বিশ্বসেরা বাংলার বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল

ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় বাংলাদেশ ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে কমবে বেকারত্ব

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ম ইমরান সিদ্দিকী
ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। ছাগল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিসম্পদ। গরু-ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক অবস্থানে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে। এফএওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশে উৎপাদন হওয়া অধিকাংশ ছাগলই বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের। এটিই আদি দেশি জাত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মূল্যায়ন অনুযায়ী, বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। দেশের শুধু চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও রাজশাহীতে ২০ হাজার খামারে প্রায় ৫০ লাখ ছাগল লালনপালন করা হয়। এসব ছাগলের অধিকাংশই বাংলাদেশি বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, টানা চার বছর ধরে ছাগলের দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। সামগ্রিকভাবে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন। বস্ন্যাক বেঙ্গল বিশ্বের পাঁচটি সেরা ছাগলের মাংস উৎপাদন জাতের অন্যতম। এদের বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা অধিক, মাংস সুস্বাদু, চামড়া আন্তর্জাতিকমানের। বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে এর ভূমিকা অপরিসীম। সংখ্যার দিক থেকে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে এ জাতের ছাগলের উৎপাদন আরও বাড়লে নাগালে আসবে মাংসের দাম। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উপায়ে ৩০০ প্রজাতির ছাগল আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের কালো ছাগল বা বস্ন্যাক বেঙ্গল বিশ্ব সেরা। এ স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপরে গবেষণা করে বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৮ সালে বস্ন্যাক বেঙ্গল গোটের জেনোম সিকোয়েন্সিং বা পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করেছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল আকারে বেঁটে, কিন্তু শরীরের কাঠামো শক্তপোক্ত ও পেশিবহুল। এর গায়ের লোম খাটো এবং শিং ছোট হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ছাগল বা পাঁঠার ওজন হয় ২২ থেকে ৩০ কেজি, ছাগীর ওজন ২০ থেকে ২৫ কেজি হয়। বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল ১৪ মাসে দুইবার বাচ্চা দেয়, প্রতিবারে অন্তত দুইটি, সর্বোচ্চ ৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে একবারে। এই ছাগল দুধ কম দেয়। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, আসাম, এবং উত্তর উড়িষ্যায় পাওয়া যায়। এছাড়া মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকাতেও পাওয়া যায় এই জাতের ছাগল। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল পরিষ্কার, শুষ্ক এবং উঁচু জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের জিনগত বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছে, যে কারণে মূলত বাংলাদেশেই তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এবং ঝিনাইদহ জেলায় বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়। বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের এই ছাগলটি বাংলাদেশের একেবারে নিজস্ব প্রজাতি। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিরা বলেছেন, মূলত মাংস ও চামড়ার জন্য বস্ন্যাক বেঙ্গল বিশ্ব বিখ্যাত। বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ খাতের ভূমিকা অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। সার্বিক কৃষিখাতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দেশে আদিকাল থেকে যে ছাগল পালন হচ্ছে তা বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের, আর বিদেশ থেকে বিশেষত ভারত থেকে আমদানি করা রামছাগল। এ দেশের আবহাওয়া বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালনে অত্যন্ত উপযোগী। এই জাতের ছাগল পালনের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সহজেই সম্ভব। মাংস এবং চামড়ার গুণগত মানের জন্য এ জাতের ছাগলকে উৎকৃষ্ট মানের বলা হয়। এছাড়া এটি পালন সহজ এবং পালন করার জন্য বড় কোনো জায়গার দরকার হয় না। জানা যায়, দেশে বিদ্যমান ছাগলের অধিকাংশই বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের। দরিদ্র জনগণ স্বল্প খরচে অনায়াসে এ জাতের ছাগল পালন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রাম ছাগলের চেয়ে বেশি। চিকিৎসা খরচ, বিড়ম্বনা ও মৃতু্যহারও কম। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল রাম ছাগলের অনেক আগে বয়োঃপ্রাপ্ত হয় এবং একই সময় রাম ছাগলের তুলনায় ২ থেকে ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি বাচ্চা জন্ম দেয়। ক্ষুদ্র আকারে লালনপালন সুবিধাজনক, তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে, পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের অধিকার বেশি বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাশাপাশি নারীরা সংসারে একটা সাপোর্ট দিতে পারছে। এই ছাগল বিক্রি করে যে কোনো সময় সে আয় করতে পারে। সেই বিবেচনায় ক্ষুদ্র খামারি বা দারিদ্র্য বিমোচনে বস্ন্যাক বেঙ্গল একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে ওঠছে। প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে যারা ছাগল পালন করেন বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা, এরা কিন্তু বৃহৎ অংশ ছাগল পালনের সঙ্গে জড়িত। বস্ন্যাক বেঙ্গলের মাংসটাও ভালো, চামড়াটাও ভালো। যা পৃথিবীব্যাপী এটি স্বীকৃত। বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে ছাগল পালনের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এজন্য গ্রামীণ পর্যায়ে সঠিক প্রজনন সেবা নিশ্চিত করা, ছাগল পালনে আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে খামারিদের প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী খামার স্থাপন, দক্ষ জনবল তৈরি, জনসচেতনতা সৃষ্টি, সরকারি খামারগুলো থেকে উপজেলা পর্যায়ে খামারিদের ছাগল পালনে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য বিদ্যমান সাতটি সরকারি ছাগল খামারের সংস্কার ও উন্নয়নে জন্য ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ পলস্নী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ডক্টর কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ জানান, গ্রামীণ অর্থনীতি জোরদার করতে বিশেষ করে নারীদের আয় বাড়াতে যেসব অঞ্চলে ছাগল লালনপালনের সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে ছাগল পালনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে ছাগল চাষে সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশি বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভ্যালু চেইনের মাধ্যমে মাচা পদ্ধতিতে ছাগল লালনপালন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হতদরিদ্র মানুষ স্বাবলম্বী হচ্ছে। গবাদি পশুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতিকে বদলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা করে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ২, ৩ বা ৪টি বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল লালনপালন করে গড়ে যথাক্রমে ৩৩৫০, ৪১৩০ বা ৫৪৮০ টাকা আয় করা যায়। দেশের দরিদ্র খামারি ও দুস্থ মহিলারা এ নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে ছাগল পালন করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে নিজের অবস্থার উন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। কম সময়ে দ্রম্নত আয়ের জন্য বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন পারিবারিকভাবে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে। পারিবারিকভাবে সবাই অংশগ্রহণ করে বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করতে পারে। এতে পারিবারিক আয় বাড়ে, আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, পরিবারের গোশত ও দুধের চাহিদা মেটে। পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ হয়, চামড়া রপ্তানির মাধ্যমে অধিকতর আয় বাড়ে। ছাগলের দুধ খুবই পুষ্টিকর এবং এলার্জি উপসর্গ উপশমকারী। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল অধিক বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং দেশীয় জলবায়ুতে বিশেষভাবে উৎপাদন উপযোগী। ছাগল পালনে অল্প জায়গার প্রয়োজন হয়। পরিবারের যে কোনো সদস্য দেখাশোনা করতে পারেন। শয়ন ঘরে বা রান্না ঘরে কিংবা শয়ন ঘরের পাশে সাধারণ মানের কম খরচের ঘরে রাখা যায়। দ্রম্নত বংশ বৃদ্ধি ঘটে বলে অল্প সময়ে সুফল পাওয়া যায়। সব ধর্মালম্বী লোকদের জন্য ছাগলের গোশত সমাদৃত। ছাগল পালনে অন্যান্য পশুর মতো আলাদ বিশেষ গোচারণভূমির প্রয়োজন হয় না। ক্ষেতের আইলের, রাস্তার ধারে, বাড়ির আশপাশের অনাবাদি জায়গার ঘাস লতাপাতা খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে এ প্রজাতির ছাগল। বাড়ির আঙিনার আশপাশের গাছগাছড়ার লতাপাতা ছাগলের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং অল্প পুঁজিতে লালনপালন করা যায়।