দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ

প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

ইমরান ছিদ্দিকি
ভুট্টা চাষে কম সময়েই সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যান্য খাদ্যশস্যের চেয়ে কম পরিচর্যা ও কম সেচ খরচে ভালো ফলন হয় এবং দামও ভালো পাওয়া যায় বলে ভুট্টা চাষে কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ফলে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বাড়ছে। মাত্র পাঁচ বছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ফলনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। দেশের প্রাণী খাদ্যের বাজার এখন ভুট্টার ওপর নির্ভরশীল। মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার খাবারের চাহিদাও বাড়ছে। দেশের শতাধিক কোম্পানি এসব খাদ্য প্রস্তুত করছে। পাশাপাশি ভুট্টা চাষ, মানুষের বিভিন্ন খাদ্য তৈরি, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতসহ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। সবমিলিয়ে দেশে এখন ভুট্টার বাণিজ্য বড় হতে চলছে। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দশ গুণ। দেশে বিগত পাঁচ বছরে ভুট্টার উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে ২৭ লাখ টন হতে ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার সর্বাধিক ফলন ১১ টন। আর বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার ফলন হয়েছে পৌনে ১০ টন, যা বিশ্বে তৃতীয়। ২০০৮-০৯ সালে ভুট্টার উৎপাদন যেখানে মাত্র ৬ লাখ টন ছিল, তা বেড়ে ৬৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বিগত এক যুগে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। দেশে প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এতে ভুট্টার একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। চাহিদা থাকায় চাষ বাড়ছে। ফলনেও সাফল্য এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছে, উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারের ফলে এ অঞ্চলে ভুট্টার সর্বোচ্চ ফলন হয় বাংলাদেশে। ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টন। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় সাড়ে ৫৬ লাখ টনে। দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। দেশে গত কয়েক বছরে ভুট্টার উৎপাদনশীলতা বেশ বেড়েছে। এখন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৯ দশমিক ৭৪ টন ভুট্টার ফলন হচ্ছে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। হেক্টরপ্রতি সবচেয়ে বেশি ফলনের রেকর্ড তুরস্কের। সেখানে হেক্টরে সাড়ে ১১ টন ভুট্টার ফলন হয়। দেশে গ্রীষ্ম ও শীত দুই মৌসুমে ভুট্টা চাষ হয়। তবে মোট উৎপাদনের ৮৭ শতাংশই হয় শীত মৌসুমে। কিন্তু দেশে ভুট্টার চাহিদা থাকে সারা বছর। সারা বছরে শস্যটির চাহিদা থাকে ৭০ লাখ টনের বেশি। ভুট্টা চাষের পর সেই জমিতে আবার পাটের আবাদ করা হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে খরচ ও পরিশ্রম কম। মাছ বা অন্য প্রাণীজ খাদ্যের পাশাপাশি ভুট্টা খাবারের টেবিলেও জায়গা করে নিচ্ছে। বহুবিধ ব্যবহার বাড়ছে দানাদার এ শস্যের। সম্প্রতি বছরগুলোতে দেশে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদনও বেড়েছে। ভুট্টার কোনো অংশই ফেলে দিতে হয় না। উপরের পাতা গো-খাদ্য, ডালপালা জ্বালানি, মাড়াই করে ভুসি পোলট্রি খাবার ও আটা-ময়দা তৈরি হয়। ভুট্টা থেকে শিশু খাদ্য, গস্নুকোজ, বার্লি ও তেল হয়। ভুট্টার আটা-ময়দায় বিস্কুট ও পাউরুটি হয় সুস্বাদু। কাঁচা ভুট্টা পুড়িয়ে খাওয়া যায়। তৈরি হয় খই। ভুট্টার পপকর্ণ শহরাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। মানুষের জন্য নানারকমের খাবার তৈরি করা যায় ভুট্টা থেকে। রুটি, আটা বা গোল আলুর সঙ্গে মিশিয়ে রুটি, পুরি, ভুট্টার প্যানকেক, ভুট্টার বিস্কুট, ভুট্টা খিচুড়ি, ভুট্টা-চাল খিচুরি, ভুট্টা পোলাও, সবুজ ভুট্টার দানা, সিদ্ধ বা পুড়িয়ে অনেকভাবেই ভুট্টাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশে মূলত হাঁস-মুরগির ও গো-খাদ্য হিসেবে ভুট্টার দানা ব্যবহার করা হয় বেশি। মৎস্য খাদ্যেরও একটি অন্যতম উপকরণ হলো ভুট্টা দানার গুঁড়া। চিকিৎসকদের মতে, ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার পুষ্টিমান বেশি। ভুট্টা শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। এতে থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। ভুট্টায় বিদ্যমান ভিটামিন-এ এবং সি ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে। ভুট্টা শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, এতে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে। এটি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। ভুট্টাতে থাকা বিটা ক্যারোটিন চোখের দৃষ্টি বাড়াতে সাহায্য করে। একটি সূত্র জানায়, ভুট্টার বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ১০-১২ ভাগ। ভুট্টার তেল ভোজ্যতেল হিসেবে উত্তম। শিশু, গর্ভবতী মহিলা ও দুগ্ধপানকারী মায়ের জন্য ভুট্টার তেল উত্তম। তাছাড়া ভুট্টাতে ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম এবং সালফার এসব গৌণ খনিজ উপাদান বেশ ভালোই রয়েছে। চাষে শীর্ষ চুয়াডাঙ্গা জেলা আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চুয়াডাঙ্গায় ভুট্টা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বহুমুখী ব্যবহার ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিক লাভজনক হওয়ায় ভুট্টা এখন এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুয়াডাঙ্গায় ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। চাষিরা অর্থকরী এ ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবার রেকর্ড চাষাবাদ হয়েছে। তথ্যানুযায়ী দেশের সবগুলোর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুট্টা আবাদ হয় এ জেলায়। দেশে প্রতিনিয়ত ভুট্টার চাষ বাড়ছে। গত কয়েক বছরে ধানের দাম কম থাকায় ভুট্টা চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকের। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় হাসি ফুটছে কৃষকের মুখেও। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ভুট্টার উৎপাদন ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে ভুট্টায়। জমির উর্বরতা শক্তি, অনুকূল আবহাওয়ায় বাংলাদেশে ভুট্টার আবাদ ও উৎপাদন বাড়ছে। ভুট্টা উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ভুট্টা উৎপাদনের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই বিশ্বের মধ্যে ২য় অবস্থানটি বাংলাদেশের। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে হেক্টরপ্রতি ভুট্টায় গড় উৎপাদন ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এই হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রধান দানা ফসল ভুট্টা মেইজ, কর্ণ ও পপকন নামে পরিচিত। দেশে সবজি বিপস্নবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ভুট্টা বিপস্নব। বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধান দানাশস্য হিসেবে ভুট্টা গুরুত্বপূর্ণ ফসল হিসেবে অবদান রাখছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভুট্টা চাষের বড় সুবিধা হলো রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম ঘটে। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় ভুট্টা চাষে আর্থিক সচ্ছলতা আসছে কৃষকদের। আবাদ ও উৎপাদনে নেই কোনো ঝুঁকি। ফলনে গমের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি। দেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখায় অবদান রাখছে ভুট্টা। কৃষি খাতের জিডিপি গণনায় বিবেচিত ১২৮টি ফসলের মধ্যে আগে প্রধান শস্য হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হতো গম, পাট, আলু, আউশ, আমন ও বোরো ধানকে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভুট্টা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, গত এক দশকে দেশে ভুট্টার আবাদি এলাকা, উৎপাদন ও হেক্টরপ্রতি ফলন উলেস্নখযোগ্য হারে বেড়েছে। ধানের আবাদের চেয়ে ভুট্টার আবাদ অনেক লাভজনক হওয়ায় তার দেখাদেখি অনেকেই এ ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বিঘাপ্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হলেও ৩৫ থেকে ৪০ মণ পর্যন্ত ভুট্টা উৎপাদন সম্ভব। ভুট্টার শুকনো গাছ ও ভুট্টা মাড়াইয়ের পর তা জ্বালানি হিসেবে বাজারে বিক্রি করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। মজাদার চাইনিজ খাবার তৈরিতে অপরিহার্য যে কর্নফ্লাওয়ার ব্যবহৃত হয় তা ভুট্টারই অবদান। কচি অবস্থায় ভুট্টা সুপেও ব্যবহার করা যায়। সরকারও এখন ভুট্টা থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য তৈরিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। খাদ্যশিল্পে ভুট্টা ব্যবহারের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। দেশে প্রচুর কর্নফ্লাওয়ার, স্টার্চ প্রয়োজন হয়, সেটা আমদানি করা হচ্ছে। প্রাণী খাদ্য তৈরির বড় অংশই ভুট্টা থেকে আসে। এর মধ্যে মুরগির খাদ্য তৈরিতে ৫৫ শতাংশ ভুট্টার দরকার হয়। এ হার মাছের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ এবং গবাদিপশুর খাদ্যে ৩০ শতাংশ। শুধু এ তিন খাতে ভুট্টার চাহিদা রয়েছে বছরে ৪৫ লাখ টন। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে ভুট্টার তেল। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বছরে দেশে উৎপাদিত ৫৪ লাখ টন ভুট্টা থেকে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টন ভুট্টার তেল আহরণ করা সম্ভব। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা যার বাজার মূল্য। ইনস্টিটিউটের তথ্যে আরও জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৫২টি দেশে ভুট্টা থেকে উৎকৃষ্ট মানের ভোজ্যতেল উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হয়। ভুট্টার তেল স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। এতে কোনো আমিষ বা শর্করা নেই, চর্বি বিদ্যমান শতকরা ১০০ ভাগই, অন্যান্য তেলের চেয়ে যার পুষ্টিমান তুলনামূলকভাবে বেশি। ভুট্টার তেলে বিদ্যমান সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলের সমপরিমাণ। ভুট্টার তেলে ভিটামিন 'ই' (টোকোফেরল)-এর পরিমাণ সূর্যমুখী তেলের চেয়ে বেশি। বিশেষত ভুট্টার তেলে ভিটামিন কে (১.৯ মাইক্রো গ্রাম) রয়েছে যেখানে সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলে তা অনুপস্থিত। হঠাৎ করেই কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়েছেন। চরাঞ্চল ও পতিত জমিতে ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। বর্তমানে যেসব ভুট্টার বীজ উদ্ভাবন করা হয়েছে তাতে করে সারা বছরই ভুট্টার আবাদ করা যাবে। ফলে দেশের যে চাহিদা তা অনায়াসেই উৎপাদিত হবে। ভুট্টা চাষের পর সেই জমিতে আবার পাটের আবাদ করা হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে খরচ ও পরিশ্রম কম। আমার এলাকায় আগের থেকে ভুট্টার উৎপাদন যে বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। তবে ভুট্টা উৎপাদনের অর্ধেকই হয় রংপুর বিভাগে। উৎপাদনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ। জেলা হিসেবে দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে ভুট্টার উৎপাদন বেশি।