হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ পাল্টে দেবে সামগ্রিক কৃষি
জনবহুল দেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম কিংবা নেই সেখানে ঘরের ছাদে বা আঙিনায়, পলি টানেল, নেট হাউসে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন সম্ভব। এই পদ্ধতিতে সারা বছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব। উৎপাদিত সবজি ও ফলে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না বলে এ সবজি ও ফল নিরাপদ যার বাজারমূল্যও অধিক। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সাফল্যজনকভাবে ক্যাপসিকাম, লেটুস, টমেটো, শসা, ক্ষীরা, স্ট্রবেরি, বেগুন এবং বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপন্ন করা সম্ভব। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে মাটি ছাড়া ভিন্ন মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করে দেশে খাদ্যের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
প্রকাশ | ১৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
দেশের কৃষিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটছে। এমন একটি প্রযুক্তি হলো হাইড্রোপনিক। হাইড্রোপনিক একটি অত্যাধুনিক ফসল উৎপাদন পদ্ধতি। ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পানিতে যোগ করে সেই পানিতে ফসল উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় হাইড্রোপনিক ফার্মিং। এ পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াও গাছ উৎপাদন করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় ফসলের সব খাদ্য উপাদান দ্রবণে মিশিয়ে সেখানে গাছ রোপণ করা হয়। আবার কখনো কখনো মাটি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে চারা রোপণ করে তাতে খাদ্য উপাদান স্প্রে করেও হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এটি একটি অত্যাধুনিক ফসল চাষ পদ্ধতি।
ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেক আগে থেকেই বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এ পদ্ধতি এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে। জনবহুল দেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম কিংবা নেই সেখানে ঘরের ছাদে বা আঙিনায়, পলি টানেল, নেট হাউসে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন সম্ভব। এই পদ্ধতিতে সারা বছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব। উৎপাদিত সবজি ও ফলে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না বলে এ সবজি ও ফল নিরাপদ যার বাজারমূল্যও অধিক। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সাফল্যজনকভাবে ক্যাপসিকাম, লেটুস, টমেটো, শসা, ক্ষীরা, স্ট্রবেরি, বেগুন এবং বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপন্ন করা সম্ভব।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে মাটি ছাড়া ভিন্ন মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করে দেশে খাদ্যের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে একদিকে যেমন অনূর্বর এবং উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার জায়গা ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ফসল উৎপাদন করা যাবে- তেমনি শহরেও বদ্ধ জায়গায় উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন করে লাভবান হওয়া সম্ভব হবে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব এবং এ চাষে কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম বিধায় ফসলে কোনো বালাইনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।
সাধারণত দুটি উপায়ে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়, সঞ্চালন পদ্ধতি ও সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি। সঞ্চালন পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানসমূহ যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকিতে নেয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন অন্ততঃপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রথম বছর ট্রে, পাম্প এবং পাইপের আনুসঙ্গিক খরচ একটু বেশি হলেও পরবর্তী বছর থেকে শুধু রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন হয়। ফলে দ্বিতীয় বছর থেকে খরচ অনেকাংশে কমে যায়।
সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উৎপাদন করা হয়। এই পদ্ধতিতে খাদ্য উপাদান সরবরাহের জন্য কোনো পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবণ ও এর ওপর স্থাপিত কর্কশিটের মাঝে ৫ থেকে ৭ সেমি পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে এবং কর্কশিটের উপরে ৪-৫টি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যাতে সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কর্কশিটের ফাঁকা জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। ফসলের প্রকারভেদে সাধারণত ২-৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করতে হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে পস্নাস্টিক বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল ইত্যাদি ব্যবহার করেও বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করতে পারে। এতে খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির লক্ষণীয় বিষয়সমূহ হলো দ্রবণের পিইচের মাত্রা ৫.৮-৬.৫ এবং ইএইচের মাত্রা ১.৫-২.৫ ডিস/ এম এর মধ্যে রাখতে হবে। এছাড়াও গাছের খাদ্য উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। দ্রবণের আদর্শ তাপমাত্রা রক্ষা করতে হবে। সাধারণত দ্রবণের তাপমাত্রা ২৫-থেকে ৩০ সি.-এর মধ্যে হওয়া বাঞ্চনীয়। জলীয় খাদ্য দ্রবণে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। চাষের স্থানে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের সুব্যবস্থা থাকতে হবে এবং রোগমুক্ত চারা ব্যবহার করতে হবে। কোনো রোগাক্রান্ত গাছ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা তুলে ফেলতে হবে। চাষকৃত ফসলে কখনো কখনো পোকা মাকড়ের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। এজন্য প্রতিদিন তদারকির মাধ্যমে এদের দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন এটি নিয়ে গবেষণা করছেন। হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চাষাবাদে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা যেসব ফসল চাষে সফলতা পেয়েছেন তার মধ্যে পাতা জাতীয় সবজি লেটুস, গিমাকলমি, বিলাতি ধনিয়া ও বাঁধাকপি; ফল জাতীয় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, শসা, ক্ষিরা, ক্যাপসিকাম, মেলন ও স্কোয়াস প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। ফলের মধ্যে আছে স্ট্রবেরি এবং ফুলের মধ্যে অ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড ও চন্দ্রমলিস্নকা প্রভৃতি। বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভিত্তিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সারা বছর উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন করছে। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে এগিয়ে এসেছে। আগামী দিনে হাইড্রোপনিক ফার্মিং পাল্টে দেবে বিশ্বের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থা।
লেখক: চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।