ব্যতিক্রম ব্যবসা

নতুন এক উদ্যোগ গবাদি পশুর হোটেল

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

মজনু সরকার
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গবাদি পশুর হাট। এ সব হাটের মধ্যে অধিকাংশ হাট সপ্তাহে একবার বসে- তবে এর মধ্যে দেশব্যাপী ৬৪ জেলায় কমবেশি ১৪৮টির মতো গবাদি পশুর প্রসিদ্ধ হাট রয়েছে- যে হাটগুলো সপ্তাহে ২ দিন বসলেও এই হাটগুলোতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে- বেপারীরা গবাদ পশু এনে বেচা-কেনার মাধ্যমে হাটটিকে সপ্তাহে সাতদিন কর্মমুখর রাখেন। এই হাটগুলোতে সাধারণত যেসব পশু অবিক্রিত থাকে সেগুলো হাটের চারপাশে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা শেডে অথবা খোলা আকাশের নিচে বেঁধে রাখে পশু। আর পাশে অথবা আশপাশের বাড়িতে বেপারীরা অবস্থান করে পরের হাটের জন্য। \হএ ভাবেই এই হাটগুলোতে সপ্তাহে ৭ দিনই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হয়ে থাকে এবং হাটের কাযক্রম চলতে থাকে। এসব জায়গাতে যেখানে বেপারীদের থাকার জন্যই নূ্যনতম আধুনিক সুযোগ-সুবিধা (ভালো থাকা, খাওয়া, টয়লেট, গোসলের সুব্যবস্থা ইত্যাদি) নেই সেখানে গবাদি পশুর জন্য এসব সুযোগ-সুবিধা সংবলিত হোটেল ব্যবস্থাপনা থাকবে সেটা তো অকল্পনীয়। সেই অকল্পনীয় বিষয়টিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার গবাদি পশুপ্রেমিক মাস্টার শহিদুল ইসলাম। তিনি নিজে ২০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে গরু সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটে বিক্রি করে থাকেন। তিনি এই ব্যবসা করতে গিয়ে জীবনে নানা সমস্যা অসংখ্যবার ফেস করেছেন। সেই ২০ বছরের পেইনফুল অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ২০২০ সালে প্রথম এ ধরনের একটি ব্যতিক্রম ব্যবসায়িক ধারণা- আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত 'পশুর হোটেল' করার উদ্যোগ নেন। যেখানে পশুরা একটি আরামদায়ক পরিবেশে থাকতে পারবে। পাশাপাশি বেপারীরাও তুলনামূলক কম খরচে থাকতে পারে। সরজমিনে পশুর হোটেলটি ঘুরে দেখা যায় সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার বড়ধুল হাটসংলগ্ন খামারে। বড়ধুল গ্রামে স্থাপিত প্রায় ২০০ গরু ধারণক্ষমতার এই হোটেলে বর্তমানে নিয়মিত প্রতিদিন গড়ে ১৫০ গরু থাকে এবং ৮-১০ জন বেপারী থাকে। এই হোটেলে গরু থাকা, খাওয়া বাবদ বেপারীকে ৫০ টাকা এবং তার থাকা বাবদ ১৫০ টাকা দিতে হয়। এভাবে এই হোটেলটি থেকে শহিদুল ইসলামের দৈনিক গড়ে আট থেকে নয় হাজার টাকা এবং মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা আয় হয়ে থাকে। ঈদের সময় গরু সংখ্যা আরও বেশি হয়ে থাকে বলে তিনি জানান। এছাড়া তার ওখান থেকে প্রতিদিন ৮-১০ জন বেপারীর ৮-১০ ট্রাকে করে ১৫০-১৬০ গরু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রির উদ্দ্যেশে চলে যায়। চাহিদা থাকায় হোটেলটির পাশে তিনি আরও একখন্ড জমি খুঁজছেন, জমি পাওয়া গেলে তিনি বর্তমান হোটেলটি সম্প্রসারণ করবেন এবং এ ধরনের আরও একটি হোটেল দেয়ার তার পরিকল্পনা রয়েছে। শহিদুল ইসলামের পশুর হোটেল ব্যবস্থাপনাকে আরও আধুনিক করতে সহায়তা করছে পিকেএসএফ ও ইফাদ-এর যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত স্থানীয় এনজিও-এনডিপি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন 'নিরাপদ মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার উন্নয়ন' ভ্যালু চেইন উপ-প্রকল্প। এই উপ-প্রকল্প থেকে হোটেলটির আধুনিকায়ন করতে পশুর ডাক্তারদের বসার জায়গা, পশু মাপার মেশিন, ড্রেনেজ সুবিধা, আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থাপনা, গরম হ্রাসের ব্যবস্থাপনা, মেকানাইজেশন, বায়োগ্যাসের মাধ্যমে নিজস্ব এনার্জি উৎপাদন ইত্যাদি সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, খুব শিগগিরই এই হোটেলটি গবাদি পশুর জন্য একটি আদর্শিক আধুনিক টু-স্টার হোটেলে পরিণত হবে। এই ধরনের হোটেল ব্যবস্থাপনার ধারণা দেশে বিদ্যমান অবশিষ্ট ১৪৮টি হাটেও ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব, যদি এটা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয় তবে এতে করে একদিকে গবাদিপশুরা পাবে আরামদায়ক ব্যবস্থাপনা অন্যদিকে এই কর্মকান্ডের মাধ্যমে কমপক্ষে এক হাজার মানুষের পূর্ণকালীন কমসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। দেশে গত ১০ বছরে গবাদি পশুর বাণিজ্যিক প্রসার ঘটেছে ব্যাপক হারে। দেশি গরুর জায়গায় সংকর জাতের গরুর আগমন হয়েছে, এমনকি উড়োজাহাজে করে বিদেশি বাহামা জাতের গরু নিয়ে এসে লালন-পালন করে ৩০ থেকে ৪০ মণ ওজনের গরু বিক্রি হচ্ছে। কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। গ্রামের মাঝারি মাপের খামারিরা নিজেদের খামারেই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সার্থকভাবে গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন সম্পন্ন করছেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী- গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া্তসব মিলিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে ১২তম। সরকারি হিসাব বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ভারতীয় গবাদি পশু আসা বন্ধ হওয়ার পর দেশে প্রতি বছর ২৫ শতাংশ হারে গবাদি পশুর খামার বাড়ছে। ছোট-বড় মিলিয়ে খামারের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। তিন বছরে (২০১৮-২০) দেশে গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ। এখন কোরবানির জন্য বিদেশ থেকে গরু আনতে হয় না। দেশি গরুতেই কোরবানি চাহিদা মিটিয়েও অবিক্রিত থাকে ২০ থেকে ৩০ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পশুর উৎপাদন আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩ লাখ ৯৯ হাজার বেড়ে হয় ৫ কোটি ৬৩ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ গরু, ৪৫ শতাংশ ছাগল। বাকিগুলো মহিষ ও ভেড়া। লেখক: উপ-ব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ