আম সংরক্ষণের ঘরোয়া উপায়

আমের মৌসুম প্রায় শেষ হতে চলেছে। ভোক্তারা যদি মৌসুম শেষ হওয়ার পরেও বছরের অন্য সময়ে আমের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেতে চান তাহলে জানতে হবে কয়েকটি সহজ সংরক্ষণ পদ্ধতি। তাহলে মৌসুম শেষেও নিজেদের চাহিদা সহজেই নিজেরা মেটাতে পারবেন। আম দীঘির্দন সংরক্ষণ করে রাখা কিংবা মৌসুমের পরেও আম দীঘির্দন সংরক্ষণ করে খাওয়ার বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে।

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম স্বাদে, গন্ধে, পুষ্টিমানে ও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সব ফলের মধ্যে আম সবার ওপরে বলেই আমাকে ফলের রাজা বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই আমের উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে দেশের উত্তর, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া উন্নতমানের আম উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। আম একটি মৌসুমী ফল হওয়ায় মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়েও ইদানীং দেশের বাইরে বেশকিছু পরিমাণে আম রপ্তানি হচ্ছে। যা আমচাষিদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটি খবর। অন্যদিকে, ভোক্তারা যদি মৌসুম শেষ হওয়ার পরেও বছরের অন্য সময়ে আমের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করতে পারেন তাহলে নিজেদের রসনা সহজে নিজেরাই মেটাতে পারবেন। মৌসুমে আম দীঘির্দন সংরক্ষণ করে রাখা কিংবা মৌসুমের পরেও আম দীঘির্দন সংরক্ষণ করে খাওয়ার বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। যেসব পদ্ধতিতে আম সংরক্ষণের জন্য খুব বেশি জ্ঞানের বা দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। আম নষ্ট হওয়ার অন্যতম দুটি কারণ হলো, আমের অভ্যন্তরীণ পরিবতর্ন এবং অন্যটি, আমে অনুজীবের সংক্রমণ। আম ক্লাইমেকট্রিকজাতীয় ফল হওয়ায় আমের ভেতরে প্রতিনিয়ত জৈব রাসায়নিক পরিবতর্ন ঘটতে থাকে। এতে গাছে মুকুল থেকে একটি আম উৎপন্ন হওয়ার পর স্বাভাবিক নিয়মে একটি নিদির্ষ্ট সময় অতিক্রম করে ও এর অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবতর্ন হতে থাকে। এর ফলে আম আসে পুষ্টতা ও পরিপক্বতা এবং অবশেষে সেটি পাকতে শুরু করে। এজন্য দেখা যায়, একটি আম কঁাচা অবস্থায় সংরক্ষণ করতে গেলেও সেটি দ্রæতই পেকে যায়। অন্য কারণটি হলোÑ আম সংগ্রহের পর যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আমে অনুজীবের সংক্রমণ হতে পারে। আম সংগ্রহের সময় যদি আমে আঘাত লাগে বা থেঁতলে যায় এবং বাইরের খোসায় বা ছাল ফেটে যায় তাহলে ওই স্থান দিয়ে আমের ভেতরে অনুজীবের সংক্রমণ ঘটে। অনুজীবের সংক্রমণে আমের কোষগুলো দ্রæত নষ্ট হয়ে যায় ও আম পচে যায়। বতর্মানে আম সংরক্ষণের একটি সহজ পদ্ধতি হলো, গরম পানিতে আম শোধন করে সংরক্ষণ করা। মৌসুমে পুষ্ট কঁাচা আম সংগ্রহ করে ৫৫ থেকে ৫৭ ডিগ্রি সেলিসিয়াস পরিষ্কার গরম পানিতে ৫-৭ মিনিটকাল মিনিট ডুবিয়ে রেখে পরে শুকিয়ে নিয়ে ঘরের শুকনো ও ঠাÐা স্থানে রেখে দিলে আম সাধারণ অবস্থার চেয়ে অতিরিক্ত ১০ থেকে ১৪ দিন বেশি রাখা সম্ভব হয়। অথার্ৎ গাছ থেকে সংগ্রহ করা যেসব পুষ্ট আম ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় সপ্তাহখানেক সংরক্ষণ করা যায়, সেসব আমই গরম পানিতে শোধন করে রাখলে আরও সপ্তাহ দুয়েক বেশি সময় ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায়ই সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। এজন্য দুই লিটার ফুটন্ত পানির সাথে আরও দুই লিটার সাধারণ তাপমাত্রার পানি মিশালে পানির তাপমাত্রা ৫৫ থেকে ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। ওই তাপমাত্রার গরম পানিতে পুষ্ট ও পরিষ্কার আম ৫-৭ মিনিট সময় ডুবিয়ে রাখতে হয়। এসময় আমগুলো মাঝেমধ্যে উল্টেপাল্টে দিতে হয়। এরপর আমগুলো পানি থেকে তুলে বাতাসে শুকিয়ে নিয়ে ও ছায়ায় রেখে সংরক্ষণ করতে হয়। গরম পানিতে শোধন করা আম ফ্রিজের নরমাল চেম্বারের সাধারণ তাপমাত্রায় রাখলে দুই সপ্তাহেরও বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়। বাড়িতে রেখে খাওয়া কিংবা দূরে কোথাও আম পাঠাতে হলে গরম পানি পদ্ধতিতে আম শোধন করে সংরক্ষণ করলে বা পাঠালে তা ভালো থাকে। এতে আমের গুণাগুণ নষ্ট হয় না, শুধু আমের ভেতরের চলমান রাসায়নিক বিক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়া হয়, দীঘির্দন সতেজ রাখার জন্য। এখানে বলে রাখা ভালো, গরম পানিতে শোধন করা আম অবশ্যই পুষ্ট হতে হয়। এ আমের রংও দেখতে উজ্জ্বল হয়। অনেকেরই ধারণা যে, আমে ফরমালিন ব্যবহার করে আম দীঘির্দন সংরক্ষণ করা হয়। ধারণাটি ভুল। আমে যেহেতু স্বল্প পরিমাণে ফরমালডিহাইডজাতীয় রাসায়নিক পদাথর্ তৈরি হয়, যা পরে ফরমালিনে পরিণত হয় তাই আমে ফরমালিন প্রাকৃতিকভাবেই থাকে, কৃত্রিমভাবে ফরমালিন দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে কেউ কেউ আম পাকানো বা আমের সবুজ রং হলুদ করতে ইথোফেন বা কাবার্ইড ব্যবহার করে থাকেন। ইথোফেন উদ্বায়ী এবং এটি ফলের খোসার রং পরিবতর্ন করলেও ফলের ভেতরে প্রবেশ করে না এবং এর অবশেষ ফলে থাকে না। আর কাবার্ইড দিয়ে ফল পাকানো হলে এটিও খোসার রং পরিবতর্ন করে। কাবার্ইড ফলের আদ্রর্তার সংস্পশের্ এলে এসিটিলিন গ্যাস নিগর্ত করে, যা ফলের রসের সঙ্গে মিশে ইথাইলনে রূপান্তরিত হয়। এসময় প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। এ তাপেই ফলের খোসার রং পরিবতর্ন হয় ও ফলের ভেতরের স্বাভাবিক রাসায়নিক কাযর্ক্রম ব্যাহত হয় বা ধীরগতির হয়। এসব আম যদি অপুষ্ট হয় তাহলে কয়েকদিনের মধ্যেই পচে যায়। পুষ্ট হলে পচন শুরুর সময় কিছুটা দীঘর্ হয়। গাছ থেকে আম পাড়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হয়, আম যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয় এবং বেঁাটার কস বা আঠা যেন কোনো অবস্থাতেই আমের গায়ে না লাগে। কারণ বাতাসে ভেসে থাকা বা বাতাসে উড়ে আসা রোগজীবাণুুর স্পোর কস বা আঠার মধ্যে আটকে গিয়ে দ্রæত বৃদ্ধি লাভ করে। এতে আমে পচন ধরতে পারে। এজন্য গাছ থেকে আম পাড়ার পর বাছাই করে আঘাতপ্রাপ্ত ফাটা আম বাদ দিয়ে বাকিগুলো পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে নিলে বা গরম পানিতে শোধন করে নিলে আমের পচন যেমন রোধ করা যায়, তেমনি কয়েকদিন বেশি সময় সংরক্ষণের সুবিধাও পাওয়া যায়। গাছ থেকে পাড়া পুষ্ট ও পরিপক্ব আম পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে ও বাতাসে শুকিয়ে নিয়ে এবং পলিব্যাগে ভরে ফ্রিজের সাধারণ তাপমাত্রায় তিন থেকে চার সপ্তাহ পযর্ন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে আম নিবার্চনে একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয়, আমের বেঁাটার কাছে যেন কিছুটা হালকা হলদে রঙের আভাস দেখা যায়। অথার্ৎ যে আমগুলো ৫-৭ দিনের মধ্যেই পাকতে পারে সে সব আমই রাখতে হয়। সম্পূণর্ সবুজ আম রাখলে এবং পরে বের করলে ওইসব আম আর পাকে না। বাইরেটা যেমন সবুজ থাকে ভেতরটাও তেমনি সাদাটে থাকে। বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত করেও আম সংরক্ষণ করা যায়। প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতিতে আমের আকার, আকৃতি, প্রকৃতি ও পারিপাশ্বির্ক অবস্থার পরিবতর্ন ঘটিয়ে ভৌত পদ্ধতিতে বা রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সংরক্ষণ করা হয়। যেমন- কাটা আমের টুকরা চিনির সিরায় সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া, আমের আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি, জুস, স্কোয়াশ, মোরব্বা, আমসত্ত¡, আমচুর ইত্যাদি আকষর্ণীয় স্বাদ, গন্ধযুক্ত খাদ্য তৈরি করা যায়। অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রা ও আদ্রর্তায় বিশেষায়িত হিমঘরে বা কোল্ড স্টোরে আম সংরক্ষণ করা যেতে পারে চার থেকে সাত সপ্তাহের জন্য। এ জন্য হিমঘরের তাপমাত্রা ৭ থেকে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আপেক্ষিক আদ্রর্তা ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ রাখতে হয়। এ ছাড়া বিশেষ উপায়ে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে ও কাবর্ন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। ভাতে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৪২-৪৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা ও ৮৫-৯০ % আপেক্ষিক আদ্রর্তায় পুষ্ট আম সাত সপ্তাহ পযর্ন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে বিভিন্ন জাতের আমের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ তাপমাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। অনেক জাতেই কম তাপমাত্রায় ক্ষত হতে দেখা যায়। বিশেষ করে পাতলা খোসার বা ছালের আমে। এভাবে আম রেখে বাজারজাত করে খুব বেশি লাভ করা যায় না বলে, এখনো আমের জন্য বিশেষায়িত হিমঘরের প্রচলন দেখা যায় না। লেখক : উদ্যান বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর অঞ্চল, রংপুর।