ধানক্ষেতে মাছ ও চিংড়ি চাষ লাভজনক

প্রকাশ | ২৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ম ইমরান সিদ্দিকী
ধানক্ষেতে মাছ ও চিংড়ি চাষ লাভজনক। একই জমি থেকে একই সঙ্গে ধান, মাছ ও চিংড়ি পাওয়া যায়। জমির উর্বরতা বাড়ে। বাংলাদেশে ধানক্ষেতে চিংড়ি চাষের যথেষ্ট সুযোগ সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে চার থেকে ছয় মাস পানি থাকে ৬০ থেকে ৭০ লাখ হেক্টর জমিতে। ধানক্ষেতে মাছ ও চিংড়ি চাষ করে উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। দুই পদ্ধতিতে ধানক্ষেতে মাছ ও চিংড়ি চাষ করা যায়। একই জমি থেকে একই সময়ে ধান ও মাছ দুটি ফসল পাওয়া যায়। মাছের চলাচলে ধান ক্ষেতে আগাছা ও পোকামাকড় কম হয়। মাছের বিষ্টা মাটির উবর্রতা বৃদ্ধি করে। কর্ম সংস্থান বৃদ্ধি পায়। মাছকে সম্পূরক খাদ্য দিতে হয় না। মাছের নড়াচড়াতে ধানের ফলন বৃদ্ধি পায়। বোরো, আউশ বা আমন সব মৌসুমের ধান রোপণ থেকে পাকা পর্যন্ত সাধারণত তিন মাস সময় লাগে। ফলে যাদের আবাদি জমি খুবই কম তাদের এই তিন মাস আর কোনো ফসল ফলানোর সুযোগ থাকে না। আবার অনেকের আবাদি জমি আছে কিন্তু পুকুর নেই, আবার নতুন পুকুর তৈরির মতো সামর্থ্যও নেই। তাদের জন্য সহজ সমাধান হলো ধানের জমিতেই মাছচাষ। এটি এক ধরনের সমন্বিত খামার। এ পদ্ধতিতে নাইলোটিকা, সরপুঁটি, তেলাপিয়া বা কার্প জাতীয় মাছ ও চিংড়ি চাষ করা যায়। এতে একসঙ্গে ধান ও মাছ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে জমির উবর্রতাও বৃদ্ধি পায়। গলদা চিংড়ির সঙ্গে অন্যান্য মাছও চাষ করা যায়। বছরে এ চাষ দুইবার করা যায়। হাওড় অথবা নিচু জমিতে বোরো মৌসুমে ধানের সঙ্গে গলদা চিংড়ি চাষের যথেষ্ট সুযোগ আছে। সেচ ব্যবস্থা থাকলে উঁচু জমিতেও ধানের সঙ্গে চাষ করা যায়। আমন ও বোরো এ দুই মৌসুমে দুইবার এ পদ্ধতিতে একই জমিতে ধান ও মাছচাষ করা সম্ভব। মূলত হাওড় বা নিচু জমি, যেসব জমিতে দীর্ঘ দিন পানি জমে থাকে সেসব জমিতে বোরো মৌসুমে ধানের সঙ্গে গলদা চিংড়ি চাষ করা সহজ। আর আমন মৌসুমে মাঝারি উঁচু জমিতে এভাবে মাছচাষ করা ভালো। নিচু জমিতে করলে অতিবৃষ্টির সময় মাছ ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমাদের দেশে মাছচাষ একটি লাভজনক ব্যবসা। আধুনিক প্রযুক্তি ও যথার্থ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছচাষ বাড়ানো সম্ভব। খাল, বিল, নদী, পুকুর, ডোবা প্রভৃতি জলাশয়ের সঙ্গে ধানক্ষেতে মাছচাষ করতে পারলে দেশে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে এবং অপর দিকে কৃষকও লাভবান হবে। দেশে বছরে অধিকাংশ সময় পানি থাকে বা সেচ সুবিধা আছে এমন নিচু ধানি জমিতে মাছচাষ করা যেতে পারে। এতে ধানের কোনো ক্ষতি হয় না বরং কৃষক বেশি লাভবান হয়। ধান ক্ষেতে মাটি, পানি, সার, গোবর প্রভৃতির সংমিশ্রণে প্রাকৃতিকভাবে যে খাবার তৈরি হয় তা মৎস্য উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। যেসব জমিতে সারা বছর কিংবা কমপক্ষে ৩ থেকে ৬ মাস পানি থাকে বা ধরে রাখা যায় সেসব জমিতে ধানের সঙ্গে অথবা ধানের পরে গলদা চিংড়ি চাষের উপযোগী। এঁটেল বা দোআঁশ মাটির ধানক্ষেত সবচেয়ে ভালো। জমি বন্যামুক্ত হতে হবে। ধানক্ষেতের কাছাকাছি পানি সরবরাহ ও নির্গমন ব্যবস্থা থাকতে হবে। ধানক্ষেতের কাছাকাছি পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। উত্তরবঙ্গের অনেক ধানি জমি এভাবে ধান ও মাছ সমন্বিত চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ধানের জমিতে চিংড়ি মাছচাষ করা যায়। এ ধরনের চাষকে সমন্বিত চিংড়ির চাষ বলা হয়। এই চাষে ধানের জমিতে চিংড়ি, ধান ও শাকসবজি একসঙ্গে চাষ করা হয়। এই ধরনের চাষে জমির চারপাশে উঁচু আল তৈরি করে এর ভেতরে ড্রেনের মতো তৈরি করে তাতে জল জমিয়ে রেখে চিংড়ি মাছের চাষ করা হয় আর জমির সমতল জায়গায় ধান ও শাকসবজি চাষ করা হয়। ধানের জমির আইল শক্ত, মজবুত ও উঁচু করতে হবে। আগে থেকে আইল বাঁধা থাকলে তা মেরামত করে নিতে হবে। জমিরতলা সমতল করতে হবে। সাধারণ বন্যায় যে পরিমাণ পানি হয় তার চেয়ে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার উঁচু করে আইল তৈরি করা উচিত। মাছ ও গলদা চাষের জন্য পানির গভীরতা চাষ এলাকায় কমপক্ষে ১ মিটার হলে ভালো হয়। আইলের পাশে গোড়ার দিকে ৫০ সেন্টিমিটার এবং ওপরের দিকে ৩০ সেন্টিমিটার। জমির ঢালুর দিকে গর্ত বা ডোবা খনন করা উত্তম। মোট জমির শতকরা ১৫ ভাগ এলাকায় ডোবা ও নালা করতে হয়। ডোবা বা নালার গভীরতা ৫০-৬০ সেন্টিমিটার হলে ভালো হয়। ডোবার সঙ্গে নালার সংযোগ থাকতে হবে। আইল থেকে নালা ১২০ সেন্টিমিটার দূরে থাকবে। নালার প্রশস্ত এবং হেলানোভাবে ঢালু করে কাটতে হবে। মাছ বেশির ভাগ সময় এসব নিচু এলাকায় থাকবে এবং রাতে খাদ্য গ্রহণকালে কম পানি এলাকায় চলে আসবে। এ সব নিচু এলাকায় বা খালে পর্যাপ্ত পরিমাণে আশ্রয় স্থান তৈরি করে দিতে হবে। বর্ষার সময় ক্ষেত থেকে অতিরিক্ত পানি বের করার জন্য আইলের এক বা একাধিক স্থানে নির্গমন নালা রাখতে হবে। তলা থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে এ নালা করলে ক্ষেতে প্রয়োজন পরিমাণ পানি থাকবে। নির্গমন নালায় ৫ ইঞ্চি পস্নাস্টিকের পাইপ বসিয়ে পাইপের মুখে তারের জাল দিতে হবে- যাতে মাছ ও চিংড়ি বের না হতে পারে। ক্ষেতে ধান রোপণের ২০-২৫ দিন পর চিংড়ির পোনা ছাড়া হয়। জমিতে ধানের চারা লেগে গিয়ে বেশ কিছুটা বেড়েছে এমন পর্যায়ই পোনা ছাড়া উপযুক্ত সময়। কারণ খালি বা খোলা জমিতে পোনা না ছাড়াই ভালো। জমিতে পোনা ছাড়ার সবচেয়ে ভালো সময় সকাল ও বিকাল বেলা। যে পাত্রে পোনা আনা হয় তা ক্ষেতের পানিতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পর যখন ক্ষেতের ও পাত্রের পানির তাপমাত্রা সমান হয় তখন পাত্রটি কাত করে আস্তে আস্তে পোনা ছাড়তে হবে। তাহলে পোনাগুলো তাপে কোনো আকস্মিক পরিবর্তনের শিকার হবে না। ধানক্ষেতের বিভিন্ন পরিচর্যা, যেমন- আগাছা দমন, ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ, পর্যায়ক্রমে জমি শুকানো ও ভিজানো কাজগুলো প্রচলিত পদ্ধতিতে করা যায়। সারের উপরিপ্রয়োগের সময় যেন পরিখা বা গর্তে পানি থাকে, কিন্তু জমিতে বেশি পানি না থাকে এটা খেয়াল রাখতে হবে। ধান পাকা শুরু হলে ক্ষেতের পানি ধীরে ধীরে কমাতে হবে। এতে মাছ ও চিংড়িগুলো পরিখা বা গর্তে গিয়ে আশ্রয় নেবে। তখন প্রথমে ধান কেটে পরে চিংড়ি ধরতে হবে। কোনো কারণে ধান পাকার আগেই পানি শুকাতে শুরু করলে, ধান কাটার আগেও মাছ ও চিংড়ি ধরা যায়। আবার সুযোগ থাকলে এবং মাছ ও চিংড়ি বিক্রির আকারে না পৌঁছলে অর্থাৎ প্রতিটি যথাক্রমে ১০০ ও ৩৫ গ্রাম ওজনের না হলে ধান কাটার পরও মাছ ও চিংড়ি ক্ষেতে রেখে বড় করে নেয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আবার পানি দিতে হবে। ধানক্ষেতে মাছ ও চিংড়ি চাষে কোনো বাড়তি খাবার না দিলেও চলে। মাছ ও চিংড়ি ধানক্ষেতের শ্যাওলা, পোকামাকড়, কীড়া ও পচনশীল দ্রব্যাদি খেয়ে থাকে। তবে কিছু খাবার প্রয়োগ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর জন্য শুরুতে চালের কুঁড়া ও গোবর ১ ও ৩ অনুপাতে মিশিয়ে হেক্টরপ্রতি ১০ কেজি পরিমাণে প্রতি ৭ দিন পরপর গর্তে দিতে হবে। মাছ ছাড়ার কিছু দিন পর মাছ বড় হলে অথবা জুন-জুলাই মাসে ক্ষেতের পানি কমে গেলে বেড় জাল দিয়ে সব মাছ আহরণ করা উচিত। সঠিকভাবে মাছচাষ করলে প্রতি একরে ৩শ' থেকে ৪শ' কেজি মাছ পাওয়া যেতে পারে। মাছ বিক্রি করলে ধানের চেয়ে মাছ থেকে বেশি আয় হবে।