বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী দিনের ধান হবে খরা সহিষ্ণু, গ্রিন সুপার রাইস

গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এসে ধান গবেষণার ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। ধানের গাছকে খর্বাকৃতি করে দেওয়ার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করার যে প্রচেষ্টা শুরু হয় বিজ্ঞানীদের সে প্রচেষ্টা দারুণভাবে সফল হয়। গত চার দশক ধরে বিশ্বের বার্ষিক ধানের উৎপাদন ২৫২ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ৬০০ মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে। উচ্চফলনশীল, সার সংবেদনশীল, আধা খর্বাকৃতির ধান জাতের সঙ্গে উপযুক্ত উৎপাদন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে বিধায় ধানের উলেস্নখযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ বর্ধিত চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে শতকরা ২৫ ভাগ। সে লক্ষ্য অর্জনে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন ধানের জাত উৎপাদনের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে
কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
  ০৭ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য ভাত। শুধু বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের প্রধান আহার নয়, ধান থেকে পাওয়া চালকে প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে বেঁচে থাকে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী। বিশ্বের শতকরা ৬০ ভাগ লোকের প্রধান খাবার চাল বা চাল থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন খাদ্যপণ্য। আর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রধান খাদ্য ভাত। বিশ্বের ৯০ ভাগ ধান উৎপাদন ও ব্যবহার হয়ে থাকে এশিয়া অঞ্চলে। এ কারণে বলা হয়, রাইস ইজ লাইফ ইন এশিয়া। একইভাবে, রাইস ইজ লাইফ ইন বাংলাদেশ। সে কারণে ফসল হিসেবে ধানকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এসে ধান গবেষণার ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। ধানের গাছকে খর্বাকৃতি করে দেওয়ার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করার যে প্রচেষ্টা শুরু হয় বিজ্ঞানীদের সে প্রচেষ্টা দারুণভাবে সফল হয়। গত চার দশক ধরে বিশ্বের বার্ষিক ধানের উৎপাদন ২৫২ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ৬০০ মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে। উচ্চফলনশীল, সার সংবেদনশীল, আধা খর্বাকৃতির ধান জাতের সঙ্গে উপযুক্ত উৎপাদন প্রযুক্তিযুক্ত হয়েছে বিধায় ধানের উলেস্নখযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ বর্ধিত চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে শতকরা ২৫ ভাগ। সে লক্ষ্য অর্জনে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন ধানের জাত উৎপাদনের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশে আমন চাষে যুক্ত হচ্ছে নতুন জাত 'গ্রিন সুপার রাইস' বা বিনা ধান-১৭। আমন মৌসুমে এ ধানের আবাদ দেশের খাদ্য উৎপাদনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গ্রিন সুপার রাইস নিয়ে গবেষণা চলমান আছে চীনে। বিনা দেশের ১০টি কৃষি অঞ্চলের মাঠে এটি চাষাবাদ করে সফলতা পায়। গ্রিন সুপার রাইস গবেষকরা বলেন, গ্রিন মানে পরিবেশবান্ধব। নতুন এ জাতে রাসায়নিক সার কম লাগে। কীটনাশক দিতে হয় না। পানির ব্যবহারও কম প্রয়োজন পড়ে। পরিবেশবান্ধবের কারণেই এটিকে গ্রিন বলা হয়েছে। আর সুপার বলা হয়েছে এটি সেরা ধান বলে। এর উৎপাদন অন্য ধানের তুলনায় বেশি বলে। আমন মৌসুমে প্রতি হেক্টরে এর উৎপাদন আট টন পর্যন্ত হতে পারে। এ জাতটি খরা সহিষ্ণু।

গ্রিন সুপার রাইস সৃষ্টির লক্ষ্য বেশ কিছু ভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিলেন বিজ্ঞানীরা। একটি দু'টি উন্নত জাত নয়, বরং বেশ কয়েকটি উন্নত জাতকে নেয়া হয়েছে ভিত্তি জাত হিসেবে। অধিকসংখ্যক উন্নত জাতকে ভিত্তি জাত হিসেবে নেয়া এ প্রকল্পের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কোনো জাতটি অন্য সব জাতের সঙ্গে সংকরায়নের মাধ্যমে উত্তম বংশধর তৈরি করবে তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। ফলে অনেক বছর ধরে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেয়ে অনেক উত্তম জাত নিয়ে একই সময়ে নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তাতে একদিকে যেমন সময় বাঁচবে, তেমনি নানা সংকরায়ন সংযোগ থেকে কাঙ্ক্ষিত বংশধর পাওয়ার সুযোগও বেড়ে যাবে। অধিক সংখ্যক উন্নতজাত বাছাই করার আর একটি কারণ হলো এই যে, কোনো একটি জাত হয়তো অল্প ক'টি জাতের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সক্ষম হবে এবং অন্য আর একটি জাত হয়তো অন্য কয়েকটি জাতের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সক্ষম হতে পারে। বিভিন্ন জাতের সঙ্গে সংকরায়নের পর উত্তম বংশধর সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে উন্নত জাতগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। সময় নষ্ট না করে সে পার্থক্যটাকে একই সময়ে কাজে লাগানই প্রকল্পের আর একটি বৈশিষ্ট্য। এর জন্য অবশ্য দক্ষ অনেক সংখ্যক উদ্ভিদ প্রজননবিদের প্রয়োজন হবে। চীনে এ রকম প্রজননবিদের সংখ্যা বিশ হাজারের মতো। আর প্রকল্পের মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছেন বেশ ক'জন চীনা বিশ্বখ্যাত উদ্ভিদ প্রজননবিদ। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার আণবিক বংশগতিবিদ্যা তথা জিন প্রযুক্তিতেও বেশ দক্ষ। এ প্রকল্পের আর একটি উলেস্নখযোগ্য দিক হলো একটি উত্তম জাতে সব উত্তম জিনের সমাহার নয় বরং বেশ কয়েকটি উত্তম জাতে ভিন্ন ভিন্ন রকম উত্তম বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনের সমাবেশ ঘটানো। এতে একই সময়ে নানা উত্তম বৈশিষ্ট্য সংবলিত অনেক রকমের ধানের সম্ভাবনাময় বংশধর পাওয়া যাবে।

অল্প উপকরণ নির্ভর উচ্চফলনশীল এবং অধিক ফলন বিশিষ্ট রোগ এবং কীটপতঙ্গ সহিষ্ণু ধান জাতকেই গ্রিন সুপার রাইস বলা হচ্ছে। এসব ধান গাছের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য সংযোজন করা হবে যেন এরা কম পানিতে উত্তম ফলন দিতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ স্থানীয় ধানের জাতের পানি সাশ্রয়ী বৈশিষ্ট্য সংযোজন করে এ রকম ধান গাছ পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া পানি ও খাদ্যোৎপাদনে সর্বোচ্চ ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারলে এরা পানি ও পুষ্টি উপাদান সাশ্রয়ী হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া এসব জাতগুলোর কোনো কোনোটা হবে খরা সহিষ্ণু, লবণাক্ততা বা ক্ষারকত্ব সহিষ্ণু; কোনো কোনোটা আবার হবে নানা রকম রোগ সহিষ্ণু; কোনো কোনোটা এক বা একাধিক কীট প্রতিরোধী; কোনো কোনো জাতে থাকবে এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য যা একে 'গ্রিন' তথা অক্ষত অর্থাৎ সবুজ রাখতে সহায়ক হবে এবং এরা উচ্চফলনশীল হবে। সনাতন পশ্চাৎ সংকরায়ন পদ্ধতি আর আধুনিক আণবিক প্র্রজনন পদ্ধতির সমন্বয় ঘটিয়ে উচ্চফলনশীল জাতগুলোতে সন্নিবেশন করা হবে এক একটি জিন। পাশাপাশি এদের ব্যবস্থাপনার কৌশলসমূহও উদ্ভাবন করা হবে। এভাবে সৃষ্ট জাতের শতকরা ৭০ ভাগ হবে হাইব্রিড প্রকৃতির আর শতকরা ৩০ ভাগ হবে ইনব্রিড জাত। এভাবে উৎপন্ন প্রাথমিক পর্যায়ের লাইনগুলো পৌঁছানো হবে এশিয়া ও আফ্রিকার ১৯টি দেশ ও অঞ্চলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। লক্ষ্য হবে এসব লাইন থেকে এলাকাভিত্তিক কাঙ্ক্ষিত ও প্রয়োজনীয় লাইনকে বাছাই করে নতুন জাত হিসেবে অবমুক্ত করা। কয়েকটি ধাপে এ কাজটি সম্পন্ন করতে চান বিজ্ঞানীরা। প্রথম ধাপটি হলো তিন বছরের। এ সময়ের মধ্যে উদ্ভাবিত ১৫টি উৎকৃষ্ট লাইন চলে যাবে জাতীয় ফলন পরীক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্যে দেশগুলোতে। এসব নির্বাচিত আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- নাইজেরিয়া, রোয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, মালে, সেনেগাল, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক এবং উগান্ডা। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- লাওস, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান। এছাড়া রয়েছে চীনের ৪টি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল যথা- মিচুয়াম, গোয়াঙি, ইউন্নাম এবং গোইজোও। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার এসব অঞ্চলের ধানের ফলন শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করা।

\হ

লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে