অল্প পুঁজিতে গরু মোটাতাজা করে বেকারত্ব ও দরিদ্রতা দূর করেছে অনেকে

গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করা খুব লাভজনক। অল্প সময়ে অল্প পুঁজিতে গরু মোটাতাজা করে বেকারত্ব ও দরিদ্রতা দূর করা যায়। অল্প সময়ে ষাঁড় বাছুরকে সুষম খাদ্য খাওয়ায়ে দৈহিক বৃদ্ধি করে গরু মোটাতাজা করা হয়। গবাদিপশু মোটাতাজা করতে ৪-৫ মাস সময় লাগে। হঠাৎ করে স্টেরয়েড খাইয়ে গরু মোটাতাজা করা যায়। তবে কাজটি অনৈতিক, নিষিদ্ধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

ম সাজ্জাদ হোসেন শাওন
গরু মোটাতাজাকরণ একটি নিয়মিত ও প্রচলিত পদ্ধতি। এটি একটি স্বল্পমেয়াদি লাভজনক পদ্ধতি। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করা যায়। এ পদ্ধতিটি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে গরু-ছাগল মোটাতাজাকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে গরু মোটাতাজা করে হাজার হাজার বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছে। গরুকে স্বাস্থ্যসম্মত সঠিক খাদ্য দিয়ে মোটা-তাজা করলে তার মাংস ক্ষতির কারণ হয় না। গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করা খুব লাভজনক। অল্প সময়ে অল্প পুঁজিতে গরু মোটাতাজা করে বেকারত্ব ও দরিদ্রতা দূর করা যায়। অল্প সময়ে ষাঁড় বাছুরকে সুষম খাদ্য খাওয়ায়ে দৈহিক ওজন বৃদ্ধি করে গরু মোটাতাজা করা হয়। গরু মোটাতাজাকরণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে আড়াই শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয় খামারিদের। ওই সুবিধা পেয়ে সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার তরুণ গরু-ছাগলের খামার গড়ে তোলেন। বর্তমানে প্রতি বছর ২৫ শতাংশ হারে গবাদিপশুর খামার বাড়ছে। ছোট-বড় মিলিয়ে এখন দেশে খামারের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। সহজেই গরু মোটাতাজা করা যায়। এর জন্য স্থানীয় বাজার থেকে গরু কিনেই শুরু করা যায়। এতে অল্প বিনিয়োগে কম সময়ে লাভসহ মূলধন ফেরত পাওয়া যায়। কারণ এ পদ্ধতিতে স্থানীয়ভাবে পাওয়া খাবার সঙ্গে বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার কাজে লাগানো যায়। দেশি ষাঁড়ের ক্ষেত্রে- দেশি গরু মোটাতাজাকরণের জন্য বয়স দুই দাঁত বা দুই বছর হলেই চলে। ক্রস জাত বা উচ্চ মাংস উৎপাদন জাতের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৪ মাস হওয়া জরুরি। গরু বাছাই করার ক্ষেত্রে মনে রাখবেন, গরুর বয়স ২ থেকে ৩ বছর হলে ভালো হয়। শংকর, ফিজিয়ান, সিন্ধি জাত হলেও ভালো। এগুলোর চামড়া ঢিলেঢালা, হারের জোড়া মোটা, ঠান্ডা প্রকৃতির, রোগমুক্ত। গরু কেনার পর প্রথম কাজ হচ্ছে গরুকে কৃমিমুক্ত করা। মুখের রুচি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারেন। তারপরই হচ্ছে সুষম খাবার পরিমাণমতো। গরু মোটাতাজা করার জন্য শুধু খাবার দিলেই হবে না। সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে হবে। যেমন- সময়মতো গোসল, খাবার, ওষুধ দিতে হবে। এছাড়া ভালো ব্যবস্থাপনা, যথাসময়ে সঠিক কাজ সফলতা এনে দেবে। দেশে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ একটি লাভজনক পেশা। কারণ আমাদের মাংসের চাহিদা প্রচুর, অথচ উৎপাদন কম। এছাড়া গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের সঙ্গে কর্মসংস্থান, গোবর উৎপাদন, চামড়া উৎপাদন, পরিবেশ উন্নয়ন এসব নানা কিছু জড়িত। বয়স্ক গরু মোটাতাজাকরণের জন্য খুব বেশি উপযোগী নয়। গরু সাধারণত ষাড় হওয়া ভালো। ষাড় গরুর মাংসের মূল্য এবং চাহিদা বেশি। গরু নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখবেন প্রাণীটির দেহের কাঠামো যেন একটু বড় হয়। যেমন লম্বা এবং উচ্চতা এ দুটো বিষয়ই খেয়াল রাখতে হয়। বড় আকারের একটি কঙ্কালসার গরুর গায়ে বেশ মাংস উৎপন্ন করা যায়। গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করা খুব লাভজনক। অল্প সময়ে অল্প পুঁজিতে গরু মোটাতাজা করে বেকারত্ব ও দরিদ্রতা দূর করা যায়। অল্প সময়ে ষাঁড় বাছুরকে সুষম খাদ্য খাওয়ায়ে দৈহিক বৃদ্ধি করে গরু মোটাতাজা করা হয়। গবাদিপশু মোটাতাজা করতে ৪-৫ মাস সময় লাগে। হঠাৎ করে স্টেরয়েড খাইয়ে গরু মোটাতাজা করা যায়। তবে কাজটি অনৈতিক, নিষিদ্ধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। স্টেরয়েডের ব্যবহারের কারণে খামারেই গরুর মৃতু্য ঘটে আবার কোরবানির ঈদের হাটেও মৃতু্য হয় এমন নজির প্রচুর আছে। কারণ স্টেরয়েড প্রাণীর স্বাভাবিক মেটাবলিজমকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীরের প্রণুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন লিভার, লাং, হৃৎপিন্ড এসব স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্টেরয়েড খাওয়ানো গরু হাইপারটেনশনে বেশি মারা যায়। এ ছাড়া স্টেরয়েড মানবদেহের জন্যও যথেষ্ট ক্ষতিকর। সুতরাং মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ার কোথাও স্টেরয়েডের প্রয়োজন হয় না। যদি তা স্বাভাবিক সময় এবং নিয়ম জেনে করা হয়। তবে মোটাতাজাকরণের সময় চিকিৎসকরা সহনীয় মাত্রায় ভিটামিন, মিনারেল ব্যবহার করেন। যা প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর নয়, মানুষের জন্যও ক্ষতিকর নয়। গরু ক্রয়ের পর পর ক্ষুরা, তড়কা এবং গলাফোলা রোগের টিকা দিতে হবে। সাধারণত আমরা গোয়ালঘরে যেভাবে গরু পালন করি সেই রকম একটা গোয়ালঘরের মতো ঘর বানাতে পারলেই মোটাতাজাকরণ শুরু করা যায়। একটি গরুর জন্য ৩ ফিট প্রস্থ এবং ৭ ফিট দৈঘ্য জায়গা দরকার হয়। এর সঙ্গে যা দরকার হয় তা হচ্ছে খাবারের চাড়ি। প্রতিটি গরুর জন্য একটি চাড়ি গোয়ালঘরে রাখতে হবে। খর, টিন, ছন অথবা হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি করা যায়। যেখানে যা সহজলভ্য এবং যা সাধ্যের মধ্যে কুলায় এমন উপকরণ দিয়ে মোটাতাজাকরণ শুরু করতে হবে। কারণ গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ একটি লাভজনক ব্যবসা। বাসস্থানের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখা দরকার। যেমন গোয়ালঘর খোলামেলা হওয়া ভালো। এতে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। গোয়ালঘরের কাছে একটি স্যালো টিউবওয়েল অথবা ডিপটিউবওয়েল স্থাপন করা দরকার। কারণ মোটাতাজাকরণে গবাদিপশুকে পরিমিত পানি, দানাদার খাবার মিশ্রণ, ইউরিয়া মিশ্রিত স্ট্র এসব প্রস্তুত করতে পর্যাপ্ত পানির সংস্থান থাকতে হয়। তাছাড়া মোটাতাজাকরণের পশুকে দু-তিন দিন পরপর পানির স্প্রে করে শরীর ধুইয়ে দিলে ত্বক মসৃণ হয়। বাসস্থানে গোবর এবং মূত্র নিষ্কাশিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ধানের জমিতে অর্গানিক সার ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির উবর্রতা বৃদ্ধির জন্য গোবর থেকে কম্পোজিটর সার, গোবরে কেঁচো চাষ করে সেখান থেকে জৈবসার প্রস্তুত করা যায়। যা থেকে খরচ উঠে আসবে। গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ এবং উৎপাদন দুই ক্ষেত্রেই কাঁচা ঘাসের সংকট আছে। এ সংকট মোকাবিলায় আমরা ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র'কে ঘাসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করত হবে। তবে এর পরিমাণ দিনে ৩-৪ কেজির ঊর্ধ্বে হওয়া যাবে না। ৩-৪ কেজির বেশি ইউরিয়া মিশ্রিত খর খাওয়ালে গরুর মধ্যে ইউরিয়া বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে। কারণ একটি গরু মিশ্রিত উপকরণের সঙ্গে দৈনিক গড়ে ৫০-৬০ গ্রাম ইউরিয়া শরীরবৃত্তির কাজে ব্যবহার করতে পারে। এর বেশি ইউরিয়া খাওয়ালে পশুতে বিষক্রিয়া হয়। ১০ কেজি শুকনো খড় টুকরো টুকরো করে কাটুন। ৫ লিটার পানি একটি বালতিতে রাখুন; এ ৫ লিটার পানির মধ্যে ২.৫ কেজি চিটাগুড় মিশান, চিটাগুড় মিশ্রিত হলে এর সঙ্গে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া মেশান। এখন ইউরিয়া এবং চিটাগুড় মিশ্রিত পানির দ্রবণটি ১০ কেজি খড়ের সঙ্গে ভালোভাবে মেশান। ব্যাস, ইউরিয়া মোলাসেস তৈরি হয়ে গেল। এখন এ খড় প্রতিদিন প্রতিটি গরুকে ৩ থেকে ৪ কেজি পরিমাণ খাওয়াবেন। ৩ থেকে ৪ কেজির বেশি ইউএমএস এক দিনে একটি গরুকে খাওয়ানো যাবে না। এখন খাদ্য তালিকায় আরও যা রাখবেন তা হচ্ছে গরু প্রতি প্রতিদিন ৫-৬ কেজি কাঁচাঘাস খাওয়াতে হবে। দানাদার খাদ্য হিসেবে বিভিন্ন প্রকার ডালের ভুসি ২-৩ কেজি মিশ্রণ করবেন এর সঙ্গে ২-৩ কেজি চালের কুঁড়া এবং গমের ভুসির মিশ্রণ করবেন। এ হারে মিশ্রিত দানাদার খাদ্য প্রতিদিন প্রতিটি গরুকে খাওয়াতে হবে। গবাদিপশু মোটাতাজাকরণে প্রতিটি গরুকে দিনে ২৫০ গ্রাম সরিষার খৈল খাওয়ালে গরুর ত্বক মসৃণ হয় এবং স্বাভাবিকভাবে চর্বির বৃদ্ধি ঘটে। এ ছাড়া ভাতের মাড়, চাল ধোয়া পানি, সবজির অবশিষ্ট অংশ, ফলমূলের ছোবড়া গবাদিপশুকে খাওয়ান, পশুর বৃদ্ধি খুব দ্রম্নত হবে। এসব নিয়মকানুন মেনে চললে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের মাধ্যমে ভালো আয় করা যায় এবং দেশে মাংস, গোবর এবং চামড়ার সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যায়।