লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালন

প্রকাশ | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

নাহিদ বিন রফিক
‘লিটার’ শব্দের অথর্ পশুপাখির বিছানা। ঘরের মেঝেতে মুরগির মলমূত্র লেপ্টে যেন না যায় সে জন্য কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ, ছাই এসব দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বিছানা তৈরি করা হয়। এ ধরনের বিছানাকে লিটার বলে। লিটার পুরু করে দিলে তাকে বলে ডিপলিটার। লিটারে ব্রয়লার আর ডিপলিটারে লেয়ার মুরগি পালন করা উত্তম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মুরগি খামারিদের প্রতিদিন ঘর পরিষ্কারে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। তাই এসব ঝামেলা এড়াতে তখন ঘরের মেঝেতে পুরু করে খড় বিছিয়ে রাখতো। ওই সময় থেকেই ডিপলিটার পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়। বতর্মানে এর জনপ্রিয়তা দেশের সবর্ত্র বিরাজমান। লিটার ও ডিপলিটারে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে প্রথমেই চলে আসে এর বাসস্থানের কথা। মুরগির ঘর হতে হবে বেশ খোলামেলা। তা অবশ্যই পূবর্-পশ্চিম দিক লম্বালম্বি করে তৈরি করতে হবে; যেন সূযের্র কিরণ সরাসরি মুরগির ঘরে প্রবেশ করতে না পারে এবং বাতাস ঘরের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘরে মেঝে পাকা হলে ভালো হয়। পরিমিত আলো বাতাস পাওয়ার জন্য ২ থেকে ২.৫ ফুট পাকা দেয়াল কিংবা বঁাশ দিয়ে বেড়া তৈরির করে এর ওপর ২.৫ থেকে ৩ ফুট বঁাশের চটি দিয়ে জালের মতো বেড়া দিতে হবে। মেঝেতে প্রতিটি ব্রয়লারের জন্য জায়গা প্রয়োজন শীতকালে এক বগর্ফুট, গ্রীষ্মে দেড় বগর্ফুট এবং লেয়ারের জন্য উভয় ঋতুতে দুবগর্ফুট করে। তবে মুরগির বয়স ও আকার ভেদে জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। ঘরে মুরগি দেয়ার ৩/৪ দিন আগে লিটার সাজাতে হয়। ঘর শুকিয়ে লিটারের জন্য ২ ইঞ্চি এবং ডিপলিটার হলে ৬ ইঞ্চি পুরু করে উপকরণগুলো বিছাতে হবে। স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মুরগিকে দৈনিক দুবার বিশুদ্ধ পানিসহ পুষ্টিকর খাবার দেয়া প্রয়োজন। প্রতি ২৫টি মুরগির ক্ষেত্রে একটি করে খাবার পাত্র (গোলাকার) এবং ৫০টি মুরগির জন্য একটি পানির পাত্র (গোলাকার) দরকার। ডিমপাড়া মুরগির বেলায় সুষম খাবারের অংশ হিসেবে যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান অবশ্যই থাকা প্রয়োজন তা হচ্ছে- ১৬% আমিষ, ৮% অঁাশ, ৭% ঝিনুকচ‚ণর্, ২ হাজার ৮শ’ কিলো ক্যালরি খাদ্যশক্তি ও পরিমাণমতো ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার। মুরগি পালনে কৃত্রিম আলো গুরুত্বপূণর্। বাচ্চার জন্য ৪/৫ মাস পযর্ন্ত তাপের ব্যবস্থা করতে হয়। তাপের পরিমাণ বাচ্চার বয়সের ওপর নিভর্র করে। বয়স যত বাড়বে তাপের পরিমাণ ততো কমবে। ডিমপাড়া মুরগির জন্য ঘরে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা করে আলো প্রয়োজন। আলো এমন করে ঝুলাতে নেই যেন বাতাসে দোলে। কারণ এতে মুরগি ভয় পেতে পারে। হলুদ কিংবা লাল আলোতে ডিম উৎপাদন বেশি হয়। ঘরে কখনই উজ্জ্বল আলো দেয়া যাবে না। এতে পরস্পরের মধ্যে ঠোকাঠুকির অভ্যাস জন্মাতে পারে। মুরগির ঘরকে পষ্কিার পরিচ্ছন্ন রাখা বাধ্যতামূলক। সে সঙ্গে সব সরঞ্জাম রাখতে হবে জীবাণুমুক্ত। লিটারকে শুকনো রাখতে প্রতিদিন একবার করে উপরের মলমূত্র নাড়াচড়া করতে হবে। ডিপলিটারে সপ্তাহে একবার কাঠ দিয়ে খুঁচিয়ে উল্টে-পাল্টে দিলে বজর্্যগুলো মিশে যাবে। মাঝেমধ্যে চুন ব্যবহার করলে ভালো হয়। লিটার যাতে স্যঁাতসেঁতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। মোরগ-মুরগি রোগাক্রান্ত হলে বঁাচানো প্রায় অসম্ভব। তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা উত্তম। নিদির্ষ্ট ব্যক্তি ছাড়া ঘরে প্রবেশ করা ঠিক নয়। যারা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত তারাই কেবল জীবাণুমুক্ত হয়ে মুরগির ঘরে প্রবেশ করবে। রোগজীবাণু ছড়ায় এমন প্রাণী বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, ইঁদুর এরা যেন খামারে ঢুকতে না পারে সেদিক অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া রোগ হওয়ার আগেই নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে। প্রতিদিন পযের্বক্ষণের সময় কোনো মুরগি যদি অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে দেরি না করে প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের পরামশর্মতো জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মুরগি মারা গেলে অবশ্যই মাটিতে পুঁতে ফেলা কিংবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা উচিত। অসুস্থ মুরগিকে দ্রæত অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। লিটারে মুরগি পালনে সুবিধা অনেক। মুরগির পায়খানার সঙ্গে মিশ্রিত মূত্র লিটারে শুষে নেয়। ফলে ঘর থাকে শুকনো এবং দুগর্ন্ধমুক্ত। এতে মুরগি আরাম অনুভব করে। শীতকালে শীত থেকে রক্ষা করে এবং গ্রীষ্মেও পায় স্বস্তি। এ ছাড়া মাছির উপদ্রব কম হয়। খঁাচায় পালন পদ্ধতিতে তারের সঙ্গে অনবরত ঘষের্ণর ফলে মুরগির পায়ের নিচে ফুলে যায় এবং পরে ক্ষত সৃষ্টি করে। কিন্তু লিটার পদ্ধতিতে এরকম হওয়ার আশঙ্কা নেই। ডিপলিটার প্রতিদিন পরিষ্কারের প্রয়োজন হয় না। লিটার প্রক্রিয়াজাত করে হঁাস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরি করা যায়। অকেজো ডিপলিটার দ্বারা জমির জৈব সার এবং মাছের খাদ্য তৈরি হয়। মুরগির ঘরের মধ্যে লিটার ব্যবহার করলে এক ধরনের পোকা, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয়। লিটারের কাযর্কারিতায় এসব মারা যায় এবং পুনরায় জন্মে। এভাবে লিটারে আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মুরগি পা দিয়ে লিটার অঁাচড়ায়, উল্টে-পাল্টে গোসল করে এবং লিটারে জন্মানো খাদ্য কুড়িয়ে খায়। এতে মুরগির স্বাস্থ্য থাকে ভালো। আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালনে লিটার পদ্ধতি শ্রেয়। এতে উৎপাদন খরচ পড়ে কম। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোও হাতের কাছে পাওয়া যায়। লেখক: টেকনিক্যাল পাটিির্সপেন্ট, কৃষি তথ্য সাভির্স, বরিশাল।