শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আনারস চাষে স্বাবলম্বী অনেকে

ম সাজ্জাদ হোসেন শাওন
  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

আনারস একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফল। বাণিজ্যিক ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে আনারসের আবাদকৃত জমির পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার হেক্টর এবং বছরে প্রায় তিন কোটি টন উৎপাদন হয়ে থাকে। আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও উন্নত জাতের আনারস চাষ করলে ফলন অনেক বেশি হয়। আনারস হেক্টরপ্রতি ১০ থেকে ১২ টন, হানিকুইন ২৫ থেকে ৩০ টন, জায়েন্ট কিউ ৩০ থেকে ৪০ টন পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে। দেশে বেশ কয়েকটি জাতের আনারস চাষ হয়। এসব জাতের মধ্যে হানিকুইন অন্যতম। এটি সবচেয়ে মিষ্টি আনারস। পাকা আনারসের শাঁস হলুদ রঙের হয়ে থাকে। জায়েন্টকিউ জাতের আনারসও বেশ ভালো। এর গাছের পাতা সবুজ ও প্রায় কাঁটাবিহীন। পাকা আনারস সবুজাভ ও শাঁস হালকা হলুদ হয়ে থাকে।

আনারস একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসলও বটে। পুষ্টিগুণের দিক থেকেও আনারস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আনারস পুষ্টির বেশ বড় একটি উৎস। আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস। এসব উপাদান আমাদের দেহের পুষ্টির অভাব পূরণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন অল্প পরিমাণে আনারস খেলে দেহে এসব পুষ্টি উপাদানের অভাব থাকবে না। আনারস পাহাড়ি অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য বেশি উপযোগী। আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, মধুপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, কুমিলস্না, দিনাজপুর, নরসিংদী জেলায় প্রচুর পরিমাণে আনারসের চাষ হয়। পুষ্টিমানের দিক দিয়েও আনারসের গুরুত্ব অপরিসীম। আনারস ভিটামিন এ, বি, ও সি-এর সেরা উৎস। বসতবাড়ির আশপাশে খালি জায়গাতেও আনারস চাষ করে সহজেই পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যায়।

আনারস অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। টিনজাত খাদ্য হিসেবে আনারস সংরক্ষণ করা যায়। আনারস ফল হিসেবে খাওয়ার পাশাপাশি আনারস দিয়ে জ্যাম, জেলি ও জুস তৈরি করা যায়। আনারস চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় করা সম্ভব। এ ছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। আনারস আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি করতে বেশ কার্যকরী। আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ম্যাংগানিজ। ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ম্যাংগানিজ হাড়কে করে তোলে মজবুত। প্রতিদিনের খাবার তালিকায় পরিমিত পরিমাণ আনারস রাখলে হাড়ের সমস্যাজনিত যে কোনো রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। শুনতে বেশ অবাক লাগলেও আনারস ওজন কমানোয় বেশ সাহায্য করে। কারণ আনারসে প্রচুর ফাইবার রয়েছে এবং অনেক কম ফ্যাট। সকালের যে সময় ফলমূল খাওয়া হয় সে সময় আনারস এবং সালাদে আনারস ব্যবহার অথবা আনারসের জুস অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।

আনারসে রয়েছে বেটা ক্যারোটিন। প্রতিদিন আনারস খেলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এতে সুস্থ থাকে আমাদের চোখ। আনারসের ক্যালসিয়াম দাঁতের সুরক্ষায় কাজ করে। মাড়ির যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন আনারস খেলে দাঁতে জীবাণুর আক্রমণ কম হয় এবং দাঁত ঠিক থাকে।

মৌসুমি ফল উৎপাদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সুখ্যাতি দীর্ঘকালের। এসব জেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ে উৎপাদিত ফল বাজারজাত করা হয় সারাদেশে। আম, কাঁঠাল ও লিচুর চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষিকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে আনারস। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, দেশে উৎপাদিত আনারসের সিংহভাগই চাষ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। বছরে গড়ে দেড় লাখ টন আনারস উৎপাদন হয় পার্বত্য তিন জেলায়। কৃষক ও বাগান মালিকরা বলছেন, উৎপাদিত আনারসের ন্যায্যমূল্য ও বাজারজাতের ব্যবস্থা, সার ও কীটনাশকের মূল্য কমলে চাষিরা আরও লাভবান হবেন। পাশাপাশি নতুন করে বাগান তৈরিতে আগ্রহ বাড়বে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো ঢালু হওয়ার কারণে আনারস চাষের জন্য বেশি উপযোগী। ঢাকা-চট্টগ্রামে এসব আনারসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার এবং রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব আনারস সরবরাহ করা হয়।

আনারস চাষে অন্যান্য লাভের সঙ্গে আরেকটি লাভ মুড়ি ফসল। মুড়িগাছ একাধিক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং ফল ধরে। সাধারণত মুড়ি ফসল থেকে ৫ থেকে ৬ বছর সফলভাবে ফল সংগ্রহ করা যায়। ঘোড়াশাল জাতের বেলায় কাপাসিয়া এলাকায় ৪০ থেকে ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুড়ি ফসল থেকে ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে আগাছা পরিষ্কার, শূন্যস্থান পূরণ, সার প্রয়োগ, বালাই ব্যবস্থাপনার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। আনারসের সঙ্গে অনায়াসে আদা, সয়াবিন, সরিষা, কলাই, কচু সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন ফল গাছের বাগানের ভেতর আনারস আবাদ করে। পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত ট্যারেসিং বা কন্টুর পদ্ধতিতে ৬০ সেন্টিমিটার গভীর ও ৩০ সেন্টিমিটার প্রস্থ চাষ করা ভালো।

আনারস চাষের জন্য উপযুক্ত জমি ও মাটি নির্বাচন করতে হবে। এজন্য উঁচু জমি ও পানি জমে না থাকে এমন জমি বাছাই করতে হবে। মাটি হতে হবে দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ। জমি থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু এবং ১ মিটার বেড তেরি করতে হবে। এক বেড থেকে অন্য বেডের মধ্যে ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার ফাঁকা রাখতে হবে। মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ অর্থাৎ অক্টোবর নভেম্বর মাস আনারসের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তাছাড়া সেচের সুবিধা থাকলে মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন অর্থাৎ ফেব্রম্নয়ারি মাসেও চারা লাগানো যায়। পাহাড়ের ঢালে আনারস চাষের জন্য কন্টুর পদ্ধতি বা সমউচ্চতা বরাবর ঢালের বিপরীতে আড়াআড়িভাবে জোড়া সারি করে চারা রোপণ করা হয়। কখনো ঢাল বরাবর সারিতে চারা রোপণ করা উচিত নয়। এতে ভূমিক্ষয় বাড়ে। পাহাড়ের ঢালে জোড়া সারিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার দেওয়া উচিত। এতে হেক্টরপ্রতি ৫০ হাজার চারা প্রয়াজন। আনারসের সঙ্গে আদা, সয়াবিন, সরিষা, কলাই, কচু ইত্যাদি সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। একবার আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ফল সংগ্রহ করার পর ও দ্বিতীয়বার অক্টোবর-নভেম্বরে।

স্বাভাবিক অবস্থায় আনারসের বীজ হয় না। তাই বিভিন্ন ধরনের চারার মাধ্যমে আনারসের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। সাধারণত পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা ও গুঁড়ি চারা দিয়ে আনারসের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। এর মধ্যে পার্শ্ব চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। আনারস চাষের জমিতে পোকার আক্রমণ হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে। সাধারণত চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে আনারস গাছে ফুল আসে। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে আনারস পাকে।

কৃষকদের মতে গুণগতমানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে আনারস চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরন অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈবসার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদিপশু থাকলে সেখা থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদিপশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশী যারা গবাদিপশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ ছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদির স্তূপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব। আনারস চাষের আগে অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে আনারস চাষ সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনে নিতে হবে।

আনারস একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আনারস চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদন বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করা সম্ভব। প্রচুর পুষ্টিগুণে ভরপুর আনারস। এক সময় শুধু দেশের চাহিদা পূরণ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিক ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আনুমানিক ১৫৪৮ সালের দিকে আমাদের এ অঞ্চলে আনরস এসেছে। পাকা আনারসের অম্স্ন মধুর রসালো মিষ্টি গন্ধ হৃদয় ছুঁয়ে যায়, খাওয়ার প্রতি লোভ বাড়িয়ে দেয়। আনারস দারুণ মনোহরি সুগন্ধী, উপাদেয় এবং সুস্বাদু ফল। আনারসের জুস, স্স্নাইস, এসিড, স্কোয়াশ, সিরাপ, জ্যাম, জেলি, আনারসসত্ত্ব, ভিনেগার, সাইট্রিক এসিড, ক্যালসিয়াম সাইট্রেট, অ্যালকোহল বিশ্বনন্দিত। কুশকুশে কাশিজ্বরে আনারস মহৌষধ। তাছাড়া আনারসের পাতা থেকে মোম ও সুতা তৈরি হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে