শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালানি সংকটে বিদু্যৎ উৎপাদনে বিকল্প হতে পারে নবায়নযোগ্য শক্তি

ম প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন শাওন
  ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাড়ছে বিদু্যৎ উৎপাদনের খরচ। দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। খরচ কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব বাড়ছে। জোর দেওয়া হচ্ছে প্রাকৃতিক উৎস- সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, শহরে বর্জ্য ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে বিদু্যৎ উৎপাদনে। ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য শক্তি হবে বিদু্যতের প্রধান উৎস ও চালিকাশক্তি।

বাংলাদেশে ১৪৬টি পাওয়ার পস্ন্যান্ট এবং অন্যান্য উৎস থেকে বিদু্যৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে মাত্র ৭৭৬ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে উৎপাদন সক্ষমতা তিন শতাংশের মতো। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এমন এক শক্তির উৎস- যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে এগিয়ে যাচ্ছে। জলবাযু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। এতে নবায়নযোগ্য শক্তি দিনের পর দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিবেশবান্ধব শক্তি এবং কার্বন নিঃসরণমুক্ত উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আন্তর্জাতিক চাপে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, রাশিয়া ও ভারত বিশ্বের সব থেকে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশ্বের সব থেকে বড় জলবিদু্যৎ কেন্দ্র রয়েছে চীনে। বর্তমানে ভারতে পৃথিবীর সব থেকে বড় সোলার পাওয়ার পস্ন্যান্ট রয়েছে- যা ৬৪৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি হবে আগামীর চালিকাশক্তি।

বিদু্যৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে তিন শতাংশ বিদু্যৎ উৎপাদন করে, যেখানে ভারত উৎপাদন করে তার মোট বিদু্যৎ উৎপাদন ক্ষমতার ২৪ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা প্রায় ৯০ হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াট। অন্যদিকে, পাকিস্তানের মোট বিদু্যৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৭ হাজার ৪০২ মেগাওয়াটের বিপরীতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাঁচ শতাংশ (এক হাজার ৮৭০ মেগাওয়াট) উৎপাদন করে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো বিদু্যতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ঝুঁকছে। বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়; পাশাপাশি রয়েছে বায়োগ্যাস ও বায়োমাস। এছাড়া বাংলাদেশে বায়ু বিদু্যতের সম্ভাবনাও বেশ ভালো। পানি থেকে বিদু্যৎ, সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌর বিদু্যৎ, বায়ু বিদু্যৎ পৌর বর্জ্য থেকে বিদু্যৎ, গোবর ও পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস। আরও সম্ভাবনার জায়গা হলো বাতাসের গতি, ধানের তুষ, আখের ছোবড়া, বর্জ্য, শিল্ট প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদু্যৎ ও জ্বালানি উৎপাদন।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস, যেমন- সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, ভূ-তাপ, সমুদ্রতরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ জোয়ারভাটা, শহরের ময়লা-আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সভ্যতার বিদু্যৎ ও জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এত দিন ব্যবহার করে আসা জীবাশ্ম জ্বালানির বিপরীতে নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমানে বিশ্বে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অধিকাংশ দেশ তাদের বিদু্যৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদু্যৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ উলেস্নখযোগ্য হারে কমানোর জন্যই মূলত এই উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। এই উৎপাদনের অর্ধেক অর্থাৎ ২ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট আসবে সৌরশক্তি থেকে। পানি ও বায়ুর ব্যবহার করে উৎপাদন হবে যথাক্রমে ১ হাজার ও ৫৯৭ মেগাওয়াট বিদু্যৎ।

আশির দশকে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) কর্তৃক সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকলের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচির কারণে এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানির ব্যবহার এবং এর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সরকার টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) অ্যাক্ট-২০১২ প্রণয়ন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদু্যৎ, বায়োমাস, বায়োফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর স্রোত, সমুদ্রের ঢেউ প্রভৃতিকে শনাক্ত করেছে। ২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার পস্ন্যান (পিএসএমপি) নবায়নযোগ্য শক্তির শেয়ারের ক্ষেত্রে ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদু্যৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

সাসটেইনেবল রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথোরিটির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন হচ্ছে মোটে ৯০৯ দশমিক ১৯ মেগাওয়াট- যা দেশে মোট উৎপাদিত বিদু্যতের সাড়ে ৩ শতাংশের কিছু বেশি। এর মধ্যে শুধু সৌরশক্তি থেকেই উৎপাদন হচ্ছে ৬৭৫ দশমিক ২ শতাংশ বা মোট নবায়নযোগ্য জ্বালানির ৭৪ শতাংশ। এছাড়া বায়ু থেকে আসছে ২ দশমিক ৯ শতাংশ, হাইড্রো থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে দশমিক ৬৯ শতাংশ ও বায়োমাস থেকে দশমিক ৪ শতাংশ।

স্রেডার তথ্য অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য এ পর্যন্ত মোট ৪০টির অধিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগই গৃহীত হয়েছে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের ২৫ জেলায় স্থাপিত সোলার পার্ক থেকে মোট ২ হাজার ১১০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় ৭ দশমিক ৪ মেগাওয়াট, পঞ্চগড় সদর উপজেলায় আট, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ২০ ও জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার তিন মেগাওয়াট সক্ষমতার চারটি সোলার পার্কের কাজ শেষ হয়েছে। এর বাইরে ময়মনসিংহে নির্মিত দেশের বৃহত্তম সোলার পার্ক উৎপাদনে এসেছে।

সৌরবিদু্যতের জন্য বাংলাদেশ বেশ উপযুক্ত, কারণ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় ১১ ঘণ্টা পরিষ্কার সূর্যের আলো পাওয়া যায়। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিদু্যৎ সরবরাহের জন্য সৌর হোম সিস্টেম, যাকে সংক্ষেপে এসএইচএস বলা হয়। এগুলো পাওয়ার গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টিএসএইচএস স্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রম্নত বর্ধনশীল সৌর হোম সিস্টেম কার্যক্রম হিসেবে অভিহিত করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি হবে আগামীর মূল চালিকাশক্তি ও আধার।

বর্তমান সময়ে নবায়নযোগ্য শক্তির একটি বড় অংশের ব্যবহারকারী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। তারা বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে আলোকিত করছে গ্রামগুলোকে। বিদু্যৎ উৎপাদনের বিকল্প উৎসগুলো, দেশীয় বিদু্যৎ খাতকে উন্নয়নের পথে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। মূলত নবায়নযোগ্য শক্তি বলতে যে শক্তিকে বারবার ব্যবহার করা যায় এবং ব্যবহারের পরও নিঃশেষ হয়ে যায় না, এমন সব উৎসকে বোঝায়। বর্তমান সময়ে দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে বিদু্যৎ সুবিধা ভোগ করছে। এখন ঘরে বসে সহজেই বানিয়ে ফেলা যায় সোলার প্যানেল। যেখানে খরচ তেমন বেশি হয় না, পাশাপাশি এটি একটি সুবিধাজনক পদ্ধতি। প্যানেল স্থাপনে প্রতি ওয়াটে খরচ হয় ৬০-৭০ টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই দেশকে ঘিরে জালের মতো অসংখ্য নদী বিস্তার করে আছে। পানির প্রবাহ বা স্রোতকে কাজে লাগিয়ে জলবিদু্যৎ উৎপাদন করে বিদু্যৎ চাহিদার কিছুটা অংশ পূরণ করা সম্ভব। এ ছাড়া বিভিন্ন পচনশীল পদার্থ ব্যবহার করে আমরা গ্যাস কিংবা জ্বালানি পেতে পারি। গৃহস্থালিতে পরিত্যক্ত পচনশীল বর্জ্য, গোবর প্রাণীর মলমূত্র, কৃষিজ ফসলের অবশিষ্টাংশ বাতাসের অনুপস্থিতিতে গাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়োগ্যাস নামে এক ধরনের জ্বালানি গ্যাস তৈরি করা সম্ভব। বায়ুশক্তির সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে বিদু্যৎ উৎপাদন করা যায়। বাইরের দেশগুলোতে বায়ুর সাহায্যে বিদু্যৎ উৎপাদন প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রতি বছর বিদু্যৎ উৎপাদন ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই প্রকল্পটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিদু্যৎ উন্নয়ন খাতকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। নগরায়ন ও শিল্পায়নের দ্রম্নত সম্প্রসারণের সুবাদে বাংলাদেশের বড় শহরগুলো পৌর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে পৌর বর্জ্য হতে পারে অন্যতম উৎস।

বর্তমানে জ্বালানি সংকটের সময় বিদু্যতের চাহিদা পূরণে অবদান রাখছে সৌরবিদু্যৎ। কারখানার ছাদে বসানো সোলার প্যানেলের মাধ্যমে পাওয়া বিদু্যতে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ অনেক উদ্যোক্তাই। এছাড়া সেচ মৌসুমে কম খরচে ক্ষেতে পানি দেয়ার ক্ষেত্রেও ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সৌরবিদু্যৎ চালিত সোলার পাম্প, যা কৃষি অর্থনীতিতে খুলে দিচ্ছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি যেহেতু সীমিত, তাই ভবিষ্যতের জ্বালানি ব্যবস্থা নির্ভর করবে ন

বায়নযোগ্য শক্তির উপর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে