বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাল্টা বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ফল

বরিশাল বিভাগে বিপুল সম্ভাবনাময় রসালো ফল মাল্টার আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। গত কয়েক বছরে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীর বেশ কিছু এলাকায় ভিটামিন সিসমৃদ্ধ এ ফলের আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। পারিবারিক পর্যায়ের বাইরে এখন বাণিজ্যিকভাবেও বিভিন্ন স্থানে মাল্টার আবাদ হচ্ছে। তবে এ অঞ্চলে ভালো জাত ও মানের মাল্টার কলম বা চারা সরবরাহ এখনো সহজলভ্য নয়। অথচ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে 'বারি মাল্টা-১' ও 'বারি মাল্টা-২' নামের দুটি উন্নতমানের মাল্টা'র জাত উদ্ভাবন করেছে
ম নাহিদ বিন রফিক
  ২৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ও সম্ভাবনাময় একটি ফল মাল্টা। শিশু হতে বৃদ্ধ সবাই কমবেশি মাল্টা খেতে পছন্দ করে। মাল্টা সাইট্রাস পরিবারভুক্ত একটি বিদেশি ফল। কমলা আর বাতাবি লেবুর সংকরায়ণে এ ফলের সৃষ্টি। এর ইংরেজি নাম সুইট অরেঞ্জ। হিন্দিতে সান্তারা। অন্য ভাষায় ভিন্ন নাম। এর আদি উৎপত্তিস্থল ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত। রোগীর পথ্য হিসেবে মাল্টা হিতকর। খেতে সুস্বাদু। দারুণ সুঘ্রাণ। মাল্টায় পুষ্টিতে ভরপুর।

মাল্টা সাইট্রাস পরিবারভুক্ত একটি বিদেশি ফল। এর ইংরেজি নাম সুইট অরেঞ্জ। হিন্দিতে সান্তারা। অন্য ভাষায় ভিন্ন নাম। এর আদি উৎপত্তিস্থল ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত। রোগীর পথ্য হিসেবে মাল্টা হিতকর। খেতে সুস্বাদু। দারুণ সুঘ্রাণ। মাল্টায় পুষ্টিতে ভরপুর। পুষ্টিবিদদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে (আহারোপযোগী) ২০০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি আছে প্রায় ৫০ মিলিগ্রাম। অন্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে শর্করা, আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন বি ১, ভিটামিন বি২ এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে যথাক্রমে ১২ মিলিগ্রাম, ০ দশমিক ২ মিলিগ্রাম, ৪০ মিলিগ্রাম, ০ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম, ০ দশমিক ১১৩ মিলিগ্রাম, ০ দশমিক ০৪৬ মিলিগ্রাম এবং ২০০ কিলোক্যালরি।

এতে কিছু ঔষধিগুণও আছে। সর্দিজ্বর কমাতে মাল্টা বেশ উপকারি। এর খোসা দিয়ে প্রসাধনী তৈরি হয়। এছাড়া ওষুধশিল্পেও ব্যবহার হয়। বিশ্বভুবনে ফলটি বেশ জনপ্রিয়। তেমনি এ দেশেও। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, কমলা লেবুর তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশি। তাই চাষের জন্য পাহাড়ি এলাকা উৎকৃষ্ট। তবে হালকা লবণমাটিতে এর মিষ্টতা এবং ফলন ভালো। এমনি প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় পিরোজপুর সদরের বেশ ক'টি গ্রামে। ওখানে ছোট-বড় তিন শতাধিক বাগান রয়েছে। মৌসুমে থোকায় থোকায় ধরা ফলগুলো দেখলে কার না ভালো লাগে! শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, প্রচুর মিষ্টি এবং রসালো। এসব গুণের কথা শুনে দখিনের অন্য জেলাগুলোতেও নতুন নতুন বাগান স্থাপন হচ্ছে। এভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। তাই বলতেই হয়; মাটি, পানি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাংলাদেশে মাল্টা চাষে রয়েছে বিরাট সম্ভাবনাময়।

বরিশাল বিভাগে বিপুল সম্ভাবনাময় রসালো ফল মাল্টার আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। গত কয়েক বছরে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীর বেশ কিছু এলাকায় ভিটামিন সিসমৃদ্ধ এ ফলের আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। পারিবারিক পর্যায়ের বাইরে এখন বাণিজ্যিক ভাবেও বিভিন্ন স্থানে মাল্টার আবাদ হচ্ছে। তবে এ অঞ্চলে ভালো জাত ও মানের মাল্টার কলম বা চারা সরবরাহ এখনো সহজলভ্য নয়। অথচ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে 'বারি মাল্টা-১' ও 'বারি মাল্টা-২' নামের দুটি উন্নতমানের মাল্টা'র জাত উদ্ভাবন করেছে।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাত রয়েছে। তবে এ দেশে চাষ উপযোগী জাতের মধ্যে বারি মাল্টা-১ অন্যতম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত এ জাতটি উচ্চ ফলনশীল। গাছের ডালপালা ছড়ানো এবং ঝোপানো থাকে। মধ্য ফাল্গুন (মার্চ) থেকে মধ্য চৈত্রে (এপ্রিল) ফুল আসে। ফল পাকে কার্তিক মাসে। ফল দেখতে সবুজ। তবে পরিপক্ক অবস্থায় কিছুদিন রেখে দিলে কমলারঙ ধারণ করে। ফলের নিচে ছোট গোলাকার চিহ্ন থাকে। প্রতিটির ওজন প্রায় ১শ' ৫০ গ্রাম। ফলের শাঁসের রং হালকা হলুদ। গাছপ্রতি ফল ধরে ৩শ' থেকে ৪শ'। সে হিসাবে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ২০ টন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাত উদ্ভাবন করেছে। নাম এফটিআইপি বাউ মাল্টা-১। প্রতিটি ফলের ওজন ১শ' ৭০ হতে ২শ' গ্রাম পর্যন্ত। মিষ্টতা ১৭-২১ টিএসএস। গাছ বামনাকৃতি। বিচি কম হয়। ফল রসালো ও মিষ্টি। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফল পাকে।

বীজ ও অঙ্গজ উভয় পদ্ধতিতে মাল্টার বংশ বিস্তার হয়। তবে মাতৃগুণ বজায় রাখা, দ্রম্নত ফল ধরা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং অধিক ফলন পেতে অঙ্গজ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। জোড়কলম (গ্রাফটিং) ও চোখকলমের (বাডিং) মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়। জোড়কলমের জন্য রুটস্টক (আদিজোড়) নির্বাচন করতে হয়। এক্ষেত্রে বাতাবি লেবুর চারা ব্যবহার উত্তম। এরপর মাতৃগাছ হতে সায়ন (উপজোড়) সংগ্রহ করে রুটস্টকের ওপর স্থাপন করে গ্রাফটিং তৈরি করা হয়। আদিজোড়ের জন্য এক থেকে দেড় বছরের সুস্থ, সতেজ এবং সোজা চারা বেছে নিতে হবে। সায়নে অবশ্যই কমপক্ষে দু'টি চোখসহ ২-৩ ইঞ্চি লম্বা থাকা চাই। এছাড়া ডালের বয়স যেন ৮-৯ মাস হয়। সাধারণত ১০-১২ দিন পর সংযোগস্থলে জোড়া লাগে। তখন সায়নের সুপ্তকুঁড়ি থেকে পাতা বের হয়। একাধিক ডাল বের হলে ভালোটি রেখে বাকিগুলো কেটে দিতে হবে। কলমের নিচের অংশে কোনো কুঁড়ি বা ডাল যেন না থাকে। মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য ভাদ (মে-আগস্ট) গ্রাফটিং করার উপযুক্ত সময়।

চারা অবশ্যই মানসম্মত হওয়া চাই। চাষাবাদের ক্ষেত্রে অন্য সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হলো, কিন্তু জাত নির্বাচন করতে ভুল হলো। তাহলে কাঙ্ক্ষিত ফলন হবে না। তাই নিশ্চিত হয়েই চারা ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান হর্টিকালচার সেন্টার এবং বেসরকারি বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে সংগ্রহ করা উত্তম। এছাড়া কিছু সফল কৃষক আছেন যারা বাগানের পাশাপাশি চারাও উৎপাদন করেন।

পরিপক্ব অবস্থায় মাল্টা সংগ্রহ করতে হয়। সংগ্রহের সময় ফল যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ফলের আকার অনুযায়ী গ্রেডিং করা উত্তম। পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে প্যাকেট করে বাজারজাত করতে হবে। 'ফল খাই বল পাই' এ কথা সবাই জানি। তারপরও প্রয়োজনমতো খাওয়া হয় না। অসচেতনতা আর প্রাপ্তির অভাবই এর কারণ। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ আছে। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছে শক্তি এবং পরিকল্পনা। আপনার পছন্দমতো যে কোনো ফল বাগান তৈরি করতে পারেন। চাষাবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পাশে আছেন উপজেলা কৃষি অফিসার, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। তাই আসুন, প্রতিটি বসতবাড়িতে অন্য ফলের পাশাপাশি দু'চারটি হলেও মাল্টার গাছ লাগাই। এ ব্যাপারে অপরকেও করি উৎসাহিত।

লেখক: টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস এবং পরিচালক, কৃষি বিষয়ক আঞ্চলিক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ বেতার, বরিশাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে