পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই
পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাকৃতিক উৎস হতে রং আহরণ করে পাটপণ্য রঞ্জন পদ্ধতি, জুট-পস্নাস্টিক কম্পোজিট, স্বল্প খরচে ঔষুধি ক্যারিয়ার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত মাইক্রোক্রিস্টালাইন সেলুলোজ, পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল উদ্ভাবন করা হয়েছে। জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জুট প্রসেসিং সিস্টেমের পরিবর্তে কটন প্রসেসিং সিস্টেমে পাটকে ব্যবহারের মাধ্যমে বহুমুখী পাটপণ্য ব্যবহার বিষয়ক গবেষণা চলমান রয়েছে
প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২৩, ০০:০০
কৃষিবিদ ডক্টর মো. আল-মামুন
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাটজাতীয় আঁশ ফসলের ৫৬টি উচ্চফলনশীল জাত এবং পাটের কৃষি ও কারিগরি গবেষণায় ১২০টি লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বিশ্বে পাট উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। পাটের মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্পের আওতায় একটি বিশ্বমানের জিনোম পস্ন্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠাসহ বিশ্বে সর্বপ্রথম দেশি ও তোষা পাট, পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকারক ছত্রাক 'ম্যাক্রোফোমিনা ফ্যাসিওলিনা' এবং ধনিচার জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। উন্মোচিত জীবনরহস্যের এ তথ্যকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে ট্রান্সজেনিক লাইন যথা- বিটি জুট, দ্রম্নত বর্ধনশীল, কম লিগনিনযুক্ত, রোগ প্রতিরোধী, স্বল্প জীবনকাল এবং পণ্য উৎপাদনে চাহিদাভিত্তিক পাটের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু উষ্ণ ও অবউষ্ণমন্ডলীয় হওয়ায় পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পাট ও পাটজাত পণ্য পরিবেশে বিশাল অবদান রেখে বাংলাদেশের কৃষি ও বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। পাট ও পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী সোনালি আঁশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে ধরার লক্ষ্যে পাটপণ্যকে 'বর্ষপণ্য-২০২৩' এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকার বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উদ্ভাবন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করছে। বিশ্বে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগ ও ৩২ মিলিয়ন ফুড গ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এর ১০ শতাংশ বাজার দখল করতে পারলে বছরে আয় করা সম্ভব ৫০ হাজার কোটি টাকা। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গবেষণা অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। পাটের অঞ্চলভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদারকরণ এবং পাটচাষিদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য রাজশাহী, বরিশাল, কুষ্টিয়া ও সিলেট অঞ্চলে নতুন গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, পাট ক্রয়-বিক্রয় সহজীকরণ, কাঁচাপাট ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ, পাটজাত পণ্য রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ এবং পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন বর্জনের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠা করতে পাট অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
তোষা পাট যেখানে পানি সহ্য করতে পারে না সেখানে জিনোম গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১) জাতটি প্রায় ১৫-২০ দিন পানি সহ্য করতে পারে এবং প্রচলিত জাত থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ফলন বেশি পাওয়া যায়। পাটের জিনোম তথ্য বিষয়ে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব অর্জনের জন্য ২৪৫টি প্যাটেন্ট আবেদন করা হয়েছে- যার মধ্যে ১৭৫টি আবেদন গৃহীত হয়েছে এবং আরও কিছু আবেদন মূল্যায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পাট নিয়ে সম্ভাবনা, সোনালি আঁশের গল্প ও সাফল্য সবকিছুর নেপথ্যে রয়েছে নতুন জাতের জন্য গবেষণা। প্রতি হেক্টরে নির্ধারিত সময়ে অধিক ও উন্নত মানের পাট এবং পাট জাতীয় ফসলের আঁশ উৎপাদন, প্রান্তিক ও প্রচলিত (লবণাক্ত, খরাপ্রবণ, চরাঞ্চল) জমিতে আবাদ উপযোগী উন্নত জাত উদ্ভাবন করছে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশে ১৯৭০-৭১ অর্থবছরে ৯ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের উৎপাদন ছিল ৬৮ লাখ বেল। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদিত হয়েছে ৮২ লাখ ৭৬ হাজার বেল। পাটচাষে বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি, উচ্চফলনশীল জাত এবং উৎপাদন কলাকৌশলের ব্যবহারের ফলে এ বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। পাটের কৃষি গবেষণায় বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রমে এ পর্যন্ত পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের মোট ৫৬টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে- যার মধ্যে ২৭টি জাত বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদ হচ্ছে।
সম্প্রতিকালে অবমুক্তকৃত বিজেআরআই দেশি পাট-১০ জাতটি ১২ ডিএস/মিটার মাত্রার লবণাক্ত সহনশীল এবং বিজেআরআই উদ্ভাবিত কেনাফ জাতসমূহ নতুন নতুন চরাঞ্চলে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। বিজেআরআই গবেষণার মাধ্যমে পাটের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, পাটভিত্তিক শস্যবিন্যাস, উন্নত পঁচন পদ্ধতি এবং নাবী পাটবীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রায় ৭০টি টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। কাঁচা অবস্থায় পাটগাছ থেকে ছাল পৃথকীকরণের জন্য মেকানিক্যাল রিবনার উদ্ভাবন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিজেআরআই পাট কাটা ও বীজ মাড়াই করার মেশিন উদ্ভাবন করেছে। পাটবীজ উৎপাদনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি রোডম্যাপও তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া পাট পাতার চা, পাটকাঠি থেকে উচ্চমূল্যের চারকোল তৈরি, কেনাফ বীজ থেকে ভোজ্যতেল এবং মেস্তার মাংসল বৃতি থেকে জ্যাম, জেলি, জুস ইত্যাদি প্রস্তত নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। অধিকন্তু বিজেআরআই উদ্ভাবিত পাটশাক ও সবজি মেস্তায় এন্টি-অক্সিডেন্টসহ বিভিন্ন ঔষধিগুণসমৃদ্ধ হওয়ায় মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বিজেআরআইয়ের পাটের শিল্প/কারিগরি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রায় অর্ধ-শতাধিক বহুমুখী পাটপণ্য ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে- যার মধ্যে ৩০টি প্রযুক্তি ইতোমধ্যে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণে এবং রপ্তানিযোগ্য পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে পাটবস্ত্র তৈরির নিমিত্তে চিকন সুতা উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের জন্য রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন করে বিভিন্ন প্রকার একক পাটজাত দ্রব্য এবং কৃত্রিম আঁশের সঙ্গে পাটের আঁশ মিশ্রিত করে বিভিন্ন পাটবস্ত্র উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় এবং স্বাস্থ্য উন্নত হাইড্রো কার্বনমুক্ত জুট বেস্নচিং অয়েল উন্নয়ন, জুট ফাইবারকে বিশেষ রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্নিরোধী পাটবস্ত্র, পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগের বিকল্প স্বল্প মূল্যের হালকা পাটের শপিং ব্যাগ এবং রট-প্রম্নফ জুট নার্সারি পট, পাটের উল এবং পাটজাত শোষক তুলা উদ্ভাবন করেছে বিজ্ঞানীরা। পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাকৃতিক উৎস হতে রং আহরণ করে পাটপণ্য রঞ্জন পদ্ধতি, জুট-পস্নাস্টিক কম্পোজিট, স্বল্প খরচে ঔষুধি ক্যারিয়ার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত মাইক্রোক্রিস্টালাইন সেলুলোজ, পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল উদ্ভাবন করা হয়েছে। জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জুট প্রসেসিং সিস্টেমের পরিবর্তে কটন প্রসেসিং সিস্টেমে পাটকে ব্যবহারের মাধ্যমে বহুমুখী পাটপণ্য ব্যবহার বিষয়ক গবেষণা চলমান রয়েছে।
কৃষকদের সময়োপযোগী চাহিদা ও প্রয়োজন মোতাবেক অঞ্চলভিত্তিক পাটের কৃষি গবেষণার জন্য মানিকগঞ্জে ১০৪ একর জমিতে পাটের কেন্দ্রীয় কৃষি পরীক্ষণ কেন্দ্রের পাশাপাশি দেশের রংপুর, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ ও কুমিলস্নায় চারটি আঞ্চলিক পাট গবেষণা কেন্দ্র এবং নারায়ণগঞ্জ, যশোর ও পটুয়াখালীতে তিনটি পাট গবেষণা উপকেন্দ্র এবং দিনাজপুরে একটি পাটবীজ উৎপাদন ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া জামালপুরের মাদারগঞ্জে স্থাপিত নতুন উপকেন্দ্রে খুব শিগগিরই গবেষণা কার্যক্রম শুরু করবে বিজেআরআই। এতদ্ব্যতীত, দেশি-বিদেশি বীজ সংরক্ষণ ও উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য ইন্টারন্যাশনাল জুট অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের বিশ্বের একমাত্র 'জিন ব্যাংক' ১৯৮২ সালে বিজেআরআইতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ জিন ব্যাংকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত পাট ও সমগোত্রীয় আঁশ ফসলের প্রায় ৬০০০-এর অধিক জার্মপস্নাজম সংরক্ষিত আছে।
বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে অধিক পরিমাণ উর্বর জমি খাদ্যশস্য চাষের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পাট চাষ ক্রমাগত প্রান্তিক ও অনুর্বর জমিতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তথাপি পাটের জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটস প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পাটের কৃষি ও কারিগরী গবেষণায় উৎকর্ষ সাধন করে এর উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যতা বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। নতুন নতুন পাটপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে পাটকে আজ বিশ্ব দরবারে যথেষ্ট জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত পণ্যে পরিণত করছে। বাংলাদেশের পাটশিল্পের অভিজ্ঞতা শতবর্ষ পুরনো, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিনকোড আবিষ্কারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন। বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের নতুন সম্ভাবনা ও আমাদের দেশের উন্নতমানের পাট এ দুই হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলে সোনালি আঁশের হারানো সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ডক্টর মো. আল-মামুন: কৃষিবিদ, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।