ভাগ্য বদলে বø্যাক বেঙ্গল

বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের পূণার্ঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুথর্। ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। বিশ্ববাজারে বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ হিসেবে পরিচিত। একক প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে বø্যাক বেঙ্গল রেকডর্ সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- এস এম মুকুল

প্রকাশ | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশে গ্রামীণ অথৈর্নতিক উন্নয়ন এবং আত্মকমর্সংস্থান সৃষ্টিতে নতুন আশার নাম ‘বø্যাক বেঙ্গল’। দেখতে কালো এবং আকারে বেশ বড় হওয়ায় এই ছাগলকে বাংলার কালো বাঘও বলা হয়। বø্যাক বেঙ্গল পালনের উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ রোগবালাই কম, তুলনামূলকভাবে খাবার কম লাগে, অল্প জায়গায় ছাগল পালন সম্ভব, কম পুঁজিতেও শুরু করা যায়। সঠিকভাবে পরিচযার্য় লালন-পালন এবং চিকিৎসা বিষয়ে সচেতন থাকলে এই জাতের ছাগল পালনে লোকসানের আশঙ্কা নেই। বø্যাক বেঙ্গলের জিনোম সিকোয়েন্সিং আশার খবর হলোÑ বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) একদল গবেষক দেশি জাতের বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের পূণার্ঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে সফলতা পেয়েছেন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের ঘোষণা দেন বাকৃবির ভারপ্রাপ্ত উপাচাযর্ অধ্যাপক ড. মো. জসিম উদ্দিন খান। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান গবেষক ড. এম এ এম ইয়াহিয়া খন্দকার বলেন, ‘বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের পূণার্ঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের ফলে এর খাদ্যাভাস, শারীরিক গঠন, চামড়া ও প্রজননসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হলো। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন, পুষ্টি সরবরাহ বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অজের্ন বø্যাক বেঙ্গল ছাগলকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি আথর্-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশে বø্যাক বেঙ্গল ছাগল একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক খাত হতে পারে। কেননা, বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস সুস্বাদু। এই ছাগল প্রধানত গোশত ও চামড়া উৎপাদনকারী জাত হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত। এর বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা অধিক। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুথর্ এবং মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম বাংলাদেশÑ এ খবরটি যে কাউকে আশাবাদী করবে। তা ছাড়া বিশ্ববাজারে বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া কুষ্টিয়া গ্রেড হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যে, দেশে কমবেশি আড়াই কোটি ছাগল আছে, যার পচানব্বই শতাংশই বø্যাক বেঙ্গল। দেশের প্রায় এক কোটি লোক ছাগল পালনের সঙ্গে যুক্ত, যা একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে একটি রেকডর্। অবদান রাখবে গ্রামীণ কৃষি অথর্নীতিতে বø্যাক বেঙ্গল গোট বা বাংলার কালো ছাগল। বৈজ্ঞানিক নাম ঈধঢ়ৎধ ধবমধমৎঁং যরৎপঁং.। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাগলের উন্নত জাতগুলোর মধ্যে বø্যাক বেঙ্গল, বারবারি, বিটাল, বোয়ের, যমুনা পাড়ি, কিকু, স্প্যানিশ, সাহেলিয়ান অন্যতম। তবে এসবের মধ্যে বাংলাদেশের বø্যাক বেঙ্গল বিশ্ব সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃত। জানাগেছে, এই জাতের ছাগলের মাংসের চাহিদা ব্যাপক। উন্নত পদ্ধতিতে বø্যাক বেঙ্গল পালন করে অনেক খামারি আথির্কভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রযুক্তির দিক থেকেও বø্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে পল্লী কমর্-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় ছাগল পালনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ছাগলের মৃত্যুহার কমানোর জন্য ‘লিফট’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থা ওয়েব ফাউন্ডেশন সফলতা পায়। ২০০৭ সালে প্রায় ১০ বছর গবেষণার পর জাতিসংঘের আণবিক শক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনাজির্ এজেন্সি (আইএইএ) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপর করা প্রতিবেদনে বø্যাক বেঙ্গলকে বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৭ সালের ২০ মাচর্ জাতিসংঘের সংবাদ সংস্থা ইউএন নিউজেও বø্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখনই আইএইএর ওয়েবসাইটে বø্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বিশ্বসেরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বø্যাক বেঙ্গল ছাগলকে ভৌগোলিক নিদের্শক বা জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার অপেক্ষায়। এই স্বীকৃতি মিললে বø্যাক বেঙ্গল ছাগল হবে শুধুই বাংলাদেশের। সরকার বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের চাষ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাস্তবায়ন হলে এর সুফল ছড়িয়ে পড়বে দেশের গ্রামীণ কৃষি অথর্নীতিতে। বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও এবং আন্তজাির্তক আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের (আইএইএ) সবের্শষ মূল্যায়ন অনুযায়ী, বø্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। বাংলাদেশের নিজস্ব এই জাতটির জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং ডিএনএ পরীক্ষা করে দীঘর্ ৯ বছর গবেষণা করেছে জাতিসংঘের আণবিক শক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনাজির্ এজেন্সি (আইএইএ) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। আইএইএর ওয়েবসাইটে বø্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বিশ্বসেরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদিও বাংলাদেশের সেই দারিদ্র্যাবস্থা এখন আর নেই। তবে বিশ্বসেরা এই জাতের উৎপাদন ও গবেষণায় উত্তরোত্তর সফলতা অজর্ন করছে বাংলাদেশ। তবে এফএওর গবেষণায় বলা হয়েছে, বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের দুবর্ল দিকটি হলো দৈঘর্্য-প্রস্থ-ওজন এবং দুধের পরিমাণ অন্যান্য ছাগলের চেয়ে কম। কেননা, আফ্রিকার মাসাই, ভারতের যমুনা পাড়ি এবং চীনা জাতের ছাগলের মাংস ও দুধের পরিমাণ বø্যাক বেঙ্গলের চেয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি। তবে ওই তিন জাতের ছাগলের ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাচ্চা জন্মের পরই মারা যায়। অপরপক্ষে বø্যাক বেঙ্গলের বাচ্চার মৃত্যুর হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার বিচারে বø্যাক বেঙ্গলকে সেরা জাত হিসেবে নিবার্চন করেছেন। আরো আশার খবরটি হলোÑ বø্যাক বেঙ্গল ছাগলকে ভৌগোলিক নিদের্শক বা জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার অপেক্ষায়। ওই স্বীকৃতি মিললে বø্যাক বেঙ্গল ছাগল হবে শুধুই বাংলাদেশের। খামারভিত্তিক ছাগল পালন বাড়ছে পল্লী কমর্-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় ২০০৮ সালে মাচায় ছাগল পালনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ছাগলের মৃত্যুহার কমানোর জন্য ‘লিফট’ নামে একটি প্রকল্প নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির আথির্ক ও কারিগরি সহায়তায় দেশের ১৮ জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২১টি ব্রিডিং ফামর্। বø্যাক বেঙ্গল ছাগল কিভাবে লালন-পালন করতে হয়, পিকেএসএফ তাদের সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে তা শিখিয়ে দিচ্ছে কৃষকদের। ইতোমধ্যে ছাগলের মৃত্যুহার চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে আনা সম্ভব হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে ৩০ শতাংশ এবং সারা দেশে উপজেলা প্রতি ছাগলের সংখ্যা গড়ে ১৭১ শতাংশ বেড়েছে। জানাগেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ছাগল পালন বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করছে। বতর্মানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তরুণরা গড়ে তুলছে বø্যাক বেঙ্গলের খামার। সফলতা পাওয়ায় বø্যাক বেঙ্গলের খামারের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে আশাব্যঞ্জক হারে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, সারা দেশে এখন দুই কোটি ৬০ লাখের অধিক ছাগল আছে যার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই বø্যাক বেঙ্গল জাতের। আশার খবরটি হচ্ছে, প্রতিবছরই বø্যাক বেঙ্গলের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামীণ পযাের্য় এই ছাগল পালনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এক কোটি মানুষ। একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে এটা একটা রেকডর্। দিনবদলে বø্যাক বেঙ্গল গ্রামাঞ্চলে নারীদের কমর্সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে বø্যাক বেঙ্গল। অনুসন্ধানে বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে এ জাতের ছাগল পালনের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন, কমর্সংস্থান ও অন্যতম আয়বধর্নমূলক কাযর্ক্রমের অংশ হিসেবে গ্রামীণ অথর্নীতিতে বø্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন সহায়ক ভূমিকা রাখবে। অপর দিকে বাণিজ্যিকভাবেও বø্যাক বেঙ্গলের খামার হতে পারে সবচেয়ে লাভজন উদ্যোগ। খাসির মাংস খেতে খুবই সুস্বাদু। বø্যাক বেঙ্গল জাতের এ ছাগল খুবই রোগ প্রতিরোধী এবং সহজে রোগবালাই হয় না। ভৌগোলিকভাবে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও বৃহত্তর যশোর জেলাকে বø্যাক বেঙ্গল পালনে সবচেয়ে উপযোগী স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলোÑ মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এই জাতের ছাগল পালন বেশি হয়। বø্যাক বেঙ্গল থেকে পাওয়া যায় উন্নতমানের চামড়া দুধ পৃথিবীর যে কোনো জাতের ছাগলের চামড়া থেকে গুণগত মানসম্পন্ন। ইতোমধ্যে এই জাতের ছাগলের চামড়া বিশ্ববাজারে কুষ্টিয়া গ্রেড হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। লেখক: কৃষি ও অথর্নীতি বিশ্লেষক