বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিষমুক্ত শাকসবজি উৎপাদনে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিষমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে শাকসবজি চাষের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষমুক্ত শাকসবজি উৎপাদনে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ একটি অন্যতম কার্যকরী পদ্ধতি।
ম ইমরান সিদ্দিকী
  ৩১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

সেক্স ফেরোমন কিংবা জৈবিক বালাইনাশক ফাঁদ হলো বিষমুক্ত সবজি চাষের একটি আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে খুব কম সময়ে ও কম খরচে অধিক সবজি চাষ করে অনেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। তাই বর্তমানে অধিকাংশ কৃষকই এ লাভজনক পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। সেক্স ফেরোমন হচ্ছে এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ- যা কোনো প্রজাতির স্ত্রী পোকা কর্তৃক একই প্রজাতির পুরুষ পোকাকে প্রজনন কার্যে আকৃষ্ট করার জন্য প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করা হয়। সেক্স ফেরোমনের গন্ধে পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রী পোকার সহিত মিলনের জন্য এসে ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারায়। কুমড়াজাতীয় ফসল, সবজিসহ নানা চাষাবাদে এ পদ্ধতির চমকপ্রদ কার্যকারিতার কারণে কৃষকদের মাঝে এটি জাদুর ফাঁদ বা তাবিজ নামেও পরিচিত।

জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাইদমন, ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় ফেরোমন ফাঁদ স্টিকিটাপ বা হলুদ আঠালো ফাঁদ, পরিবেশবান্ধব জৈব বালাইনাশক পদ্ধতিতে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পে সুযোগ পেয়ে তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিষমুক্ত সবজি চাষে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। দুটি মৌসুমে প্রশিক্ষিত কৃষকরা রবি মৌসুমে- করলা, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া আর খরিফ মৌসুমে পটল, ধুন্দল, লাউ চাষ করছে। রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত সবজি চাষে সফলতা পেয়ে কৃষকদের মুখে হাসি দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের আবাদি জমির এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে শাকসবজি চাষ। রবি, খরিফ-১ ও খরিফ-২ এই তিন মৌসুমের মধ্যে রবি মৌসুমে শাকসবজির চাষ সর্বাধিক। শাকসবজির আবাদি জমি ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। শাকসবজি চাষে নির্বিচারে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ইত্যাদির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়ে এমন একপর্যায়ে এসেছে- যা বর্তমানে পরিবেশ এবং প্রাণিকূল বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিষমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে শাকসবজি চাষের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষমুক্ত শাকসবজি উৎপাদনে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ একটি অন্যতম কার্যকরী পদ্ধতি।

সেক্স ফেরোমন ফাঁদ মানুষ বা পরিবেশের কোনরূপ ক্ষতি করে না। সেক্স ফেরোমন ব্যবহারে উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়। ফসলের ক্ষতিকর পোকা কার্যকরভাবে দমন হয়। বালাইনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। ফলন বৃদ্ধি পায়। ফেরোমন ফাঁদ তৈরির জন্য সাধারণত তিনটি উপাদান প্রয়োজন হয় যেমন-ফেরোমন টোপ, একটি ফাঁদ (পস্নাস্টিকের একটি স্বচ্ছ পাত্র) এবং ফাঁদ স্থাপনের জন্য ১-২টি খুঁটি। এ ফাঁদে ২২ সে.মি. লম্বা চার কোণাকৃতি বা গোলাকার একটি পস্নাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা হয়। বৈয়ামের তলদেশে ৩-৪ সে.মি. সাবান মিশ্রিত পানি রাখতে হবে এবং পানির ২-৩ সে.মি. উপরে টোপ ঝুলিয়ে রাখতে হবে। প্রায় তিন লিটার পানি ধারণ ক্ষমতাযুক্ত ২২ সে.মি. গোলাকার বা চার কোণা বিশিষ্ট পস্নাস্টিকের পাত্র। এর উভয় পার্শ্বে পাত্র নিচ বা তলা হতে ৪-৫ সে.মি. উঁচুতে ত্রিভুজাকারে কেটে ফেলতে হবে। ত্রিভুজের নিচের বাহু সাধারণত ১০-১২ সে.মি. এবং উচ্চতা ১১-১২ সেন্টিমিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ফাঁদে ব্যবহৃত বক্সটিতে স্ত্রী পোকার নিঃসৃত গন্ধকে কৃত্রিমভাবে ১০০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। যাতে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পোকা বক্সের ভেতরে বা আশপাশে স্ত্রী পোকা আছে ভেবে খুঁজতে থাকে। পুরুষ পোকা গন্ধ পেয়ে লিউরের নিকট এলে মাতাল হয়ে পাত্রের তলায় সাবান বা ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানিতে পড়বে। পানি আঠালো হওয়ার কারণে আর উঠতে পারবে না। পোকাগুলো ফাঁদের ভেতর মারা যাবে। ধীরে ধীরে সব পুরুষ পোকা মারা যাবে। ফলে স্ত্রী পোকার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে না। অব্যাহতভাবে পুরুষ পোকা এ ফাঁদে মারা যাওয়ায় স্ত্রী পোকার বংশ বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। পরবর্তী বংশধর না হওয়ায় পোকা আর থাকবে না। এভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পোকা মারার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি বন্ধ করে পোকা দমন করা হয়।

সাবান মিশ্রিত পানি সব সময় পাত্রের তলা থেকে উপরের দিকে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত রাখা আবশ্যক। পাত্রের ঢাকনার মাঝে কালো রংয়ের একটি লু্যপ বসানো থাকে। লু্যপের নিচের ছিদ্রে সরু তার বাঁধা হয়। তারের অপর মাথায় ফেরোমন সংবলিত টিউব (লিউর) এমনভাবে বাঁধতে হবে যেন লিউরটি সাবান মিশ্রিত পানি হতে ২-৩ সে.মি. উপরে থাকে। সতর্ক থাকতে হবে যেন পাত্রের তলায় রক্ষিত সাবান পানি শুকিয়ে না যায়। যত্নের সঙ্গে ব্যবহার করলে একটি পাত্র ২-৩ মৌসুম পর্যন্ত চলতে পারে। কুমড়া জাতীয় সবজি, বেগুন, করলা, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, ঝিঙে, পটল, চিচিংগা, কাকরোল, উচ্ছে, তরমুজ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, খিরা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, শসা, চিচিঙ্গা, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি ফসলের জন্য এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া ফল জাতীয় গাছের মধ্যে আম, লিচু, পেয়ারা এসব গাছেও আজকাল সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে।

শীতকালীন সবজি চাষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হল মাছি পোকা। এই মাছি পোকার আক্রমণে মাঠের পর মাঠ সবজি নষ্ট হয়ে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় কীটনাশক প্রয়োগের পরও এই পোকা মরছে না। তখন আর কৃষকের করার কিছু থাকে না। আবার কীটনাশক প্রয়োগের পর নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় বাজারে বিক্রি করার জন্য। বেশি ফলনের আশায় অনেক কৃষক জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করার এক বা দুইদিন পর থেকে সবজি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে। আর এই বিষাক্ত সবজি খেয়ে সাধারণ মানুষ নানা ধরনের অসুখ-বিসুখের শিকার হয়।

ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে। সেক্স ফেরোমন প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ, তাই এটি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না বিধায় এটি সম্পূর্ণভাবে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। এ পদ্ধিতিতে বিষমুক্ত সবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা যায়। এ পদ্ধতির ব্যবহার বিধি অত্যন্ত সহজ। কম খরচে ও কম সময়ে ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা যায়। বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং কুমড়া জাতীয় ফসলের ফলের মাছি পোকা কার্যকরভাবে দমন করা সম্ভব। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারে শুধু ক্ষতিকর পোকা মারা যায়। যেখানে কীটনাশক প্রয়োগ করলে ক্ষতিকর এবং উপকারী দুই ধরনের পোকাই মারা যায়। সেক্স ফেরোমন ব্যবহারে ফসলের গুণগত মান ভালো পাওয়া যায়।

জমিতে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপনের সময় এবং পদ্ধতি হচ্ছে। বেগুন ফসলের জমিতে সাধারণত চারা রোপণের ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ পর থেকে বেগুনের কচি ডগায় ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হয়। এজন্য বেগুনের চারা রোপণের ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ পর থেকে ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। কুমড়া জাতীয় ফসলের জন্য ফুল ফোটার আগেই জমিতে ফাঁদ বসাতে হবে। সফলভাবে পোকা দমনের জন্য শেষবার ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ফেরোমোন ফাঁদ জমিতে রাখতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ সাধারণত জমির আইলের ২.৫ মিটার ভেতর থেকে শুরু করে ১০ মিটার দূরে দূরে বর্গাকারে স্থাপন করতে হবে। কুমড়াজাতীয় ফসলে ১২ মিটার, ফল বাগানে ১২ মিটার এবং কপি সবজি ক্ষেতে ২৫ মিটার দূরত্বে স্থাপন করতে হবে। বেগুন ক্ষেতে বিঘাপ্রতি ১৩ থেকে ১৪টি ফাঁদ, কুমড়াজাতীয় সবজি ক্ষেতে বিঘা প্রতি ১১টি, ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণে বিঘা প্রতি ১১টি এবং কপি সবজি ক্ষেতে ৬টি ফাঁদ বসাতে হবে। সাধারণত দুটি খুঁটি শক্তভাবে স্থাপন করতে হবে। তারপর ফাঁদটিকে তার বা সুতলি দিয়ে শক্ত করে খুঁটির সঙ্গে বাঁধতে হবে। সবজি ফসলের মাঠে উত্তর দক্ষিণ মুখ করে ফাঁদটি বসাতে হবে। এতে বাতাসকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফসলের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরোমোন ফাঁদের উচ্চতাও বাড়াতে হবে। বেগুন গাছের ঠিক উপরে, কুমড়া জাতীয় গাছের মাচা বরাবর ঝুলিয়ে এবং আম, পেয়ারা গাছে মাটি থেকে হাত উঁচিয়ে যতটুকু উঠানো যায় ঠিক ততটুকু উচ্চতায় সেক্স ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে