শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
বিপন্ন ও বিলুপ্ত প্রায় ৩১ প্রজাতির দেশি মাছ ফিরে এসেছে

ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ

বিএফআরআইয়ের প্রচেষ্টায় ফিরে আসছে বিপন্ন দেশি প্রজাতির মাছের সুদিন। বিএফআরআইয়ের উদ্ভাবিত প্রজনন কৌশলের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্যশিল্প এখন জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখছে। এ খাতে অবদান ৩.৬১ শতাংশ। দেশি মাছের পোনা উৎপাদনে বর্তমানে চার শতাধিক হ্যাচারি কাজ করে যাচ্ছে। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর, কৈ ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে
ইমরান সিদ্দিকী
  ১৫ মে ২০২২, ০০:০০

মাছে ভাতে বাঙালির পরিচয় আবার ফিরে আসছে। হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ গবেষণার মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য এখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্বীকৃত। মৎস্য খাত বাংলাদেশে একটি স্বর্ণালি অধ্যায় সৃষ্টি করছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। এছাড়া বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ। পাশাপাশি গত পাঁচ বছরে অভ্যন্তরীণ এসব তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, মৎস্য উৎপাদনে শীর্ষে থাকা চীনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে দ্বিতীয় অবস্থানে তুলে এনেছে।

কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় ৩১টি দেশি প্রজাতির মাছকে ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। বিবিএসের সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, দেশে বছরে গড়ে মাছের বার্ষিক উৎপাদন সাড়ে ৩৫ লাখ টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ টন। বিপন্ন মিঠা পানির ৫৪ প্রজাতির মধ্যে গবেষণা ও বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে প্রত্যন্ত ৪০ প্রজাতির মাছকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বাকিগুলোও ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞ ডক্টর আব্দুল ওয়াহাব মিয়া বলেন, বিএফআরআইয়ের প্রচেষ্টায় ফিরে আসছে বিপন্ন দেশি প্রজাতির মাছের সুদিন। বিএফআরআইয়ের উদ্ভাবিত প্রজনন কৌশলের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্যশিল্প এখন জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখছে। এ খাতে অবদান ৩.৬১ শতাংশ। দেশি মাছের পোনা উৎপাদনে বর্তমানে চার শতাধিক হ্যাচারি কাজ করে যাচ্ছে। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর, কৈ ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে।

বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পুনরুদ্ধারে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক গবেষণায় ২৩ প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন এবং চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবনে সাফল্য পেয়েছেন গবেষকরা। এগুলো হচ্ছে- পাবদা, গুলশা, গুজি / আইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, টেংরা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বেড়ালি, কুঁচিয়া, ভাগনা, খলিশা, কালিবাউশ, কই, বাটা, গজার, সরপুঁটি ও গণিমাছ। ঢেলা, শালবাইন, কাকিলা ও আঙ্গুস ভোল মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়েও গবেষণা চলছে। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ডক্টর ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, উন্মুক্ত জলাশয় থেকে যে মাছগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে সেগুলো সংরক্ষণ করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনের পর জলাশয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করার গবেষণা করছেন তারা। প্রতি বছর বিএফআরআই প্রায় ৩০০ কোটি দেশীয় মাছের পোনা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩টি ছোট দেশীয় প্রজাতির মাছ, এদের মধ্যে ৬৪টি মাছ বিলুপ্তপ্রায়। এরই মধ্যে বেশ কিছু বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ফলে দিন দিন বিলুপ্ত প্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ছে। দেশীয় মাছ সুরক্ষায় বর্তমান সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে, ২০০৯ সালে দেশে পুকুরে দেশীয় ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার ৩৪০ টন- যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২.৪১ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে হাওর, বিল ও নদনদীতে অধিক সংখ্যক অভয়াশ্রম করা হয়েছে ও এসব মাছের পোনা অবমুক্ত করা হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে শীর্ষ পাঁচটি দেশ হচ্ছে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া। চীনের উৎপাদন ২০ লাখ টনের বেশি। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ২৮ লাখ ৯৯ হাজার টন। গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছাড়িয়েছে ৪৫ লাখ ৩ হাজার টন। ফলে এক দশকে মাছ উৎপাদন বেড়েছে ১৬ লাখ টন বা প্রায় ৫৫ শতাংশ। প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আবার অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনও বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার টন, পরের অর্থবছরে ১০ লাখ ৪৮ হাজার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ লাখ ৬৩ হাজার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ লাখ ১৭ হাজার ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ লাখ ৩৬ হাজার টন। ফলে পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার টন। এ সময়ে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। দেশে বর্তমানে ৪৭৫টি সামুদ্রিক প্রজাতি, ৩৬০টি স্বাদু পানির প্রজাতি, ৩৬টি চিংড়ি প্রজাতির মাছ রয়েছে।

জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এফএও বলছে, ২০২৬ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হবে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন অবস্থান থাকবে। মৎস্য গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবেশ ব্যবস্থা মিঠাপানির মাছ চাষের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। এখানকার সোয়া আড়াই লাখ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় আর গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুরে মাছ চাষের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে