চরাঞ্চলের কৃষি

সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

এক সময় চর নিয়ে চলত দখলবাজদের ক্ষমতার লড়াই। অন্ধকার সেই পথ পাড়ি দিয়ে চরাঞ্চলে এখন কেবলই আশার আলো। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে চরাঞ্চলের উৎপাদিত সবজি এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। পরীক্ষামূলক আবাদকৃত কয়েকটি সবজির ফলনে আশাতীত সাফল্য পাওয়ায় দেশের চরাঞ্চল নিয়ে কৃষি অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চর সাধারণত দুই ধরনের- দ্বীপচর এবং সংযোগ। দ্বীপচর হলো- নদীর মধ্যে শুধু বালুরাশির দ্বীপ, যার চারপাশে সারা বছর পানি থাকে। আর সংযোগ চর হলো- সাধারণ প্রবাহে নদীতীরের সঙ্গে মূল ভূখন্ডের সংযোগ থাকে। লিখেছেন এস এম মুকুল

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
১ হাজার ৭২২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত নদীর হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল গতিশীলতার উপজাত হিসেবে অথবা নদীতীরের ভূমি ক্ষয় ও ভূমি তৈরির ফলে চর সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলের ৩১টি জেলার মোট ১১০টি উপজেলায় ১৬ শতাংশের ওপর এবং ১০৬টি উপজেলায় ৮-১৫ শতাংশে আংশিক চরাঞ্চল বিরাজমান। জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১৬ শতাংশ চরভূমি। এসব চরভূমিতে প্রায় কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশ শত শত নদী অববাহিকার দেশ। জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক নিয়মে এসব নদীর বুকে অসংখ্য চর জেগে ওঠে। কারণ বাংলাদেশের নদীগুলো উত্তরের হিমালয় থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর অবধি প্রতি বছর কোটি কোটি টন বালি ও কাদা বয়ে নিয়ে আসে। চরাঞ্চলের উন্নয়নে কৃষি চরাঞ্চলে মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন কৃষি। বেশির ভাগ চরে ধান, ভুট্টা, পাট, গম, বাদাম, পেঁয়াজ, মরিচ, কুমড়া, টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি উৎপাদিত হয়। চরাঞ্চলে গো-পালনের খরচ অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক কম বলে এখানে গরু পালনের হার বেশি। সিরাজগঞ্জ ও পাবনার সব চরই এখন গরু পালনের জন্য আদর্শ জায়গা ও এলাকায় পরিণত হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলায় প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকার চার শতাধিক চরে বাদামের চাষ হচ্ছে। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলগুলোয় ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে চীনাবাদামের চাষ হয়। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও কালিহাতী উপজেলায় যমুনা নদীর বুকে গড়ে ওঠা বালুচরে চীনাবাদাম চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এ চরের প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমিতে বাদামের চাষ হচ্ছে। বাদাম ছাড়া চরের এসব জমিতে অন্য ফসল আবাদের উপায় খুঁজতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা চালু রয়েছে। রংপুর ও কুড়িগ্রামের তিস্তা নদীর পাড়ে মিষ্টি কুমড়া আবাদের উপায় বের করেছে কেয়ার বাংলাদেশ ও প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন। তিস্তা চরের বালিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের সহায়তায় চরের চাষীদের বিশেষ পদ্ধতিতে কুমড়া উৎপাদন বিশ্বখ্যাতি পেয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় গড়ে ওঠা ছোট-বড় বিভিন্ন চরে এখন অক্সফাম জিবির সহায়তায় ক্ষুদ্র আকারে গরু, ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগির অসংখ্য খামার গড়ে উঠেছে। এসব কার্যক্রম থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে চরের দরিদ্র মানুষ। খাদ্য নিরাপত্তায় শস্যভান্ডার চর এলাকায় ফসলের নিবিড়তা ১৫০-১৮৫ শতাংশ। মূল ভূখন্ডের চেয়ে অস্থায়ী চর সাধারণত কম উৎপাদনশীল। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ চরের জমি আকস্মিক বন্যাকবলিত হয়ে ভেঙে, বালিমাটি দ্বারা ঢেকে বা ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। দেশের বিভিন্ন চরে পরিবেশসম্মতভাবে সবজি চাষ বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চরের জমিতে সবজি চাষ করে কৃষকদের অভাব দূর হচ্ছে। প্রতিবিঘা জমিতে বিভিন্ন সবজি উৎপাদন করে বছরে ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি লাভ করতে পারছেন। এর বাস্তব চিত্র দেখা যাবে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার দুর্গম যমুনার বিভিন্ন চরে। সেখানে হচ্ছে আধুনিক পদ্ধতিতে মাচায় সবজি চাষ। এই চাষের মধ্য দিয়ে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, সবজি উৎপাদন চরের কৃষকদের মধ্যে নতুন এক উদ্দীপনা তৈরি করেছে। কৃষকরা সবজি বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন। অক্সফাম ইন বাংলাদেশের পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স ম্যানেজার এসএম মনজুর রশীদ বলেন, দেশের চরের কৃষি অপার এক সম্ভাবনার জায়গা। কিন্তু বহুবিধ কারণেই চরের উন্নতকৃষি ব্যবস্থাপনায় এখনো নানান ধরনের জটিলতা বিদ্যমান। চরের কৃষিসেবা ও ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকীকরণের মধ্যদিয়ে অধিকহারে খাদ্য উৎপাদনের প্রচেষ্টা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দরকার বিনিয়োগ চরের কৃষিতে অধিক হারে বিনিয়োগ করা হলে দেশের খাদ্যচাহিদার বিরাট অংশ পূরণ করা সম্ভব। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর তাই চরের কৃষিজমি এবং কৃষকের প্রতি আরও নজর দেয়া এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। চর কৃষি সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আরও যা যা করণীয় হতে পারে- লবণাক্ত এলাকার চরগুলোতে পাটসহ লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফসল উৎপাদনের চিন্তাভাবনা করা দরকার। চরাঞ্চলে ছাগল, মহিষ, ভেড়া ও উন্নত জাতের গরু পালনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এনজিওর মাধ্যমে কুটিরশিল্পভিত্তিক উৎপাদনশীল কাজের ব্যবস্থা করা। একটি চর একটি কো-অপারেটিভ সোসাইটি গঠন করা। দেশের চরাঞ্চলে কৃষকদের ভূমির মালিকানা লিজভিত্তিক করা। চরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেয়া। চরাঞ্চলের গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি করা। কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে চরাঞ্চলে কৃষি প্রদর্শণী পস্নট করা যেতে পারে। যাতে কৃষকরা চরবান্ধব ফসল চাষবাস করতে আগ্রহী হয়। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের চরের কৃষকদের সাথে সভা-সমাবেশ বাড়াতে হবে। চরাঞ্চলে আরেকটি সম্ভাবনার জায়গা হলো গবাদি পশুপালন। কিন্তু দেশের সব চরে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উৎপাদিত পণ্যের বিপণন প্রক্রিয়ায় এখনো নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। ফলে চরে যে বিস্তীর্ণ আবাদি জমি রয়েছে সেখানে সেই মাত্রায় অধিক ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চরাঞ্চলে নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তির অভাব, উন্নতমানের বীজের সংকট, উন্নত জাতের ফসল চাষের প্রচলন না থাকা, সেচ সংকট এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা এবং কৃষকদের দ্রম্নত ঋণ সহায়তা পাওয়ার ব্যবস্থা না থাকা। \হ লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক