বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধান চাষে পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে

সাজ্জাদ হোসেন
  ০৭ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

দেশে ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ অপরিহার্য। মোট ব্যবহৃত পানির ৯৭ ভাগ সেচ কার্যে ব্যবহার হয়। ভূ-গর্ভস্থ পানির তুলনায় উপরিভাগের পানি সেচের জন্য অধিক উপযোগী হলেও শুষ্ক মৌসুমে ভূ-উপরিস্থ পানির অপরণীয় মজুত না থাকায় দেশের ৭৮ ভাগ সেচ ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। তাই সেচ কার্য পরিচালনায় প্রতি বছর গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে।

শুধুই ধানের আবাদ নয়, সব ফল-ফসলেই ক্ষেত্রমতে পানি সেচের প্রয়োজন হয়। ধান ও ফল-ফসল উৎপাদনের জন্য যেমন পরিমিত সেচ ব্যবস্থা প্রয়োজন, তেমনি জমির উর্বরতা বজায় রাখতেও পরিমিত সেচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেচের মাধ্যমে গভীর নলকূপ দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন অথবা খাল, বিল, নদীনালার পানি উত্তোলন যেটাই করা হোক না কেন, এজন্য জ্বালানি হিসেবে ডিজেল, গ্যাস বা বিদু্যতের প্রয়োজন। প্রয়োজনের বেশি পানি উঠাতে গেলে জ্বালানি ও বিদু্যতেরও ব্যাপক অপচয় ঘটে। বাংলাদেশে আউশ, আমন, ইরি ও বোরো ধান আবাদের ক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে বোরো ধান আবাদেই এখন দেশের খাদ্য চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করে। ফসল আবাদের সময় সেচের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদু্যৎ প্রয়োজন হয়। এ সময় বিভিন্ন এাকায় বিদু্যতের ঘাটতি তৈরি হয়। বোরো আবাদে সেচের জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও বিদু্যৎ খরচ করতে হয়। বোরো মৌসুমে সেচের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এজন্য বোরোর আবাদ এলাকায় আর না বাড়িয়ে আউশ এবং বৃষ্টিনির্ভর আমন ধানের আবাদ এলাকা বাড়ানোর জন্য সরকারি প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার। বোরো চাষে সেচ কাজে পানির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়- যা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি অধিক পরিমাণে উত্তোলন করা হয়। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। বোরো মৌসুমে ধান চাষাবাদে খরচের অন্যতম প্রধান খাত হলো সেচ। ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে বোরো মৌসুমে ধান চাষে সেচের জন্য প্রতি বিঘায় খরচ হয় ২০০০ টাকার বেশি। আর সেচ খরচ বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩১ সালে প্রতি হেক্টরে এ খরচ ১৬,৭১২ টাকায় দাঁড়াতে পারে। কাজেই উৎপাদন খরচ কম রাখতে হলে মাঠ পর্যায়ে যথাযথ সেচ ব্যবস্থাপনা এবং সেচ প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে খরচ সীমিত করার উদ্যোগ নিতে রোডম্যাপ করতে হবে।

জলবায়ুর প্রভাবে খরা বাড়ছে। এমন অবস্থায় আমন মৌসুমেই সম্পূরক সেচ প্রয়োগের মাধ্যমে খরা মোকাবিলা করে ১০ লাখ টন বাড়তি ধান উৎপাদন করা সম্ভব। এ দেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ, ৮৫ লাখ ৮৫ হাজার ২০৭ দশমিক ৪ হেক্টর। আর মোট সেচকৃত জমির পরিমাণ ৭৬ লাখ ১৪ হাজার ৫৭২ হেক্টর। এর মধ্যে আমন মৌসুমে ২০ লাখ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন পর্যায়ে সেচের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে আউশ, আমন ও বোরো তিন মৌসুমেই কমবেশি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় দেড় হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। আমন মৌসুমে বিশেষ করে ধান রোপণের সময়টাতে এবং ধানের ফুল আসা পর্যায়ে যখন খরা দেখা দেয় তখন সম্পূরক সেচ প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এছাড়াও আউশ মৌসুমে ধান চাষে সম্পূরক সেচ প্রয়োগের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করা যায়। অনুরূপভাবে বিভিন্ন সেচ প্রযুক্তি যেমন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে রবি ফসল উৎপাদন, অগভীর নলকূপে চেকভাল্ব সংযোজনের মাধ্যমে প্রাইমিং সমস্যা দূরীকরণ, গভীর নলকূপে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি বিতরণ পদ্ধতি, এডবিস্নউডি পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে আউশ-আমনের পাশাপাশি বোরো ধান চাষে পানি সাশ্রয় এবং ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। বৃষ্টিনির্ভর রোপা আমন এলাকায় জমির আইল ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু ও ফাটলবিহীন রাখলে অনেকাংশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়- যা খরা থেকে ফসলকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। এরপরও যদি ফসল খরাকবলিত হয় তাহলে প্রয়োজন মাফিক যথাসময়ে সম্পূরক সেচ দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, খরাকবলিত ধানের চেয়ে সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় এক টন বেশি হয়।

এসব সমস্যা বিবেচনায় আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ডায়িং পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। যাতে বোরো ধান চাষে ৪০ ভাগ পানি সাশ্রয় হবে এবং ২০ শতাংশ উৎপাদন বাড়বে। পরিমিত পরিমাণ সেচ ব্যবস্থার পদ্ধতি পূর্ব থেকেই কৃষক পর্যায়ে প্রচলিত ছিল। ধান ক্ষেতে পানি সাশ্রয়ের জন্য কৃষকদের উদ্ভাবিত একটি সনাতন পদ্ধতির নাম 'পিঠ দেওয়া' বা ফসলের মাঠ পর্যায়ক্রমে শুকানো ও সেচ দেওয়ার মাধ্যমে পানি সাশ্রয় করা। এ প্রদ্ধদ্ধিতে ধানের জমিতে চারা রোপণের ১৫ দিন পর্যন্ত ২-৪ সেন্টিমিটার পানি রাখতে হয়, যাতে আগাছা কম জন্মে। চারা রোপণের ১৫ দিন পর জমিতে এডবিস্নউডি পদ্ধতি অনুসরণ করে সেচ দিলে পানি অপচয় রোধ হয়। জমিতে সেচ দিয়ে নলের ভেতরে পানির মাত্রা পরিমাপ লক্ষ্য রাখতে হয়। ক্ষেতের পানি শুকিয়ে পাইপের তলায় নেমে গেলে আবার সেচ দিতে হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ দিতে হয়। কৃষিবিদদের মতে, বিনা প্রয়োজনে জমিতে সেচ দেওয়ার কোনো দরকার নেই। বোরো ধানের জমিতে পানি ১৫ সেন্টিমিটারের নিচে চলে গেলে তবেই সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এতে কয়েকদিন পরপর জমিতে অতিরিক্ত সেচ দিতে হয় না। এতে সেচ ব্যয় কমে এবং পানির সদ্ব্যবহার হয়। তাই এ প্রযুক্তি কৃষি উন্নয়নে আরও অগ্রগতি হবে বলে কৃষিবিদরা আশা করেন। এতে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ধান চাষের জন্য অনবরত দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই; বরং সেচ দেওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শুকিয়ে আবার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে ক্ষেতে আগাছাও কম হয়। ধান চাষে পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানো যায় এবং সঠিক পদ্ধতির সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণের মাধ্যমে ধানের ফলনের ক্ষতি এড়ানো যায়।

বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা অনেকটাই সেচ নিভর্রশীল। বাংলাদেশের মোট সেচকৃত জমির শতকরা ৮০ ভাগে সেচ প্রদান করা হয় অগভীর নলকূপের মাধ্যমে। বর্তমানে প্রায় ১৬ লাখ অগভীর নলকূপ সেচ কাজে নিয়োজিত আছে। অগভীর নলকূপের পাম্প চালানোর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো প্রাইমিং। প্রাইমিংয়ের মাধ্যমে মাটির নিচে নলকূপের ভেতরে থাকা পানিকে সেচ পাম্পের ডেলিভারির মুখ প্রান্ত তুলে আনতে হয়। অগভীর নলকূপের পাম্প যখনই চালু করা হয় তখনই প্রাইমিংয়ের প্রয়োজন হয়। প্রাইমিং কাজটি প্রান্ত বিরক্তিকর এবং এ কাজের জন্য সময় অপচয় ও অতিরিক্ত শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। বারবার প্রাইমিংয়ের বিড়ম্বনা দূর করার জন্য ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ একটি চেক ভাল্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এই চেক ভাল্ব ব্যবহার করলে মৌসুমের শুরুতে একবার প্রাইমিং করলে সারা মৌসুমে আর এর প্রয়োজন হবে না। এ জন্য কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন নেই। অতি সহজেই চেক ভাল্বটি অগভীর নলকূপের সঙ্গে সংযোজন করা যায়। এটি সহজে বহনযোগ্য।

দেশে সেচকৃত জমির শতকরা ১৫ ভাগে ভূ-উপরিস্থ পানি এবং শতকরা ৮৫ ভাগে ভূ-গর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ প্রদান করা হয়। ভূ-উপরিস্থ পানি প্রদানের জন্য লো লিফ্‌ট পাম্প ও বিভিন্ন প্রকার বাঁধ (ড্যাম) ব্যবহার করা হয়। আবার ভূ-গর্ভস্থ পানি প্রদানের জন্য গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, সাবমার্সিবল পাম্প ইত্যাদি সেচযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৬ হাজার গভীর নলকূপ এবং ১৬ লাখ অগভীর নলকূপ সেচ কাজে নিয়োজিত আছে। এ ধরনের সেচ যন্ত্রে পানি উত্তোলন এবং ডিসচার্জ ক্ষমতা থাকলেও মাঠে পানি বণ্টনের পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়ায় হয় না। বিশেষ করে গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে যখন কাঁচা, আধা পাকা, ভাঙা পাকা নালার মাধ্যমে মাঠে পানি বণ্টন করা হয় তখন সরবরাহকৃত পানির শতকরা ২৫-৩০ ভাগ অপচয় হয় শুধু নালাতেই, যাকে বড় ধরনের পরিবহণ অপচয় বলা যায়। আবার যে সব জমির উচ্চতা পানির উৎস থেকে উপরে অবস্থিত সে সব জমিতে উলিস্নখিত পদ্ধতিতে পানি পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ গভীর নলকূপে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি বিতরণ পদ্ধতি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এ ক্ষেত্রে পিভিসি পাইপ, ক্রস, টি, বেন্ড ও ক্যাপ ব্যবহার করে সেচ যন্ত্রের পানি বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানোর বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এ পদ্ধতিতে পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে সেচ এলাকা বৃদ্ধি ও সেচ খরচ কমানো সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে