জমজমাট ফুল বাণিজ্য

২০১৭-১৮ অথর্বছরে বাংলাদেশের ফুল রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৬ হাজার ডলার। বাংলাদেশের কঁাচা ফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালি, কানাডা, চীন, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সে রপ্তানি করা হচ্ছে। বিশ্বে ১৬ হাজার কোটি ডলারের বিশাল ফুলের বাজারে বাংলাদেশের জন্য আরো বড় আকারের রপ্তানির সুযোগ অপেক্ষা করছে...

প্রকাশ | ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

এস এম মুকুল
‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সায় খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ দুটি যদি জোটে অধেের্ক তার ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগী!’ মানুষের জীবনে ফুলের গুরুত্ব অপরিসীম। কত সহস্র উপমায় বিশেষায়িত এই ফুল। কত শত কবি তার কবিতায় ফুলের গুণকীতর্ন করেছেন। শুদ্ধতা, পবিত্রতা ও সৌন্দযের্র প্রতীক, ভালোবাসার অঘর্্য, শ্রদ্ধা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপকরণ, প্রাথর্নার নৈবদ্য হিসেবে ফুলের ব্যবহার আরো কত কী! ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন। জগৎ জুড়ে ফুলের ব্যবহার বতর্মানে যেমন চলছে ভবিষ্যতেও চলবে। ফুল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও মননশীলতার প্রতীক। উপহার, সংবধর্না, গায়ে হলুদ, বিয়ে, পূজা-পাবর্ণ এমনকি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতায় ফুল এখন অপরিহাযর্ অনুসঙ্গ। আধুনিক সমাজে ফুলের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে শুধু সৌখিনতা নয়, ফুল এখন বিরাট এক অথর্করী ফসল। ফুলের চাহিদার কমতি নেই বিশ্বজুড়ে। নতুন বছরের হালখাতা, নিবার্চন আর ইংরেজি নববষর্ ঘিরে রাজধানীসহ সারাদেশে জমে উঠেছে ফুলের ব্যবসা। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, এবার সারাদেশে পাইকারি পযাের্য় ২৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিধার্রণ করা হয়েছে। সময়ের চাহিদার আলোকে দেশের অথর্নীতিতে ফুলের অবদান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ফুলের বাণিজ্যিক প্রসার খুব বেশি দিনের নয়। নব্বইয়ের দশকের আগে দেশের ফুলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানি নিভর্র। বতর্মানে দেশে উৎপাদিত ফুল দিয়েই চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। জানা গেছে, ১৯৮২-৮৩ অথর্বছর থেকে দেশে ফুল অথর্করী ফসল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এরপর থেকে ক্রমেই প্রসার হচ্ছে ফুলের বাণিজ্য। এ খাতে বাড়ছে কমর্সংস্থান। দেশের গÐি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ফুল। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। বিশ্বে ফুল বাণিজ্য বিশ্বে ফুল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ফুল বিক্রয় ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ফ্লোরাহল্যান্ড। আন্তজাির্তক নিলামের মাধ্যমে প্রতিদিন সেখানে বেচাকেনা হয় ২ কোটি ১০ লাখ ফুল। বিশ্বজুড়ে বিক্রিত ফুলের প্রায় ৫২ শতাংশ রপ্তানি হয় এ বাজার থেকে। ভালোবাসা দিবসের আগে সপ্তাহজুড়ে সেখানে হাট বসে কোটি কোটি গোলাপ, টিউলিপ ও অন্যান্য ফুলের। বাণিজ্যের বাইরে বাগান থেকে সংগ্রহ করা ফুলের স্থায়িত্ব পরীক্ষা, পৃথিবীব্যাপী ফুল চাষের হিসাব-নিকাশও করা হয় এখানে। উত্তর আমেরিকায় ফুলের সবচেয়ে বড় নিলাম অনুষ্ঠিত হয় কানাডার বারনাবির সাউথওয়েস্ট গাডের্ন সাপ্লিয়াসে। প্রতি সোম, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় সমাগম ঘটে ফুলের খুচরা বিক্রেতার। বছরে ভ্যালেন্টাইনস ডে ও মাদারস ডে-তেই কানাডায় কাটতি হয় ১৫ কোটি ফুলের। ১২ ফেব্রæয়ারি ভারতের বেঙ্গালুর ফুলের বাজারে বসে লাল গোলাপের মেলা। প্রায় ৫০ লাখ গোলাপ আসে অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাডু, কেরালা, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লি থেকে। ১৪ ফেব্রæয়াার চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ের দাওনান ফ্লাওয়ার মাকেের্টর ব্যস্ততা থাকে মধ্যরাত থেকে ভোর চারটা অবধি। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ ফুল চীন ও বহিবিের্শ্বর বাজারে সরবরাহ করা হয়। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তজাির্তক মাতৃভাষা দিবস, নববষর্ এসব দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশজুড়েও শত কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হয়। এসব উপলক্ষকে সামনে রেখে ফুলের রাজধানী যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে ফুল বিক্রির ধুম পড়ে যায়। ফুলের রাজধানী গদখালী যশোর থেকে বেনাপোলের দিকে যেতে ছোট জনপদ গদখালী। ঝিকরগাছা উপজেলা সদর থেকে পশ্চিমে অবস্থিত এই জনপদটির মাঠে মাঠে যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। এখানকার প্রায় ৪০টি গ্রামে উৎপাদিত হয় রজনীগন্ধা, গোলাপ, গø্যাডিওলাস ও জারবেলাসহ বিভিন্ন ফুল। অন্যান্য অথর্করী ফসলের পাশাপাশি ফুল চাষ করেও যে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া যায় তা করে দেখিয়েছেন গদখালীর মানুষ। অনুসন্ধানে জানা যায়, গদখালীতে ফুলের চাষ শুরু হয় ফুল চাষি শেরআলীর হাত ধরে। ১৯৮৩ সালে তিনি ভারত থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বীজ এনে গদখালীতে চাষ শুরু করে, পরে তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের অন্য কৃষকগোষ্ঠী শুরু করে ফুল চাষের বিপ্লব। শেরআলী এরপর সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে অনেক ফুলের বীজ সংগ্রহ করে চাষ করেন। এখন ঝিকরগাছার দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ করে জীবিকা নিবার্হ করে কমপক্ষে সাত হাজার মানুষ। এখানে বিঘা প্রতি মওসুমে কৃষকরা আয় করেন প্রায় ৪ লাখ টাকা। কালের পরিক্রমায় পথ দেখানো সেই গদখালিকে এখন ফুলের রাজধানী বলা হয়। সারাদেশে যে ফুল উৎপন্ন হয় তার অন্তত ৭০ ভাগ হয় এই গদখালীতেই। আশির দশকে যে গদখালীতে এক বিঘা জমিতে ফুলের চাষ হয়েছিল সেখানে এখন প্রায় ১৮শ’ বিঘা জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। তবে ঝিকরগাছার গদখালী এলাকা ছাড়াও পাশ্বর্বতীর্ শাশার্ উপজেলাতেও ফুল চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ফুলচাষীরা বলছেন, বতর্মানে ওই এলাকায় প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। এসব জমি থেকে ভরা মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ২ লাখ রজনীগন্ধার স্টিক, ৪ লাখ গঁাদা ফুল, ৩০ হাজার গোলাপ, ৫০ হাজার গøাডিউলাস ফুলের স্টিক উৎপন্ন হয়। অন্যান্য ধরনের ফুল উৎপন্ন হয় প্রায় ৩০ হাজার। রপ্তানি বাজারে সম্ভাবনার হাতছানি বিশ্ব ফুলের বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছে ফুল। দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল ও বাহারি লতাপাতার গাছ উৎপাদন স্থানীয়ভাবে বাজারজাতকরণ এবং রপ্তানির তালিকায় একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আশা জাগিয়েছে। জানা যায়, ১৯৯১-৯২ সাল থেকে ফুল রপ্তানির জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্র মতে, ২০০৫ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকার। ২০০৮-২০০৯ অথর্বছরে এ দেশ থেকে ফুল রপ্তানি হয়েছিল ২৭৬ কোটি ৯ লাখ টাকার, ২০০৯-২০১০ সালে ৩২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকার এবং ২০১০-২০১১ সালে ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ফুল রপ্তানি হয়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) তথ্য মতে, সারা বিশ্বে ফুলের বাজার প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ২০১৮ সালে ফুলের বৈশ্বিক রপ্তানি বাজার হবে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার। ডিসিসিআইর সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অথর্বছরে বাংলাদেশের ফুল রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৬ হাজার ডলার। বাংলাদেশের কঁাচা ফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালি, কানাডা, চীন, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সে রপ্তানি করা হচ্ছে। বিশ্বে ১৬ হাজার কোটি ডলারের বিশাল ফুলের বাজারে বাংলাদেশের জন্য আরো বড় আকারের রপ্তানির সুযোগ অপেক্ষা করছে । জীবিকা, চাষাবাদ ও হাট-বাজার বতর্মানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ করা হচ্ছে। বছরে দেশে ৭৮৪ কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য হয়। তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ফুলের বাজার আছে ৪০০ কোটি টাকা। সারাদেশে খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। দেশের ২০টি জেলায় বিভিন্ন জাতের বিপুল পরিমাণ ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। প্রায় ২০ লাখ মানুষ ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। ফুল চাষে অনেক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও মানুষ ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছে। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির তথ্যানুযায়ী, সারা ঢাকায় ফুটপাতসহ অভিজাত ফুল বিক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা এখন প্রায় এক হাজার। আর সারা দেশে এই সংখ্যা চার হাজারের বেশি। বাংলাদেশে ফুল চাষে অগ্রগামী যশোর ও ঝিনাইদহ। জানা যায়, দেশের মোট ফুল চাষের সিংহভাগই এ জেলা দুটি থেকে আসে। এখানকার ফুল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের ৫৪টি জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে। আশার খবর হলো বতর্মানে নতুন করে মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা ও বগুড়াও ফ্লাওয়ার জোন হিসেবে গড়ে উঠছে। আশায় আছে অন্তরায় ফুল চাষিদের অভিযোগÑ প্রশিক্ষণের অভাব, মানসম্মত বীজের স্বল্পতা, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ফুল শিল্পে আশানুরূপ উন্নতি করা যাচ্ছে না। দেখা গেছে, পরিবহন ব্যবস্থার অভাবের কারণে অনেক সময় ফুল পচে বড় ধরনের ক্ষতি সম্মুখীন হতে হয় চাষিদের। এসব সমস্যা সমাধান করা গেলে ফুলের উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে। আবার ফুল রপ্তানিকারদের মতে, ফুল দু’একদিন তাজা থাকে তারপর নষ্ট হয়ে যায়। এ অসুবিধা দূর করার জন্য ফ্রিজার ভ্যানের প্রয়োজন। উন্নত জাতের ফুলের চাষের জন্য পযার্প্ত গবেষণা, ফুল চাষিদের পযার্প্ত আধুনিক প্রশিক্ষণ সে সঙ্গে ফুলের সংরক্ষণ, পরিবহন, প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করতে হবে। তাহলেই এ খাতে রপ্তানি বহুগুণ বৃদ্ধি মাধ্যমে একদিকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অজর্ন সম্ভব হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকগুলো ফুলচাষিদের ঋণ দিতে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ফুল চাষিদের মতে, অবিলম্বে গদখালিতে একটা স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা দরকার। ফুল চাষ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এবং লাভজনক হলেও সরকারি আথির্ক সহায়তার অভাবে এগুতে পারছে না ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরা। লেখক : কৃষি ও অথর্নীতি বিশ্লেষক এবং উন্নয়ন গবেষক