মুরগি ও ডিমের লাভের গুড় কারা খায়?

ফিড ইন্ডাস্ট্র্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি)-এর সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, কোভিড মহামারির ধকল যখন কিছুটা সহনীয় হতে শুরু করেছে ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড তৈরির কাঁচামালের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। যেহেতু ফিড তৈরির অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল ভুট্টা, সয়াবিনসহ অধিকাংশ উপকরণই আমদানিনির্ভর তাই কাঁচামালের দর বৃদ্ধি ছাড়াও জাহাজ ভাড়া ও ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। খালেদ বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খাদ্য রপ্তানিকারক দেশগুলোও রপ্তানিতে মাঝে মধ্যেই রাশ টেনে ধরছেন। তাই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে; ভর্তুকি দিয়ে হলেও চাষি ও খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ম আলতাব হোসেন
ডিম ভাজি, ডিম ভর্তা, ডিম ভুনা, ডিম পোচ, ডিমের কারি, ডিম সেদ্ধ, ডিম খিচুড়ি, ডিম পোলাও, ডিম চপ, অমলেট ও ডিমের পুডিং। ডিমের এমন কত রকমের বাহারি খাবার আছে- তার জুড়ি নেই। অথচ একডজন ডিমের দাম মগডাল ছাড়িয়ে ১৬০ টাকায় উঠেছে। ডিমের মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, ডিম এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। ডিমের বাহারি খাবার যেন অনেকের কাছে তিক্ত হয়ে উঠেছে। মজাদার এমন সুস্বাদু খাবারের কারণে প্রতি পরিবারেই রয়েছে ডিমের চাহিদা। বাজারের ফর্দে তালিকার উপরের দিকেই থাকে ডিমের নাম। সেই ডিম যেন অধরা হয়ে উঠছে। দেশে জ্বালানি তেল কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল ও অকটেনের মূল্যবৃদ্ধির পর দফায় দফায় ব্যবসায়ীরা ডিমের দামও বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্রয়লার মুরগির প্রতি ডজন ডিম বিক্রি করা হয় ১৬০ টাকায়- যা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। আমদানির খবরে এখন ডিমের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। এ দিকে ক্ষুদ্র খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, দেশে পোল্ট্রি খাতটি এখন মাফিয়া চক্রের হাতে চলে গেছে। দেশে মুরগির বাচ্চা, ডিম ও মাংসের মুরগির দাম বাড়িয়ে ভোক্তা ও ক্ষুদ্র খামারিদের কাছ থেকে ৫২০ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে পোল্ট্রি খাতের বড় কয়েকটি কোম্পানি। মাত্র গত ১৫ দিনে তারা এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. ইলিয়াস খন্দকার বলেন, কোম্পানিগুলো গত ১৫ দিনে ডিমের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করেছে ১১২ কোটি টাকা। পাশাপাশি বাচ্চার দাম বাড়িয়ে লুটে নিয়েছে ২৩৪ কোটি টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়িয়ে লুটে নিয়েছে ১৭২ কোটি টাকা। এই সিন্ডিকেটে জড়িত রয়েছে পোল্ট্রি খাতের ১০ থেকে ১২টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার জানান, দেশে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা সাড়ে চার কোটি পিস। এর মধ্যে বড় কোম্পানিগুলো এই চাহিদার আড়াই কোটি ডিম সরবরাহ করে। প্রতি ডিমে তিন টাকা করে বেশি নিয়ে প্রতিদিন সাত কোটিরও বেশি টাকা তারা অবৈধভাবে মুনাফা করেছে। এভাবে গত ১৫ দিনে বড় কোম্পানিগুলো ডিমের বাজার থেকে ১১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে, দেশের ব্রয়লার মুরগির সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এভাবে প্রতিদিন ১৯ কোটি ৫০ লাখ কেজি মজুত সংকট তৈরি করে এবং পরবর্তী সময়ে তা ছেড়ে প্রতি কেজিতে বাড়তি নিয়েছ ১৫ টাকা। এর মাধ্যমে গত ১৫ দিনে তারা ১৭২ কোটি টাকার বেশি ভোক্তার পকেট কেটেছে। এছাড়া প্রতিদিন এক কোটি ৩০ লাখ বাচ্চা বিক্রি থেকে গত ১৫ দিনে ২৩৪ কোটি টাকা অবৈধ মুনাফা করেছে। খোলা বাজারে ডিম ও মুরগির হঠাৎ মূল্য বৃদ্ধিতে ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়ায় উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করেছে পোল্ট্রি শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ডিমান্ড-সাপস্নাই গ্যাপ ও সুযোগ সন্ধানী মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা লোটার অপপ্রয়াসকে দায়ী করেছে সংগঠনটি। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বিপিআইসিসি'র সমন্বয়ে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং তৃণমূল খামারিদের সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার সঠিক বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে বিপিআইসিসি। মঙ্গলবার বিপিআইসিসি'র জরুরি বৈঠকে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৬ আগস্ট পাইকারি বাজারে মুরগির কেজিপ্রতি দর ছিল ১৩৬ টাকা। বাদামি ডিমের দর ছিল ৯.১০ টাকা ও সাদা ডিমের দর ছিল ৮.৭০ টাকা কিন্তু ওই দিন রাত ১২টার পর থেকে ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের নতুন বর্ধিত দর কার্যকর হওয়ার ঘোষণা এলে পরদিন অর্থাৎ ৭ অক্টোবর থেকে বাস-ট্রাক-পিকআপসহ পরিবহণ সংকট দেখা দেয়। অনেক মালিক পরিবহণ বন্ধ করে রাখে, অনেকে আবার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। যেহেতু ডিম ও মুরগির ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশের জোগান দেয় গ্রামীণ তৃণমূল খামারিরা, তাই পরিবহণ সংকটে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা ও বিভাগীয় শহরে ডিম ও মুরগির সরবরাহ কমে যায়, বাড়ে দাম। ১৩ ও ১৪ আগস্ট মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজিতে দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। পাইকারি পর্যায়ে বাদামি ডিম ১০.৯০ টাকায় এবং ব্রয়লার মুরগির দর ১৭০-১৭৫ টাকায় ওঠে; টিসিবি'র তথ্য অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১৩.৭৫ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি প্রতি ২০০ টাকায় উন্নীত হয়। এ দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ খামারিদের কোনো হাত নেই। পরিবহণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলে ১৫ আগস্ট থেকে দর পুনরায় কমতে শুরু করে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ব্রয়লার মুরগির পাইকারি দর প্রতি কেজিতে প্রায় ৪০-৪৫ টাকা কমে ১৩০-১৩৫ টাকায় এবং প্রতি একশ বাদামি ডিমের দর ১৩০ টাকা কমে ৯৬০ টাকায় (প্রতিটি ৯.৬০ টাকা) ও সাদা ডিম ১৪০ টাকা হ্রাস পেয়ে ৯৫০ টাকায় (প্রতিটি ৯.৫০ টাকা) বিক্রি হয়েছে। এ বিষয়ে বিপিআইসিসি সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ে এক কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে খামারির খরচ পড়ে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা এবং ডিমের খরচ নূ্যনতম ৯.৫০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড তৈরির কাঁচামালের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন, পণ্য আমদানিতে মাত্রাতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া, লোডশেডিং, ইত্যাদি কারণে ডিম ও মুরগির মাংসের উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয়টি হচ্ছে খামারিরা লোকসান গুনলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা অনায্য মুনাফা লুটছে ফলে খামারি ও ভোক্তা উভয়েই প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মসিউর আরও বলেন, গত ৬ আগস্টের আগে খামারিরা ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি গড়ে ১২৮-১৩১ টাকায় অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ১২-১৪ টাকা লোকসানে বিক্রি করলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করেছে কেজিতে ২৭-৩২ টাকা। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীরা থাকবেই- তবে লাভের পরিমাণটা যৌক্তিক হতে হবে। প্রান্তিক খামারিরা নায্যমূল্য না পেলে উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। তাই প্রান্তিক খামারিদের সুরক্ষায় সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। মসিউর বলেন, সরকারের যতগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে সেখানে মূলত: ডেইরি ও মৎস্য খাতই প্রাধান্য পেয়েছে অথচ আমিষের চাহিদা পূরণে ৪০-৫০ শতাংশ অবদানই পোল্ট্রি খাতের। ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) এর সভাপতি কাজী জাহিন হাসান বলেন, পোল্ট্রি'র সাপস্নাই সাইড দুর্বল হয়ে পড়ছে, কারণ লোকসানের ভয়ে অনেক খামারি এ পেশা ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি মাসে একদিন বয়সি সাদা ব্রয়লার বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন যেখানে ছিল ১ কোটি ৮০ লাখের ওপরে বর্তমানে তা ১ কোটি ৩০-৩৫ লাখে নেমে এসেছে। জাহিন বলেন, গত মে মাসে ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে ১৬.৬৫ টাকা ও লেয়ার বাচ্চা ২০.৭৪ টাকায়, জুন মাসে ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে ৮.০৭ টাকা ও লেয়ার বাচ্চা ১৩ টাকায়, জুলাই মাসে ব্রয়লার বাচ্চা ১৮.৭১ টাকা ও লেয়ার বাচ্চা ১৩.৯৫ টাকায় এবং আগস্ট মাসে এ পর্যন্ত ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে ২৮.০৬ টাকা ও লেয়ার বাচ্চা ৩১.৫৩ টাকায় বিক্রি হয়েছে- যেখানে গড় উৎপাদন খরচ ১৪০-১৪৫ টাকা। কাজেই দেখা যাচ্ছে ব্রিডার খামারগুলো লোকসানে বাচ্চা বিক্রি করার পরও খামারিরা বাচ্চা কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এটা উদ্বেগজনক। ফিড ইন্ডাস্ট্র্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি)-এর সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, কোভিড মহামারির ধকল যখন কিছুটা সহনীয় হতে শুরু করেছে ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড তৈরির কাঁচামালের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। যেহেতু ফিড তৈরির অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল ভুট্টা, সয়াবিনসহ অধিকাংশ উপকরণই আমদানিনির্ভর তাই কাঁচামালের দর বৃদ্ধি ছাড়াও জাহাজ ভাড়া ও ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। খালেদ বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খাদ্য রপ্তানিকারক দেশগুলোও রপ্তানিতে মাঝে মধ্যেই রাশ টেনে ধরছেন। তাই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে; ভর্তুকি দিয়ে হলেও চাষি ও খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বিপিআইসিসি সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, পোল্ট্রির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বেড়েছে কারণ তুলনামূলক কম দামে এ খাতটি উন্নতমানের প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ করে আসছে। তিনি বলেন, উৎপাদন খরচ কমিয়ে এনে কীভাবে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে ডিম ও মুরগি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো যায় সে চেষ্টাই তারা করছেন। সরকার আন্তরিকভাবেই সহযোগিতা করছেন তবে তা আরও বাড়াতে হবে। মসিউর বলেন, এমন কোনো কিছু করা ঠিক হবে না যাতে খামারি ও সরবরাহকারীদের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়। তিনি বলেন, আমরা সবাই এখন একটি সংকটকালীন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। কাঁচামালের দাম কমলে, ডলারের দর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে পরিস্থিতি আপনা আপনি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারসহ সবার সহযোগিতা চান মসিউর।