কৃষি সমৃদ্ধিতে ক্রপ জোনিং

প্রকাশ | ১২ মে ২০১৯, ০০:০০

ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে দ্রম্নতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাদযোগ্য জমি কমে যাওয়ায় গবেষণার সঙ্গে মাঠপর্যায়ে ফলনের পার্থক্য কৃষি সম্পদ তথ্য উপকরণ ব্যবহারে কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে এই শতাব্দীর কৃষি। কৃষির উৎপাদনশীলতা মুনাফা উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অধিকতর দক্ষ ও টেকসই কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা উদ্ভাবন অতি জরুরি। এটি কৃষিসম্পৃক্ত জাতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যা সঠিক পরিকল্পনায় প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং যথাযথ প্রযুক্তি অনুসরণের মাধ্যমে কৃষি জমির যৌক্তিক লাভজনক ব্যবহার নিশ্চিত করে মোকাবেলা করা সম্ভব। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কৃষি জমির যৌক্তিক ও লাভজনক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রথম ও প্রধানতম পদক্ষেপ হলো বিভিন্ন ফসলের সর্বাধিক উৎপাদনক্ষম এলাকা শনাক্তকরণ। অর্থাৎ এসব এলাকা যেখানে মাটি ও জলবায়ু কোনো বিশেষ নির্দিষ্ট ফসল আবাদের জন্য অতি উপযোগী। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম। এ দেশ পৃথিবীর দারিদ্র্য দেশগুলোর একটি। ২০৩০ সালে ১৯ কোটি জনসংখ্যার জন্য শুধু দানাদার ৪ কোটির বেশি টন খাদ্য প্রয়োজন হবে। তাই বর্তমান দানাদার ফসলের হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ২.৮ টন থেকে ৪ টনে নিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে ২০১৫ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দরিদ্রতা অর্ধেকে নামানোর কথা। কিন্তু খাদ্য মূল্যবৃদ্ধি, দরিদ্রতা, অসম খাদ্য বণ্টনের কারণে এটি ২১৫০ সালের আগে অর্জিত হবে না বলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধান জানান। ক্রপ জোনিং কী? মাটির ধরন, অনুকূল আবহাওয়া, কৃষকের চাষাবাদ জ্ঞান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে লাভজনকভাবে নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট ফসল চাষাবাদ করার বিষয়টি হচ্ছে ক্রপ (শস্য) জোনিং। ধরি 'ক' এলাকায় বা কৃষিবস্নকে টমেটো চাষ লাভজনক এবং টমেটোর চাষাবাদ করতে কৃষকরা আগ্রহী। তবে এই এলাকা বা কৃষিবস্নকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি দিয়ে যদি শুধুই টমেটো চাষ করা হয় তবে এটাই হলো ক্রপ জোনিং। সৃষ্টিকর্তা প্রাকৃতিক ক্রপ জোনিং অনেক এলাকায় সৃষ্টি করেছেন। যা এখন আমাদের সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে বেশকিছু জায়গায় কিছু কিছু পণ্য ভালো হয় যেমন- রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আম; সিলেট, মৌলভীবাজার ও পঞ্চগড়ে চা; বগুড়ায় মসলা; নওগাঁ ও দিনাজপুরে সুগন্ধি চাল; রংপুর, বগুড়া, মুন্সীগঞ্জ ও রাজশাহীতে আলু; ময়মনসিংহ নরসিংদীতে কলা এসব। আবার বিভিন্ন উপজেলা প্রেক্ষাপট লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়িতে টমেটো ও ডাল; বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে মরিচ; নাটোরের গুরুদাসপুরে রসুন; জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায় আলু; চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় উন্নত আম এসব। সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, মাটি, আবহাওয়া, কৃষকের চাষ করার পদ্ধতির কারণে নির্দিষ্ট জায়গাতে নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদন করলে লাভবান হওয়া যায় এবং মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করা যায়। যা ক্রপ জোনিং ধারণাকে উৎসাহিত করে। ক্রপ জোনিং জেলাভিত্তিক, উপজেলাভিত্তিক, বস্নকভিত্তিক বা একটি বড় এলাকাভিত্তিক নানাভাবে হতে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশে আইপিএম, আইসিএম, আইএফএমসি নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে তবে এ পদ্ধতিগুলোর ফলাফল তখনই কাঙ্ক্ষিত হবে যখন একটি বড় এলাকার কৃষকরা সবাই অনুমোদিত প্রযুক্তি গ্রহণ করবে। এটিও ক্রপ জোনিংকেই উৎসাহিত করে। ক্রপজোনিংয়ের সুবিধা ক্রপ জোনিং কৃষি সম্প্রসারণে কাজে সহায়ক হবে, গতি আসবে কৃষক প্রশিক্ষণ দিতে সুবিধা হয় ফলে কৃষক নতুন প্রযুক্তি তাড়াতাড়ি গ্রহণ করতে পারে। কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি ক্ষেত্রে বীজ, সার, বালাইনাশক ডিলারদের দৌরাত্ম্য কমে। কারণ কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির সুযোগ কম এবং কৃষক কারিগরি জ্ঞানে এগিয়ে থাকার জন্য সহজে অন্য পণ্য ডিলাররা বিক্রয় করতে পারে না। ফসলে রোগ, পোকামাকড় কম হয়। কারণ এক ধরনের পোকা দমন বিভিন্ন পোকা দমন অপেক্ষা সহজ। এ ছাড়া এক জমির পোকা অন্য জমিতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে না। উদ্যোক্তা উন্নয়নে সহায়ক, কাঁচামাল প্রাপ্তিতে সমস্যা হয় না সময়মতো পাওয়া যায়। এতে শিল্পোদ্যোক্তা নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করতে পারে। বীজ ও সার সঙ্কট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। কারণ আগ থেকে পরিসংখ্যান থাকবে কখন কোন জায়গায় কতটুকু বীজ-সার প্রয়োজন হবে। সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হবে। শিল্পের বিকাশ ঘটে কারণ কাঁচামাল পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে। পণ্য পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। কারণ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের পরিবহনব্যবস্থা বিভিন্ন ধরনের। শস্য বহুমুখিতা, শিল্পের বিকাশ এসব কারণে বেকার সমস্যায় ভূমিকা রাখতে পারবে। কৃষকদের কিছু ফসলের সঠিক উৎপাদন কৌশল জানা সহজ। যেহেতু এ ধরনের কৃষিব্যবস্থায় নির্দিষ্ট কয়েকটি ফসল সম্পর্কে কৃষক ধারণা লাভ করবে তাই পণ্যের মানোন্নয়নে সহায়ক হয়। কারণ মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করতে বিভিন্ন কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। সারাবছর শ্রমিকের কাজ থাকে সঙ্গে সঙ্গে শহরমুখিতা রোধ হবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে কারণ বিদেশ থেকে মসলা, শাক-সবজি কিনে আনতে হবে না। কৃষকের তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানের উন্নয়ন ঘটবে কারণ অল্প তথ্য সঠিক সময়ে দেয়া সম্ভব হবে। বহুপাক্ষিক চুক্তি হয় বলে টেকসই কৃষি গড়ে ওঠে। কারণ কৃষি লাভজনক হবে এবং বড় বড় কোম্পানি কৃষির সঙ্গে যুক্ত হবে। শস্য বহুমুখিতা দেখা দেবে। কারণ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ফসল উৎপাদিত হবে। ক্রপ জোনিংয়ের উদ্যোগ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার প্রেক্ষাপটে কৃষি ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ভূমি সম্পদের যৌক্তিক লাভজনক ব্যবহারের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার কাউন্সিল (বিএআরসি) ডেভেলপমেন্ট অব উপজেলা ল্যান্ড সুইটাবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড ক্রপস জোনিং সিস্টেম অব বাংলাদেশ শীর্ষক প্রকল্পটি কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তা বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ফসল উপ-খাতের নীতি ও কৌশলের সঙ্গে এর প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ যেখানে ক্রপস জোনিং এবং ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এসডিজির একটি লক্ষ্য হলো প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষব্যবস্থাপনাও পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ। প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, ভূমি ও পানি সম্পদের বিচক্ষণ যৌক্তিক ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিতকরণ ক্রপ জোনিংয়ের মূল প্রতিপাদ্য। এ চলমান প্রকল্পে উপজেলাভিত্তিক ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ তথ্যউপাত্ত ভূমির উপযোগিতা নিরূপণ ও ক্রপ জোনিং নির্ধারণের কাজে ব্যবহৃত হবে যা স্থানীয় পর্যায় কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পরিশেষে ক্রপ জোনিং করা তখনই সম্ভব হবে যখন সুচিন্ততভাবে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলকে বিভিন্ন ফসলের আওতায় ভাগ করা হবে। তবে ধান যেহেতু বাংলাদেশের প্রধান ফসল তাই একে বাদ দিয়ে অন্য ফসলের উন্নয়ন কখনই কাঙ্ক্ষিত হবে না। সিলেট এবং দক্ষিণাঞ্চলে জমিকে ধানের আওতায় নিয়ে আসা যায় ও উত্তরাঞ্চলের তুলনামূলক উর্বর জমির কিছুটা অংশ ধান থেকে বিভিন্ন উচ্চমূল্য ফসল- ফলমূল, শাকসবজি, চা, আলু এসবের আওতায় আনা সম্ভব হবে তবে ধানের উৎপাদন যেমন ঠিক থাকবে তেমনি বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে খাদ্য এবং পুষ্টির নিরাপত্তা অর্জিত হবে। আর ক্রপ বা শস্য জোনিং করলে জনসংখ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থেকে দেশকে খাদ্য নিরাপত্তার দিকে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। বিবর্তনের পথপরিক্রমায় নগরায়ণ ও শিল্পায়নের সঙ্গে কমে যাচ্ছে কৃষিজমি। অল্প জমিতে অধিক ফলন ফলাতে লাগসই ও টেকসই কৃষির অপরিহার্যতা আবশ্যকীয়তা প্রশ্নাতীত। জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপযোগী কৃষির উন্নয়ন করাটা সবিশেষ জরুরি। মানুষের খাদ্যের সংস্থান করতে হলে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। ক্রপ জোনিং করে ফসল উৎপাদন করাটা এখন সময়ের দাবি। লেখক: অতিরিক্ত পরিচালক, ক্রপস উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঢাকা।