং মৌচাষিদের সহজে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হলে মধু সংগ্রহ আরও ব্যাপক আকারে করা যাবে। সেই সঙ্গে সরিষার আবাদও অনেক বেড়ে যাবে।