নিবার্চন পরবতীর্ সরকার

কৃষি খাতের প্রত্যাশা

প্রকাশ | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

শাইখ সিরাজ
কৃষিতে যুগান্তকারী পরিবতর্ন এসেছে। বাংলাদেশের কৃষি এগিয়েছে অনেকখানি, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আরও কিছু বিষয়ে গুরুত্বপূণর্ পদক্ষেপ নিলে কৃষি বাংলাদেশের অথর্নীতিতে যুক্ত করবে অন্যরকম সাফল্য। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমাকে যেতে হয় কৃষকের কাছে। প্রতিবছর ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে আনতে চেষ্টা করি একেবারে মাঠপযাের্য়র কৃষকের চাহিদা, প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির তথ্যটুকু। কৃষকের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই নতুন সরকার গঠনের পর কৃষিতে এ বিষয়গুলোর প্রতিফলন দেখতে চাই। কৃষকের জন্য চাই উন্নত ও আধুনিক বাজার-ব্যবস্থা। যশোরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে যে শিম বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা কেজি, ঢাকার বাজারে তা বিক্রি হয় ১০০ টাকা কেজি দরে। কৃষক অনেক ক্ষেত্রেই তার ফসলের ন্যায্য দামটা পায় না। চীনের কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়নের পেছনে রয়েছে চীন সরকার কৃষককে উন্নত বাজারব্যবস্থার আওতায় এনেছে। অনলাইনভিত্তিক বাজারে কৃষক নিজেই তার পণ্য বিক্রি করতে পারছে। আবার অকশনেও সরাসরি অংশ নিতে পারছে। সারা পৃথিবীই এখন জলবায়ু পরিবতের্নর কারণে প্রকৃতির বৈরিতার শিকার। বাংলাদেশের কৃষিও ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েকবার। জলবায়ু পরিবতের্নর বিষয়টি মাথায় রেখে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ জরুরি। সেই সঙ্গে প্রয়োজন কৃষিতে শস্যবীমা চালুকরণ। বতর্মান সময়ে খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্যের বিষয়েও পৃথিবীর মানুষজন সচেতন হয়ে উঠছে। বিদেশের বেশ কয়েকটি হোলসেল মাকের্ট ঘুরে যে অভিজ্ঞতাটি আমার হয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের ফল-ফসলে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ হয় এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে। আমাদের দেশের পান পাশের দেশ ভারত হয়ে দেশে বাইরের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে এমন দৃশ্যও আমি দেখেছি। বাংলাদেশে উৎপাদিত খাদ্য মানেই ‘নিরাপদ খাদ্য’ এই বিশ্বস্ততা অজর্ন করতে হবে। এর জন্য সরকারিভাবেই কাযর্কর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আওয়ামী লীগ তাদের ২০১৪ সালের নিবার্চনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিল ‘কৃষিপণ্যভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেয়া হবে।’ এর প্রতিফলন কিছুটা দেখা গেলেও কৃষকের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কৃষক তাদের উৎপাদিত টমেটো, পেয়ারা প্রভৃতি ফল-ফসলের প্রত্যাশিত দাম না পেয়ে হতাশ হয়েছে। কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের বিভিন্ন সেশনে তাদের দাবি ছিল উৎপাদিত পণ্যের ভ্যালু অ্যাড করার জন্য কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা। যেমন ঝালকাঠির পেয়ারা চাষিরা বলছিলেন, তাদের একটা জ্যাম-জেলি তৈরির কারখানা থাকলে মৌসুমের ফলন থেকে আরও বেশি দাম পাওয়া সম্ভব হতো। মুন্সীগঞ্জের কৃষক আলু চাষ করে লোকসান গুনছে। অথচ আমাদের বাজারে ভারতীয় আলুর চিপস দেদার বিক্রি হচ্ছে। বিগত বছরগুলোয় কৃষি গবেষণায় প্রচুর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে এর পাশাপাশি গবেষণার সাফল্য কৃষকপযাের্য় কতটুকু পৌঁছলো সেটুকুও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। বিদেশ থেকে যন্ত্র বা প্রযুক্তি আমদানি না করে দেশে সে যন্ত্র বা প্রযুক্তি তৈরি করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বেসরকারি পযাের্য় যারা কৃষিযন্ত্র তৈরির পদক্ষেপ নিচ্ছেন তাদের উৎসাহ দিতে হবে। কৃষি উপকরণ কৃষকের হাতের নাগালে রাখতে হবে। বিশেষ করে বীজ নিয়ে কৃষক দুভোের্গর শিকার হয়। কৃষকের জন্য মানসম্মত বীজের ব্যবস্থা করতে হবে। সারা বিশ্বে কৃষি দারুণ আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত হয়ে উঠেছে। ফলে কৃষি কৃষকের জন্য হয়ে উঠেছে সহজে। নতুন সব প্রযুক্তির সঙ্গে এ দেশের কৃষককে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কৃষকের জন্য মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন ফসল চাষ ও প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। এমনকি ফল-ফসল রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা অনুসরণ করে কৃষক যেন উৎপাদন করে সে বিষয়েও কৃষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষি এখন শিল্প। সারা পৃথিবীই প্রযুক্তির কৃষির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কৃষির ঊধ্বর্মুখী সম্প্রসারণ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে নিশ্চিত লাভ জেনে শিল্পোদ্যোক্তারা কৃষিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করছেন। সাধারণ কৃষক এ ব্যয়ভার বহন করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে কৃষকের জমি হারানোর ভয় যেমন আছে, আছে তার নিজের জমিতেই শ্রমিক হওয়ার আশঙ্কা। সে ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই একটা নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে। যেখানে কৃষক ও শিল্পোদ্যোক্তার মধ্যে একটা অংশীদারমূলক সম্পকর্ থাকবে। সামান্য একটি তথ্যই বদলে দিতে পারে কৃষির চিত্র। তথ্যপ্রাপ্তি কৃষকের জন্য সহজ করতে হবে। ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্রগুলোকে কৃষকের তথ্যকেন্দ্রে রূপান্তর করার পদেক্ষপ নেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কৃষককে তথ্যকেন্দ্র সম্পকের্ আরও বেশি সচেতন করে তুলতে হবে। কৃষকের তথ্য আদান-প্রদানে সরকারি কমর্কতার্-কমর্চারীদের দায়বদ্ধতা আনতে হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সারা পৃথিবীই নগরকৃষিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বড় বড় শহরে অট্টালিকায় চলছে পুরোদস্তুর চাষবাস। আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, পতুর্গাল থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, জাপান, কোরিয়ায়ও নগরকৃষি আলোড়িত এক বিষয়। আমাদের দেশের আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনের নকশা অনুমোদনকালে ছাদকৃষির সুযোগ রাখা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। কৃষকের জন্য ভতুির্ক চালু রাখতে হবে। কৃষি ঋণ প্রাপ্তি যেন সহজ হয় এবং কম সময়ে পাওয়া যায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। লেখক : কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং পরিচালক (বাতার্), চ্যানেল আই