গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে ব্রির বিজ্ঞানীদের গবেষণা সাফল্য

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও হ্রাস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং অনেক গবেষণা চলমান আছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) মাঠে ধানক্ষেত থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও হ্রাসের ওপর নিবিড় গবেষণা ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে। ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীরা জানান, এই গবেষণায় ধান চাষাবাদে প্রায় ৩৫% কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছেন তারা...

প্রকাশ | ৩১ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও পৃথিবীর উষ্ণতায়। বায়ুমন্ডলের যে সব গ্যাস তাপীয় অবলোহিত সীমার মধ্যে বিকিরিত শক্তি শোষণ ও নির্গত করে সে সব গ্যাসকে গ্রিনহাউস গ্যাস বলে। এটি গ্রিনহাউস প্রভাবের মৌলিক কারণ। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রাথমিক গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে আছে জলীয় বাষ্প, কার্বন-ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং ওজোন। গ্রিনহাউস গ্যাস ছাড়া পৃথিবী পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা হত -১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, বর্তমানে কমবেশি ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (সূত্র: মডার্ন গেস্নাভাল ক্লাইমেট চেঞ্জ-সায়েন্স-২০০৩)। সৌর জগতের বিভিন্ন গ্রহ যেমন- শুক্র, মঙ্গল ইত্যাদির বায়ুমন্ডলেও বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস রয়েছে। ১৭৫০ সালের দিকে শিল্প বিপস্নবের পর ২০১৭ সাল পর্যন্ত মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ড বায়ুমন্ডলে ৪০% কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধি করেছে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের এই বৃদ্ধির বেশির ভাগই ঘটেছে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি, কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ফলে। এ ছাড়াও বন উজার, ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন, ভূমিক্ষয় ও আধুনিক কৃষি চর্চাও এর জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হয়। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক সায়েন্স জার্নাল নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, বর্তমানে যে হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হচ্ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৪৭ সালের মধ্যে বাস্তু তন্ত্র (ইকোসিস্টেম) ও জীববৈচিত্র্য, বিভিন্ন প্রাণি ও মানুষের ওপর এর মারাত্মক খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বর্তমান নিঃসরণ হার ২০৩৬ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। ইন্টার গভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এর পঞ্চম মূল্যায়ন প্রতিবেদন-২০১৪ এ বলা হয় আগামী ২১০০ সালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে। ফলে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, যা স্বল্পোন্নত ও ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র মিলিয়ে প্রায় ১০০টি দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। গত কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের দেশে যে কয়েকটি বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ (সিডর, আইলা) দেখা দিয়েছে, তা জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দুটি দুর্যোগে আমাদের দেশের প্রায় ১,৪১,০০০ মিলিয়ন টাকার সমমূল্যের অবকাঠামোগত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু বিশ্লেষকদের মতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ঝুঁকির সূচকে থাকা দেশগুলোতে আরও ভয়াবহ দুর্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে প্রথম সারির তালিকায় রাখা হয়েছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা অনুধাবন করে সম্প্রতি অনুষ্ঠেয় প্যারিস জলবায়ু সম্নেলনে যোগ দেয়া ১৯৫টি দেশের সরকার প্রধানরা সর্বসম্মতভাবে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিচে রাখতে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও হ্রাস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং অনেক গবেষণা চলমান আছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) মাঠে ধান ক্ষেত থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও হ্রাসের ওপর নিবিড় গবেষণা ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে। ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীরা জানান, এই গবেষণায় ধান চাষাবাদে প্রায় ৩৫% কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য বৈশ্বিক উষ্ণনায়ন হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। বাংলাদেশে কৃষি জমির শতকরা ৮৫ ভাগ জমিতে ধান চাষাবাদ হয়। এ সমস্ত জমি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস যেমন- মিথেন (ঈঐ৪), কার্বন ডাইঅক্সাইড (ঈঙ২) ও নাইট্রাস অক্সাইড (ঘ২ঙ) নির্গত হয়। তবে, কৃষিতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন ও তার জৈবিক ব্যবহার প্রায় সমান থাকায় এর প্রভাব লক্ষ্যণীয় নয়। উলেস্নখ্য যে, মোট বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্র ১৪% কৃষি সেক্টর থেকে নির্গত হয়। বর্তমানে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের ঘনত্ব যথাক্রমে প্রায় ৪০৩ পিপিএম, ১৮৩৪ পিপিবি ও ৩২৭ পিপিবি, যা গত ১০০ বছরের তুলনায় যথাক্রমে প্রায় ৩৩%, ১০৯% ও ১৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, বাতাসে গ্রিনহাউসের ঘনত্ব যদি এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে আগামী ২১০০ সাল নাগাদ গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রায় ২-৩ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পাবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পিছু ছাড়ে না, সেখানে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে খরা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির কবলে এ দেশের কৃষি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের দেশে প্রধানত আমন ও বেরো মৌসুমে ধান চাষাবাদ হয়। আমন মৌসুমের (১৪.০ মিলিয়ন মেট্রিক টন) তুলনায় বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন (১৯.৯৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন) প্রায় দেড়গুন বেশি। তবে বোরো মৌসুমের ধান চাষাবাদ সম্পূর্ণভাবে সেচের পানির ওপর নির্ভরশীল। তাই আমাদের দেশের কৃষকরা বোরো মৌসুমে ধান ফলানোর জন্য লাগাতার ভুগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে। এতে একদিকে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে, যা ভূমিধসের কারণ হতে পারে, জীব বৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ধান ক্ষেত থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস পরিমাপ করছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে, পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকনো পদ্ধতি (অডউ; ধষঃবৎহধঃব বিঃঃরহম ধহফ ফৎুরহম) প্রায় ৪০% মিথেন গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে পারে। তবে এই পদ্ধতিতে কিছুটা নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধি পায়, যার পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গমন হ্রাসের তুলনায় অতি নগণ্য। সুতরাং পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকনো পদ্ধতি সবসময় পানি দাড়ানো (পড়হঃরহঁড়ঁং ভষড়ড়ফরহম) জমির ধান ক্ষেতের তুলনায় প্রায় ৩৫% কার্বন ডাইঅক্সাইড সমতুল্য এষড়নধষ ডধৎসরহম চড়ঃবহঃরধষ হ্রাস করতে পারে। তাই, ধান চাষাবাদের জন্য আমাদের দেশে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকনো পদ্ধতির ব্যাপক সম্প্রসারণ করতে হবে। এতে একদিকে যেমন সেচের পানি সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে এটি ধানের জমি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন হা্রস করবে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম মফিজুল ইসলাম ওই বিষয়ের ওপর তার পিএইচডি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকনো পদ্ধতি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনবিষয়ক গবেষণা বাংলাদেশে এটিই প্রথম। ধান ক্ষেত থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার ক্ষেত্রে এ গবেষণা বাংলাদেশের জন্য ইধংবষরহব ঊসরংংরড়হং ঋধপঃড়ৎ হিসেবে কাজ করবে। তা ছাড়া এ ফলাফল ঘধঃরড়হধষ এঐএ ওহাবহঃড়ৎু তৈরির জন্য উলেস্নখযোগ্য অবদান রাখবে। এই গবেষণা টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- আইএফডিসির মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ড. ইয়াম কান্তা গাইরে, ব্রির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নাঈম আহমেদ, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. রফিকুল ইসলাম। ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন হ্রাসের জন্য পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকনো পদ্ধতির সুফল ব্যাপকভাবে কৃষকের মাঝে অতিদ্রুত সম্প্রসারণ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, এ পদ্ধতি একদিকে যেমন ২৫-৩০% পানি সাশ্রয়ী করে, অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার মতে এই গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে এখন থেকে আমরা জলবায়ুবিষয়ক বিশ্ব সভায় আমাদের দাবি আরো জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারব। লেখক : উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর