শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাটের সম্ভাবনা

বিশ্ববাজারে পাটের কদর আবারও বাড়তে শুরু করেছে। রপ্তানি হচ্ছে বড় পরিসরে। দেশের অভ্যন্তরেও সম্প্রসারিত হচ্ছে বেশ। এরই অংশ হিসেবে সরকার ১৭টি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। পাট আমাদের ইতিহাস। আমাদের গৌরব। দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই পণ্য। বাংলার পাট হবে বিশ্বমাত। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়- আবার হবে পাটের চাষ, মাঠের পরে মাঠ, পণ্য বিকে অর্থ পেয়ে গরম কর হাট।
ম নাহিদ বিন রফিক
  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

বহু ব্যবহৃত পণ্যের মধ্যে পাট অনন্য। এক সময় বাংলার পাট ছিল বিশ্বসেরা। মাঝে সমস্যা থাকলেও তা কাটিয়ে এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাই দিন দিন এর আবাদ বাড়ছে। কৃষকরাও দাম পাচ্ছেন বেশ। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাখছে যথেষ্ট ভূমিকা। বাংলাদেশের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৫ ভাগ আসে পাট থেকে। এ ছাড়া পাটকাঠি ও পাটশাক বিপণনে প্রতিবছর দেলদেন হচ্ছে বিরাট অঙ্কের অর্থ।

পাটের ব্যবহার ঠিক কখন থেকে শুরু হয়েছিল তা বলা মুশকিল। তবে ইতিহাসের পাতা উল্টালে জানা যায়, মুঘল আমলে ভারতবর্ষের কিছু মানুষ পাটের তৈরি পোশাক পরিধান করত। এরও আগে পশ্চিমবঙ্গে পাটের রশি এবং সুতলি ব্যবহারের কথা শোনা যায়। পাটের ব্যবহার বহুমুখী। তৈরি হয় সুতা, চট, বস্তা, শিকা, চটের ব্যাগ, ল্যাপটপের ব্যাগ, মাদুর, গালিচা, জায়নামাজ, টুপি, টেবিল ম্যাট, বিছানার চাদর, শাড়ি, বিভিন্ন শীতের পোশাক, তৈজসপত্র, আসবাবপত্র, শোপিস, বসার গদি, দেয়াল-আচ্ছাদন, গৃহসজ্জার সামগ্রী, পর্দার কাপড়, কুশনকভার দোলনা, মেয়েদের গহনা, পার্স, মানিব্যাগ, বেল্ট, বাহারি খেলনা, পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মন্ডসহ আরও অনেক জিনিস। পাটের আঁশে পলিথিন ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। এমনকি টেউটিনও। পাটখড়ি দিয়ে ঘরের বেড়া এবং ছাউনি তৈরি হয়। পানের বরজ, জ্বালানি হিসেবে এবং কাগজ তৈরিতেও এর ব্যবহার সমাদৃত। পাটের পাতা শাক হিসেবে উৎকৃষ্ট। খেতে সুস্বাদু। পুষ্টিকরও বটে। সে সঙ্গে ঔষধিগুণে ভরপুর। টিউমার ও ক্যানসার প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে। পাতার রস বাতের জন্য বেশ উপকারী। ক্ষুদামন্দা, উদরাময়, আমাশয় এবং অম্স্ন রোগের মহৌষধ। তবে সব ধরনের পাটের পাতা খাওয়া যায় না।

বাংলার পাট বিশ্বপণ্য হিসেবে স্বীকৃত। ভারত, চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মিসর ও বেলজিয়ামে পাটের সুতা রপ্তানি হয়। তবে মোট রপ্তানির শতকরা ৪০ ভাগই হচ্ছে তুরস্কে। কাঁচা পাট রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ভারত, চীন ও পাকিস্তান অন্যতম। এ ছাড়া রয়েছে থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, জার্মানি, স্পেন, ইংল্যান্ড, মিসর, জাপান, ভিয়েতনাম, ইথওপিয়া এবং আইভেরিকোস্ট।

সময়মতো ফসল সংগ্রহ না করলে পাটের উৎপাদন এবং গুণগতমান কমে যায়। তাই গাছে দু-একটি ফুল বের হলে কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। কাটার পর আঁটি বেঁধে জমিতে ৩ থেকে ৪ দিন ফেলে রাখতে হয়। এরপর পরিষ্কার পানিতে জাগ দিতে হবে। রিবনরেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানো যায়। জাগ দেওয়ার আগে পাটের গোড়া থেঁতলিয়ে নিতে হবে। এরপর আঁটিগুলোকে লম্বালম্বিভাবে সাজাতে হয়। আরেক স্তর আড়াআড়ি সাজাতে হবে। স্তরের সংখ্যা হবে পানির গভীরতা অনুযায়ী। আঁটি ডোবানোর ক্ষেত্রে কলাগাছ, মাটির ঢেলা, কাদামাটি এসব ব্যবহার করা যাবে না। এক্ষেত্রে সিমেন্টের স্নাব ব্যবহার উত্তম। তবে গাছের গুঁড়ি দেওয়া যেতে পারে। চারপাশে খুঁটি পুঁতে বাঁশের সাহায্যেও ডোবানো যায়। মুদৃ স্রোত আছে এমন জলাশয়ে পাট পচানোর জন্য ভালো হয়। এতে আঁশের রঙ উজ্জ্বল হবে। পচনক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে প্রতি ১শ' আঁটির জন্য ১ কেজি হারে ইউরিয়া একটি পাত্রে গুলিয়ে পানিতে শিশিয়ে দিতে হয়। আঁটিতেও ইউরিয়া ছিটিয়ে দেওয়া যায়। ১৪ থেকে ১৬ দিন পচনক্রিয়া শেষ হলে পানি থেকে উঠিয়ে আঁশ পৃথকীকরণের কাজ দ্রম্নত সেরে ফেলতে হবে। এরপর পরিষ্কার পানি খুব ভালো করে আঁশ ধুয়ে নিতে হয়। আঁশের রঙ কালো হলে ১ কেজি পরিমাণ পাকা তেঁতুল ৪০ লিটার পানিতে গুলিয়ে আঁশগুলো ৫ থেকে ৬ মিনিট ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে শুকালে রঙ উজ্জ্বল হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে তেঁতুলের কোনো অংশ যেন আঁশে লেগে না থাকে। পাটের আঁশ মাটিতে শুকানো যাবে না। হতে পারে বাঁশের আড়া, ঘরের চাল কিংবা ব্রিজের রেলিং অথবা অন্য কোনো উপায়। অবশ্যই উত্তমরূপে শুকনো চাই। এরপর বিপণন কিংবা গুদামজাতকরণ। গত বছরে এর গড় ফলন হয়েছিল হেক্টর প্রতি ৩ টন।

বিশ্ববাজারে পাটের কদর আবারও বাড়তে শুরু করেছে। রপ্তানি হচ্ছে বড় পরিসরে। দেশের অভ্যন্তরেও সম্প্রসারিত হচ্ছে বেশ। এরই অংশ হিসেবে সরকার ১৭টি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। পাট আমাদের ইতিহাস। আমাদের গৌরব। দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই পণ্য। বাংলার পাট হবে বিশ্বমাত। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়- আবার হবে পাটের চাষ, মাঠের পরে মাঠ, পণ্য বিকে অর্থ পেয়ে গরম কর হাট।

লেখক : টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস ও পরিচালক, কৃষি বিষয়ক আঞ্চলিক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ বেতার, বরিশাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে