শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ

দেশে মোট ফসলি জমির প্রায় ৭৬ শতাংশ জমিতে ধান চাষ করা হয়। এর প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতেই আধুনিক জাতের ধান চাষ করা হচ্ছ। বর্তমানে দেশে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করা হচ্ছে। স্থানীয় জাতের তুলনায় এসব জাতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়। এসব আধুনিক জাতের ভালো ফলন পাওয়ার জন্য স্থানীয় জাতের তুলনায় বেশি সার ও সেচ দিতে হয়। এজন্য পোকামাকড়ের আক্রমণও বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৫ সালে এ দেশে ধানের জন্য ক্ষতিকর ১৭৫ প্রজাতির পোকাকে শক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে ২৬৬টি প্রজাতির পোকাকে ধানের ক্ষতিকর পোকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে সব পোকা সব মৌসুমে বা সব জায়গার ধান ফসলে ক্ষতি করে না। ২০ প্রজাতির পোকাকে ধান ফসলের সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিকর পোকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে মাজরা, পামরি, বাদামি গাছ ফড়িং ধানের প্রধান তিনটি ক্ষতিকারক পোকা
ম আলতাব হোসেন
  ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

ধানে মাজরা পোকা, পামরি পোকা, গান্ধিপোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, শীষকাটা লেদা পোকা, বাদামি ঘাস ফড়িং, পাতা মোড়ানো পোকা ক্ষতি করে বেশি। এসব পোকা দমনে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে। সচরাচর ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক কীটনাশক। প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার টন কীটনাশক ধান রক্ষায় কৃষকরা জমিতে প্রয়োগ করে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে কীটনাশকের আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৫৬৩ টন। ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণে আউশ মৌসুমে ২৪ শতাংশ, আমনে ১৮ শতাংশ এবং বোরোতে ১৩ শতাংশ ধানের উৎপাদন কমে যায়।

কৃষকরা ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে ধানকে রক্ষার জন্য নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। প্রতি মৌসুমে কৃষকরা মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, পামরি পোকা, বাদামি ঘাস ফড়িং ও গান্ধিপোকা দমনের জন্য গড়ে তিন থেকে চারবার ধানের জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। কীটনাশক প্রয়োগে একদিকে যেমন মাটি, পানি ও বায়ু বিষাক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

দেশে মোট ফসলি জমির প্রায় ৭৬ শতাংশ জমিতে ধান চাষ করা হয়। এর প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতেই আধুনিক জাতের ধান চাষ করা হচ্ছ। বর্তমানে দেশে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করা হচ্ছে। স্থানীয় জাতের তুলনায় এসব জাতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়। এসব আধুনিক জাতের ভালো ফলন পাওয়ার জন্য স্থানীয় জাতের তুলনায় বেশি সার ও সেচ দিতে হয়। এজন্য পোকামাকড়ের আক্রমণও বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৫ সালে এ দেশে ধানের জন্য ক্ষতিকর ১৭৫ প্রজাতির পোকাকে শক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে ২৬৬টি প্রজাতির পোকাকে ধানের ক্ষতিকর পোকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে সব পোকা সব মৌসুমে বা সব জায়গার ধান ফসলে ক্ষতি করে না। ২০ প্রজাতির পোকাকে ধান ফসলের সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিকর পোকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে মাজরা, পামরি, বাদামি ঘাস ফড়িং ধানের প্রধান তিনটি ক্ষতিকারক পোকা।

তিন ধরনের মাজরা পোকা বাংলাদেশের ফসলের ক্ষতি করে। যেমন- হলুদ মাজরা। কালো মাথা মাজরা এবং গোলাপি মাজরা। মাজরা পোকা কান্ডের ভেতরে থেকে খাওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গাছের ডিগ পাতার গোড়া খেয়ে কেটে ফেলে। ফলে পাতা মারা যায়। ক্রিসেক রোগের অথবা ইঁদুরের ক্ষতির নমুনার সঙ্গে মাঝে মাঝে মাজরা পোকা দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতকে মরা ডিগ বলে। মরা ডিগ টান দিলেই সহজে উঠে আসে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত গাছের কান্ডে মাজরা পোকা খাওয়ার অস্বাভিক ছিদ্র এবং খাওয়ার জায়গায় পোকার মল দেখতে পাওয়া যায়।

ধানের শীষ আসার পর মাজরা পোকা ক্ষতি করলে সম্পূর্ণ শীষ শুকিয়ে যায়। খরায় বা ইঁদুরের ক্ষতির নমুনা হোয়াইট হেডের মতো দেখা যেতে পারে। কিড়া যদি পাতার খোলের ভেতরে খায় এবং কান্ডের ভেতরের অংশ সম্পূর্ণভাবে কেটে না দেয় তাহলে ধানগাছের আংশিক ক্ষতি হয় এবং শীষের গোড়ার দিকের কিছু ধান চিটা হয়ে যায়।

মাজরা পোকার আক্রমণ হলে, কান্ডের মধ্যে কিড়া, তার খাওয়ার নিদর্শন ও মল পাওয়া যায়, অথবা কান্ডের বাইরের রং বিবর্ণ হয়ে যায় এবং কিড়া বের হয়ে যাওয়ার ছিদ্র থাকে। গাছে মাজরা পোকার ডিমের গাদা দেখলে বুঝতে হবে গাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হলুদ মাজরা পোকা পাতার ওপরের অংশে ডিম পাড়ে এবং গোলাপি মাজরা পোকা পাতার খোলের ভেতরের দিকে ডিম পাড়ে। হলুদ মাজরা পোকার ডিমের গাদার ওপর হালকা ধূসর রঙের একটা আবরণ থাকে। কালোমাথা মাজরা পোকার ডিমের গাদার ওপর মাছের আঁশের মতো একটা সাদা আবরণ থাকে, যা ডিম ফোটার আগে ধীরে ধীরে গাঢ় রং ধারণ করে।

মাজরা পোকার কিড়াগুলো ডিম থেকে ফুটে বের হওয়ার পর আস্তে আস্তে কান্ডের ভেতরে প্রবেশ করে। নিয়মিতভাবে ক্ষেত পর্যবেক্ষণের সময় মাজরা পোকার মথ ও ডিম নষ্ট করে ফেললে মাজরা পোকার সংখ্যা ও ক্ষতি অনেক কমে যায়। থোড় আসার পূর্ব পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মথ ধরে ধ্বংস করা যায়। ক্ষেতের মধ্যে ডালপালা পুঁতে পোকা খেকো পাখির বসার সুযোগ করে দিলে এরা পূর্ণবয়স্ক মথ খেয়ে এদের সংখ্যা কমিয়ে ফেলে। মাজরা পোকার পূর্ণ বয়স্ক মথের প্রাদুর্ভাব যখন বেড়ে যায় তখন ধান ক্ষেত থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরে আলোক ফাঁদ বসিয়ে মাজরা পোকার মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা যায়।

গলমাছি বা নলিমাছি পোকার আক্রামণের ফলে ধান গাছের মাঝখানের পাতাটা পেঁয়াজ পাতার মতো নলাকার হয়ে যায়। গাছের মাঝখানের পাতাটা গল বা পেঁয়াজ পাতার মতো হয়ে যায়। তারই গোড়ায় বসে গলমাছি কিড়াগুলো খায়।

পাতা মাছির কিড়া ধান গাছের মাঝখানের পাতা থেকে পুরোপুরি বের হওয়ার আগেই পাতার পাশ থেকে খাওয়া শুরু করে, ফলে ওই অংশের কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মাঝখানের পাতা যত বাড়তে থাকে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ততই স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। পাতা মাছির এই ধরনের ক্ষতির ফলে কুশি কম হয় এবং ধান পাকতে বাড়তি সময় লাগতে পারে।

পূর্ণবয়স্ক পামরি পোকার গায়ের রং কালো এবং পিঠে কাঁটা আছে। পূর্ণবয়স্ক ও তাদের কিড়াগুলো উভয়ই ধান গাছের ক্ষতি করে। পূর্ণবয়স্ক পামরি পোকা পাতার সবুজ অংশ কুরে কুরে খাওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাতার ওপর লম্বালম্বি কয়েকটি সমান্তরাল দাগ দেখতে পাওয়া যায়। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেতের পাতাগুলো শুকিয়ে পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হয়। এরা পাতার উপরের সবুজ অংশ এমনভাবে খায় যে, শুধু নিচের পর্দাটা বাকি থাকে।

লেদা পোকা কেটে কেটে খায় বলে ইংরেজিতে এদের কাটওয়ার্ম বলে। এই প্রজাতির পোকারা সাধারণত শুকনো ক্ষেতের জন্য বেশি ক্ষতিকর। এদের জীবন চক্র শেষ করার জন্য শুকনো জমির দরকার হয়। প্রথমাবস্থায় কিড়াগুলো শুধু পাতাই খায়, আর বয়স্ক কিড়া সম্পূর্ণ পাতাই খেয়ে ফেলতে পারে। এরা চারা গাছের গোড়াও কাটে।

পূর্ণ বয়স্ক ঘাসফড়িং ও বাচ্চা উভয়ই ধান গাছের ক্ষতি করে থাকে। এরা ধানের পাতার পাশ থেকে শিরা পর্যন্ত খায়। ঘাসফড়িংয়ের বিভিন্ন প্রজাতি এক সঙ্গে অনেক সংখ্যায় ক্ষেত আক্রমণ করে। তাদের ইংরেজিতে লোকাস্ট এবং বাংলায় পংগপাল বলা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে