কৃষির উন্নয়নে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার

প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম
গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ অনুমোদিত হয়। জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-তে সবচেয়ে চমকপ্রদ সংযোজন হচ্ছে, কৃষি উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তির সংযোজন। কৃষি উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো হিসেবে (১) ফসলের রোগ নিণর্য়, জাতভিত্তিক পুষ্টিচাহিদা নিণর্য়, পুষ্টি আহরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি; (২) ন্যানো-সেন্সর প্রযুুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভ‚মির গুণাগুণ পযের্বক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কাযর্ক্রম গ্রহণ; এবং (৩) কৃষিতে ও কৃষি পরিবেশে ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্তকরণ এবং শোধনসহ ন্যানোপ্রযুক্তির সার, বালাইনাশক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে উপকরণ দক্ষতা অজের্নর উদ্যোগ গ্রহণ। কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ন্যানোপ্রযুক্তি একটি কাযর্কর ও সম্ভাবনাময় কৌশল হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। ন্যানোকণার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে উদ্ভিদ পুষ্টি উন্নয়ন, সার ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, ফসলে উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ নিণর্য়, বালাই দমন, খাদ্য মোড়কীকরণ, অজৈব অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং নিখঁুত (প্রিসিশন) কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, নতুন ন্যানোকণা কাযর্করভাবে শস্য সংরক্ষণের জন্য বালাইনাশকের কাযর্কারিতা এবং নিরাপদ ব্যবহারে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। অনুরূপভাবে, ন্যানোসার ¯েøা রিলিজ বা ধীরে ধীরে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হওয়া ও ধীর অবক্ষয়ের মাধ্যমে কাযর্করভাবে সার ব্যবহারের দক্ষতার প্রভ‚ত উন্নয়ন করতে পারে। ন্যানোকণার ব্যবহার অথবা ন্যানো বাহকের ভিতরে সারের উপাদান ব্যবহার শস্যের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরে। টেকসই উদ্ভিদ পুষ্টি এবং ফসল উৎপাদনের জন্য ন্যানো উপাদানের দক্ষতা আজ প্রমাণিত। সম্প্রতি, ব্যাকটেরিয়াল ও ছত্রাকজনিত সংক্রামক রোগ দমনে জীবাণু প্রতিরোধী দিনের আলোতে রিচাজের্বল ন্যানোতন্তু ঝিল্লিগুলো আলোতে কাযর্কর রাসায়নিক যৌগগুলো একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে। এসব ন্যানোপদাথর্ দিনের আলোতে দক্ষতার সঙ্গে ক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতি (জবধপঃরাব ড়ীুমবহ ংঢ়বপরবং, জঙঝ) উৎপন্ন করে রোগজীবাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে। জীবাণু প্রতিরোধী ন্যানো সূযাের্লাকে চাজের্বল ন্যানো উপাদান তৈরির এ চমকপ্রদ কৌশল টেকসই কৃষিব্যবস্থায় বালাই দমনে কাযর্করভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। ন্যানোপ্রযুক্তির ডিভাইস ও যন্ত্রপাতি যেমনÑ ন্যানো ক্যাপসুল, ন্যানোকণা, ন্যানো রোবট, এমনকি ভাইরাস ন্যানো ক্যাপসিড সুনিদির্ষ্টভাবে রোগ নিণর্য় ও চিকৎসায়, উদ্ভিদ পুষ্টি গ্রহণ তরান্বিতকরণ, সুনিদির্ষ্ট স্থানে কাযর্কর উপাদান ডেলিভারি এবং পানি শোধন প্রক্রিয়ার উন্নয়নে ব্যবহার করা সম্ভব। উদ্ভিদ প্রজনন এবং জেনোমিক রূপান্তরেও ন্যানোকণার ব্যবহার হয়ে থাকে। কৃষি উন্নয়ন তরান্বিত করতে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহারের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। তা সত্তে¡ও ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সমাধানের জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন। যেমন: অধিকাংশ ন্যানোকণার বাণিজ্যিক উৎপাদন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল কৃষিতে ন্যানোকণা বাণিজ্যিকীকরণের আগে এর সম্ভাব্য ক্ষতিকারক দিকগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ন্যানোপ্রযুক্তি যেসব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গবেষণা এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার করা প্রয়োজন, সেগুলো হলোÑ উদ্ভিদপুষ্টি, শস্য সংরক্ষণ, রোগবিস্তারসংক্রান্ত বিষয় ও আবহাওয়ার পূবার্ভাস, রোগ নিণর্য়, জীবপ্রযুক্তি, প্রাণী স্বাস্থ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পণ্য প্যাকেটজাতকরণ, পানি ব্যবহার দক্ষতা উন্নয়ন এবং নিখঁুত (প্রিসিশন) কৃষি কাযর্ক্রম। ন্যানোকণা ব্যবহারে আরও যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা হলোÑ (১) কিছু ন্যানোকণার পেটেন্ট রয়েছে, যার জন্য অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। (২) কৃষিতে ন্যানোকণা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইন ও নীতির অপ্রতুলতা রয়েছে। (৩) উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ন্যানোকণার গবেষণায় সামথের্্যর (মানবসম্পদ ও স্থাপনা) সীমাবদ্ধতা রয়েছে। (৪) ন্যানো বিষাক্ততা- কিছু ন্যানোকণা জিন বিবতর্ন (মিউটেশন) করতে সক্ষম, ডিএনএ ধ্বংস করে এবং ন্যানো নন-টাগেের্টড জীবের প্রতি বিষাক্ততা তৈরি করতে পারে। সেজন্য, কৃষিতে নতুন ন্যানোকণা সূচনার আগে এর যথাযথ নিরাপদ ব্যবহারের ওপর গবেষণার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পের (ইন্ডাস্ট্রির) সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পাটর্নারশিপ খুবই দুবর্ল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৌলিক জ্ঞান সৃজনের লক্ষ্য নিধার্রণ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে আবিষ্কৃত নতুন জ্ঞানের বাণিজ্যিকীকরণে রোডম্যাপ তৈরি আশু প্রয়োজন। জাতীয় অভীষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে জ্ঞান, দক্ষতা ও সামথের্্যর সমন্বিত এবং সবোর্চ্চ ব্যবহারে কৃষির বতর্মান ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ন্যানোপ্রযুক্তির দক্ষ প্রয়োগে উৎপাদনব্যবস্থাকে টেকসই করা সম্ভব। বতর্মান বাংলাদেশ সরকার আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবান্ধব। কৃষিতে ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহারের অন্তভুির্ক্তজাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ যে যথেষ্ট ভবিষ্যৎমুখী, তা প্রমাণ করে। যদিও বতর্মানে বাণিজ্যিকভাবে ন্যানোপ্রযুক্তি কৃষকের মাঠপযাের্য় এখনো তেমন একটা শুরু হয়নি। কিন্তু শিগগিরই কৃষিতে নানারকম ন্যানোপ্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু হবে, তা আশা করা যায়। বাংলাদেশে কৃষিতে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহ হচ্ছে, রোগ নিণর্য়, রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা ন্যানোপেস্টিসাইড, ন্যানোফাটির্লাইজার, ন্যানোহাবির্সাইড, অগ্রাধিকারভিত্তিক, ফুড প্যাকেজিং, ওষুধ ডেলিভারি, মৃত্তিকা দূষণ নিণর্য় ও দূরীকরণ, ফসল উন্নয়ন (জাত), উদ্ভিদে জলবায়ু পরিবতের্নর অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি, ন্যানোসেন্সর, সেচের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ এবং নিখঁুত (প্রিসিশন) কৃষি। কৃষিতে ন্যানোপ্রযুক্তি অনেক সম্ভাবনাময়, তবে বতর্মান বাংলাদেশের কৃষি বিদ্যালয়গুলো ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় ন্যানো-প্রযুক্তি খুব একটা অন্তভুর্ক্ত নয়। ন্যানোপ্রযুক্তি আন্তঃবিভাগীয় (ইন্টারডিসিপ্লিনারি) এবং সফল ন্যানো-প্রযুক্তি উদ্ভাবনে রসায়নবিদ, পদাথির্বদ, বস্তু বিজ্ঞানী, কৃষি বিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানীদের যৌথ ও সমন্বিত গবেষণা প্রয়োজন। অন্যথায়, এটি শুধু কাগুজে নীতি হিসেবে থেকে যাবে। এ দেশে ইতোমধ্যে কৃষিতে ন্যানোটেকবিষয়ক কিছু গবেষণা সাফল্যের নজির রয়েছে। সম্প্রতি, বুয়েট ও বশেমুরকৃবির যৌথ গবেষণায় ন্যানোপ্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুলভাবে ব্যবহৃত সেলুলোজ দ্বারা তৈরি কাগজে জীবাণুরোধী গুণাবলি আরোপ করার কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ উদ্ভাবন আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির বিখ্যাত জানার্ল ‘এসিএস সাসটেইনেবল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ প্রকাশিত হয়েছে। জীবাণুরোধী সিলভার ন্যানোকণা কাগজের ওপর সংযোজনের জন্য বিজ্ঞানীরা সামুদ্রিক শামুক ও ঝিনুকের মধ্যে বিদ্যমান পলিডোপামিন নামক বিশেষ প্রাকৃতিক যৌগের বৈশিষ্ট্য ধার করে। পলিডোপামিনের উপস্থিতির কারণে সমুদ্রের প্রবল ঢেউ উপেক্ষা করেও পাথর ও সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে শামুক ও ঝিনুক নিজেদের শক্তভাবে আটকে রাখতে পারে। উদ্ভাবিত ন্যানোসিলভার কণা সংযোজিত কাগজ তাই কৃষিতে গুরুত্বপূণর্ নানারকম ব্যাকটেরিয়া ও ক্ষতিকারক ছত্রাক দমনে খুবই কাযর্কর হতে পারে। কৃষিতে ন্যানোপ্রযুক্তির সফল প্রয়োগের লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিক কিছু কমর্সূচি গ্রহণ প্রয়োজন। এগুলো হলোÑ (১) জীবপ্রযুক্তির মতো দেশে ন্যানোপ্রযুক্তিবিষয়ক একটি টাস্কফোসর্ গঠন করা। (২) দেশে ন্যানোপ্রযুক্তি বিষয়ে একটি সম্মেলন আয়োজন করা। এটা জাতীয়ভাবে ন্যানোপ্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞ এবং কৃষি গবেষণায় অবদান রাখতে সক্ষম বিজ্ঞানীদের সামথর্্য জানা যাবে। (৩) ন্যানোপ্রযুক্তি বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ এবং কেন্দ্রিয়ভাবে ভৌত সুবিধাদি প্রতিষ্ঠাকরণ। এ ক্ষেত্রে শ্রীলংকার ঝখওঘঞঊঈ নামক ন্যানোপ্রযুুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সফলতার অভিজ্ঞতার অনুসরণ করা যেতে পারে। (৪) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রমে ন্যানোপ্রযুক্তিরবিষয়ক কোসর্ ও বিষয়বস্তু অন্তভুর্ক্তকরণ। (৫) তরুণ গবেষকদের ন্যানোপ্রযুক্তিরবিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন। (৬) জাতীয় ও আন্তজির্তকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের নিয়ে ইন্টারডিসিপ্লিনারি গবেষক দল গঠন করে টাগের্ট ওরিয়েন্টেড গবেষণার জন্য গবেষণা বরাদ্দ প্রদান। (৭) সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে গবেষণার ফলাফলগুলো দ্রæত ব্যবহার উপযোগী শিল্প উপাদানে রূপান্তরেব্যবস্থা গ্রহণ, এবং (৮) ন্যানোপ্রযুক্তিবিষয়ক একটি জাতীয় পেশাজীবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা। উপসংহার বলা যায়, নতুন ন্যানোকণা যেমনÑ ন্যানো সার, ন্যানো বালাইনাশক, ন্যানোবাহক, ন্যানো সেন্সর, ন্যানোমোড়কীকরণ এবং ন্যানোচিপ শস্যের স্মাটর্ পুষ্টি, বৃদ্ধির উন্নয়ন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বৈপ্লবিক পরিবতর্ন আনতে সক্ষম। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতভাবে নিখুঁত ও স্মাটর্ কৃষির প্রসার ঘটিয়ে ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাস এবং শস্য সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমাবে। তাই, ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও টেকসই কৃষিব্যবস্থা প্রবতর্ন করতে নতুন ন্যানোকণা উদ্ভাবন, কৃষি ক্ষেত্রে তাদের নিরাপদ ব্যবহারের জন্য চাহিদামাফিক রূপকল্পনিভর্র আন্তঃবিভাগীয় কোলাবোরেটিভ গবেষণা জোরদার করার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। লেখক : অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বণর্পদক বিজয়ী কৃষি বিজ্ঞানী।