শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিংকসমৃদ্ধ ধানের গুরুত্ব বাড়ছে

ম ইমরান সিদ্দিকী
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও পুষ্টি নিরাপত্তায় রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকার ফসল উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। জিংকসমৃদ্ধ ধানের চাষ উৎসাহিত করতে বাংলাদেশের সরকার বিনা জামানতে ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে। আবহমানকাল ধরে ধানকে এ দেশের জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বাংলাদেশে খাদ্যের নিরাপত্তা বলতে মূলত ধান বা চালের নিরাপত্তাকেই বোঝায়। খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনীতির নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে- যা সম্ভব হয়েছে কেবল চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বা খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে।

মানবদেহ গঠনের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনুপুষ্টি উপাদান হলো জিংক। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সে শতকরা ৪৪ ভাগ শিশু এবং ৫৭ ভাগ মহিলারা জিংকের অভাবে ভুগছে। ১৫ থেকে ১৯ বছরের শতকরা ৪৪ ভাগ মেয়েরা এর অভাবে খাটো হয়ে যাচ্ছে। এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে (বায়োফটিফিকেশনের মাধ্যমে) প্রধান খাদ্য ভাতের মধ্যে অধিক পরিমাণে জিংক সম্পৃক্ত করে নতুন নতুন জিংকসমৃদ্ধ জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। দেশে উদ্ভাবিত চালে ২৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত জিংক পাওয়া যায়, যা আপনার শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত জিংকের চাহিদা পূরণ করতে পারে। চালে অধিক পরিমাণে জিংক থাকা সত্ত্বেও এই ভাতের স্বাদ ও রংয়ের কোনো পরিবর্তন হয় না।

উচ্চমাত্রায় জিংকের অভাবে মানুষ খাটো হয়। এছাড়া ক্ষুধামন্দা, ডায়রিয়া হয়। তাই বাংলাদেশে মানুষের এসব সমস্যা সমাধানে জিংক চাল ভূমিকা রাখবে। এই চালের ভাত খেলে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। জিংক ধানের চাল থেকে দেশের মানুষের ৭৭ শতাংশ ক্যালরি ও ৫০ শতাংশ প্রোটিন আসে ভাত থেকে। প্রতিদিন গড়ে মাথাপিছু ৩৬৭ গ্রাম চালের ভাত আমরা খেয়ে থাকি। ভাত বা দানাদার খাদ্য মোট খাদ্যশক্তির ৬০ শতাংশের বেশি দখল করে আছে। অর্থাৎ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির অধিকাংশ ক্যালরি, প্রোটিন ও খনিজ উপাদান আসে ভাত থেকে। চালে মোটামুটি ৮০ শতাংশ শকর্রা, ৭.১ শতাংশ প্রোটিন, ০.৬৬ শতাংশ চর্বি, ০.১২ শতাংশ চিনি, ১.৩ শতাংশ আঁশ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম চালে ১১৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ১১৫ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ২৫ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ২৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৪.৩১ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়।

মানবদেহের জন্য জিঙ্ক খুব প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। মানবদেহের ৩০০টি এনজাইমের সঙ্গে জিঙ্ক সরাসরি অংশগ্রহণ করে যেগুলো দেহের অনেক বিপাকীয় কাজে অংশ নেয়। জিঙ্কের অভাবে মুখের রুচি নষ্ট হয়, স্বাদ ও গন্ধ নষ্ট হয়, ওজন কমে যায় অথবা মুটিয়ে যায়, চুল পড়ে যায়, হজমে সমস্যা হয়, জটিল ধরনের অবসাদগ্রস্ততা দেখা দেয়, বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়, হরমোনের সমস্যা হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, মনোযোগ ও স্মরণশক্তি কমে যায়, ত্বকের ক্ষত সারতে দেরি হয় এবং স্নায়ুবিক দুর্বলতা দেখা দেয়। মানব শরীর জিঙ্ক সংরক্ষণ করে রাখতে প্রতিদিনই একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের ১১ মিলিগ্রাম এবং নারীদের ৮ মিলিগ্রাম জিঙ্ক গ্রহণ করতে হয়। গর্ভবতী মায়েদের দৈনিক ১১ মিলিগ্রাম, দুগ্ধদানকারী মায়েদের ১২ মিলিগ্রাম জিঙ্ক প্রয়োজন এবং শিশুদের দৈনিক চাহিদা ৩ থেকে ৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক।

লাল মাংস জিঙ্কের ভালো উৎস। ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে ৪.৮ মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে- যা দৈনিক চাহিদার শতকরা ৪৪ ভাগ মেটায়। ১০০ গ্রাম ছোট চিংড়ি দৈনিক চাহিদার শতকরা ১৪ ভাগ মেটায়। ১০০ গ্রাম রান্না করা ডাল মেটাতে পারে চাহিদার মাত্র ১২ শতাংশ। বাদামে প্রচুর জিঙ্ক আছে। ২৮ গ্রাম বাদাম চাহিদার ১৫ শতাংশ, পনির ২৮ শতাংশ, এক কাপ দুধ ৯ শতাংশ এবং একটি ডিম শতকরা ৫ ভাগ জিঙ্কের চাহিদা মেটাতে পারে। মাংস, ডিম, দুধ, পনির, বাদাম, চিংড়ি দামি খাবার হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। লাল মাংস ও চিংড়িতে কোলেস্টেরল বেশি থাকায় বয়স্ক জনগণ সাধারণত ডাক্তারের পরামর্শে এসব খাবার এড়িয়ে চলেন। তাই মানব দেহের জন্য সবচেয়ে উপকারী হচ্ছে জিংকসমৃদ্ধ ভাত।

খাদ্যের মাধ্যমে পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করতে দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কয়েকটি জাতের জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান ও গমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত জিঙ্কসমৃদ্ধ জাতগুলোতে প্রতি কেজি চালে ২২ থেকে ২৭ মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে যেখানে সাধারণ চালে থাকে মাত্র ১৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক। প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম জিঙ্কসমৃদ্ধ চালের ভাত খেলে একজন ভোক্তা প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ মিলিগ্রাম জিঙ্ক পেতে পারে। পুষ্টির চাহিদা পূরণে জিংকসমৃদ্ধ ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। কৃষকরা জিংকসমৃদ্ধ ব্রি ধান ৬৪, ব্রি ধান-৭৪, ব্রি ধান-৮৪ এবং ব্রি ধান-১০০ আবাদ করেছেন ফলনও হচ্ছে ভালো।

ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির অধিকাংশ ক্যালরি, প্রোটিন ও মিনারেল আসে ভাত থেকে। অন্য পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পারলেও দুই বা তিনবেলা ভাতের সংস্থান এখন প্রায় সবারই সামর্থ্যের মধ্যে। তাই ভাতের মাধ্যমে কীভাবে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৩ সালে বিশ্বের সর্বপ্রথম জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত ব্রি ধান-৬২ উদ্ভাবন করে। এরপর একে একে ব্রি ধান- ৬৪, ব্রি ধান-৭২, ব্রি ধান-৭৪, ব্রি ধান-৮৪ এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উচ্চ জিঙ্ক ব্রি ধান-১০০ অবমুক্ত করে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ব্রি উদ্ভাবিত শততম জাতের (ব্রি ধান-১০০) অবমুক্তকরণ করে। ব্রি বলছে, ব্রি ধান-১০০ জাতটি উচ্চ পরিমাণে জিংকেসমৃদ্ধ। এতে জিংকের পরিমাণ প্রতি কেজিতে ২৫ দশমিক ৭০ মিলিগ্রাম। দেশের ১০টি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে আবাদ করে এই ধানের গড় ফলন পাওয়া যাচ্ছে হেক্টরে ৭ দশমিক ৬৯ টন। জাতটির জীবনকাল ১৪৮ দিন। বোরো মৌসুমে চাষের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এই সুপার জাতটি।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জিঙ্কসমৃদ্ধ বিনাধান-২০ নামের ধানের জাত এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৭ সালে বারি গম ৩৩ উদ্ভাবন করেছে। সরকারের উৎপাদন গতিশীলতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭২ লাখ টন। বিপরীতে ২০৫০ সালে সাড়ে ২১ কোটি মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণে চাল প্রয়োজন হবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন। অর্থাৎ, গত পাঁচ বছরের চালের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে দেশে ২৬ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। স্বাস্থ্য খাতে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। জিংক ধান আপাতত টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্য- যা সামনে রেখে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছেন দেশের কৃষি গবেষকরা।

জিংকের অভাবে শিশুদের ক্ষুধামন্দা হচ্ছে। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশ, মা ও শিশুর জন্য জিংক এবং আয়রন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শরীরে জিংকের ঘাটতি হলে রোগ প্রাতরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। জিংকের অভাবে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে