তামাক নয়, রবিশস্য চাষে ঝুঁকছেন কৃষক

প্রকাশ | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর
মৌসুমি ফসলের সময় কুষ্টিয়ার যেসব ফসলি জমি ভরে থাকতো তামাকে, সেখানে এখন সরিষা, ভুট্টা, গমের রাজত্ব। কৃষকরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি তামাক চাষ বন্ধে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আর মৌসুমের আগে নিয়মিতভাবে এই কাজটি করেছে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কৃষিভিত্তিক সামাজিক উন্নয়ন সংগঠন ও লাইব্রেরি 'কৃষকের বাতিঘর'। তামাক চাষের জন্য কয়েক বছর আগেও দেশে বহুল পরিচিত জেলার নাম ছিল কুষ্টিয়া। তবে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার কুষ্টিয়ায় কমেছে বিষবৃক্ষ তামাকের চাষ। সাম্প্র্রতিক সময়ে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় রবি ফসলের চাষ বেড়েছে উলেস্নখযোগ্য হারে। কৃষকরা জানান, মাঠপর্যায়ে 'কৃষকের বাতিঘর' সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা এসে প্রায় নিয়মিতভাবে তাদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করেন এবং এর পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষে উৎসাহিত করেন ও পরামর্শ দেন। কৃষকের বাতিঘরের সদস্যরা কৃষকদের বোঝান যে, তামাক চাষে জমির উর্বরতা কমে যায়, ব্যয় ও পরিশ্রম বেশি হয়, ঝুঁকি বেশি এবং আমাদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিও হয় বেশি। কিন্তু তামাকের টাকাটা একসঙ্গে হাতে পাওয়া যায় দেখে মনে হয় লাভ অনেক, কিন্তু আসলে তা নয়; বরং লোকসানি হয় বেশি। তাই এসব বিষয় জানা ও বোঝার পর থেকে তামাক চাষ বাদ দিয়ে বিভিন্ন রবি ফসলের চাষ করেছেন কৃষকরা। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, মিরপুর উপজেলায় গত বছরের তুলনায় এবার এক হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ কমে এসেছে। উপজেলা জুড়ে প্রায় ১৫ ধরনের রবি ফসল চাষ হচ্ছে ৬ হাজার ৪৬৯ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ২ হাজার ১৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে- যা গত মৌসুমের থেকে ৫০০ হেক্টর বেশি। সরিষা চাষ হয়েছে ২ হাজার ১৫৯ হেক্টর জমিতে- যা গত মৌসুমের থেকে ৬৪৯ হেক্টর বেশি। এছাড়া আলু, রসুন, মরিচ, খেসাড়ি, মটর, পেঁয়াজ, সূর্যমুখী উলেস্নখযোগ্য হারে চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে তামাক চাষের প্রতি চাষিদের আগ্রহ কমে গেছে। ফলে এবছর ৬ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে, যেখানে গত বছর ৭ হাজার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল। উপজেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রবি শস্য উৎপাদনে খরচ সবচেয়ে কম এবং বর্তমান সময়ে গম, ভুট্টা, মসুর, সরিষাসহ সব ফসলের দাম ভালো পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এর আগে এই বিষয়টি সেভাবে মাঠে এসে কৃষকদের কেউ বোঝায়নি। এখন তারা বিষয়গুলো বোঝে এবং অন্যান্য কৃষকদেরও বোঝানোর চেষ্টা করে যে, তামাক চাষে ক্ষতি, শষ্য চাষে হাসি। উপজেলার আমলা ইউনিয়েনের চরপাড়া গ্রামের কৃষক সোহরাব মলিস্নক এবং হাসমত আলী বলেন, তামাক চাষে যে ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো এতটা বিষাক্ত যে সরাসরি মানব দেহে প্রবেশ করে ক্ষতি করছে। পুরো জীববৈচিত্র্যকেই অসুস্থ করে তুলছে। যে সময়ে এই বিশাল আকারের জমিতে তামাক চাষ হতো, সেই সময়ে এই জমিতে খাদ্য শস্য উৎপাদন হতে পারতো। কিন্তু সেটি না হয়ে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মধ্যে ফেলা একটি ক্ষতিকারক কৃষিপণ্য উৎপাদন করেছি আমরা। এটি আমাদের পরিবেশকে বিনষ্ট করে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে। কৃষকের বাতিঘরের সদস্যরা আমাদের যেদিন থেকে এটি বুঝিয়েছে, সেদিন থেকেই আমরা তামাক চাষ করব না বলে মনস্থির করেছি। এখন অন্য ফসলে ভালো লাভ পাব বলেও আশা করছি। আর তামাকের তুলনায় মাঠে অন্য ফসল দেখতেও অনেক ভালো লাগে। কুষ্টিয়ার পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী গোলাম কিবরিয়া মাসুম বলেন, অন্যবারের তুলনায় মিরপুর উপজেলায় এবার তামাকের চাষ অনেক কম হয়েছে। সদরপুর, পোড়াদহ, ছাতিয়ান, ধুবইল, তালবাড়িয়া, মালিহাদের বিভিন্ন জায়গাসহ আমলা ইউনিয়নে শাহপুর থেকে চরপাড়া; জমিগুলোতে এবার সরিষাসহ অন্যান্য ফসল চাষ হয়েছে। গত প্রায় একযুগ ধরে এই জমিগুলোতে তামাক চাষ হতে দেখেছি। এবার ঠিক সেই জমিগুলোতে ফুটেছে হলুদ সরিষার ফুল। এটা সত্যিই অনেক সুন্দর। এতে যেমন আমাদের পরিবেশের উন্নয়ন হচ্ছে, তেমনি কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন। কৃষকের বাতিঘরের উদ্যোক্তা এবং সাধারণ সম্পাদক হোসাইন মোহাম্মদ সাগর বলেন, তামাক সবদিক থেকেই ক্ষতিকর ফসল। এই ফসল চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে আমরা চেষ্টা করেছি যেন কৃষকরা খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন। আমরা যখন তাদের নিয়ে কর্মশালা করেছি, তারা সাড়া দিয়েছেন। রবি মৌসুমের আগে আমরা তামাক চাষ বন্ধ করে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ১৭টি মাঠদিবস করেছি। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের মাঝে ও সচেতন মহলে এই সংক্রান্ত ১০ হাজার লিফলেট বিতরণ করেছি। কুষ্টিয়া ক্যানসার সোসাইটি, কৃষিবিডি, অ্যাগ্রো অ্যালকেমি আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। সবার যৌথ প্রচেষ্টায় আমরা কিছুটা হলেও সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি। ক্ষতিকর তামাকের পরিবর্তে কুষ্টিয়ার মাঠে এখন সুন্দর ফসলের হাসি। আমরা আশা করি, আগামীতে আমরা আরও বড় পরিসরে এই কাজটি এগিয়ে নিতে পারব। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার কৃষি অফিসার সৌতম কুমার শীল বলেন, সরকার সবসময়ই কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে কাজ করছে। চলতি মৌসুমেও আমরা তামাক চাষ বন্ধে কৃষদের প্রণোদনার আওতায় বিভিন্ন ফসলের বীজ ও সার বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। এছাড়া প্রদর্শনী ক্ষেতের সহযোগিতাও দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারের একার পক্ষে সব সময় সবকিছু করা সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিকভাবে বিভিন্ন প্রয়াস এবং সচেতনতার প্রয়োজন। সেই জায়গাটি থেকে কৃষকের বাতিঘর যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, তা প্রশংসনীয়। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কুষ্টিয়ায় রবি ফসলের চাষ উলেস্নখযোগ্য হারে বেড়েছে। যেখানে বিগত বছরে প্রচুর পরিমাণে তামাক চাষ হতো, সেখানে এবার সরিষা, ভুট্টা, গমের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আমরা কৃষকদের উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করছি। সেই সঙ্গে মিরপুর উপজেলায় কৃষি উন্নয়নের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কৃষি বিষয়ক লাইব্রেরি 'কৃষকের বাতিঘর'। তারা এর আগেও কৃষকদের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে নিরক্ষর কৃষকদের বই পড়ে শোনানোর মাধ্যমে তাদের সচেতন করার যে কার্যক্রম, তা অনন্য। সরকার আগামী তিন বছরে তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন চলিস্নশ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। তামাক উৎপাদন কমিয়ে সেই লক্ষ্যে আমরাও কাজ করছি। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে সবার সম্মিলিত উন্নয়নই মূল উন্নয়ন। হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, উদ্যোক্তা ও সাধারণ সম্পাদক কৃষকের বাতিঘর। মিরপুর-কুষ্টিয়া।