দুগ্ধশিল্পের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

দুধ সব বয়সের মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এতে রয়েছে আমিষ, শর্করা, চর্বি, অসংখ্য খনিজ উপাদান এবং ভিটামিনের এক চমৎকার সংমিশ্রণ, যে কারণে দুধকে বলা হয় আদর্শ খাবার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ- যা নিকট ভবিষ্যতে দেশকে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণকরণের এক বিশাল হাতছানি। কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে উদীয়মান দুগ্ধশিল্প আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখে...

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

ড. এম এ হান্নান
তরল দুধে ভারী ক্ষতিকর ধাতুর উপস্থিতির খবর সম্পূর্ণ সত্য নয় - যাযাদি
মানুষসহ পৃথিবীর সব স্তন্যপায়ী প্রাণীই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যে খ্যাদ্যটি গ্রহণ করে তা হলো দুধ। মায়ের দুধের পর মানুষ সাধারণত গরু, মহিষ, ছাগল বা ভেড়ার দুধ পান করে থাকে। দুধ সব বয়সের মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এতে রয়েছে আমিষ, শর্করা, চর্বি, অসংখ্য খনিজ উপাদান এবং ভিটামিনের এক চমৎকার সংমিশ্রণ, যে কারণে দুধকে বলা হয় আদর্শ খাবার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ- যা নিকট ভবিষ্যতে দেশকে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণকরণের এক বিশাল হাতছানি। কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে উদীয়মান দুগ্ধশিল্প আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক পাস্তুরিত দুধের ১০টি নমুনা পরীক্ষা করে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিন, এনরোফ্লক্সাসিন এবং লেভোফ্লক্সাসিন অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির কথা সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে অবগত করেন। অবশ্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) বলছে, দুধে ভারী ক্ষতিকর ধাতুর উপস্থিতির যে খবর সব জায়গায় ছেয়ে গেছে তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। যারা এ তথ্য প্রকাশ করেছে তাদের গবেষণার সে সক্ষমতা নেই। তাই দুধের ব্যাপারে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যে ৮টি দুধের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করেছে এবং নমুনা ভারতের চেন্নাইতে এসজিএস আন্তর্জাতিক মানের ল্যারেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত যে ৮টি দুধ (মিল্ক ভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, ঈগলু, আরডি, সাভার ডেইরি ও প্রাণ) নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদার্থ পাওয়া যায়নি। বাকি যে ছোট বড় দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি রয়েছে তাদের দুধের তেমন ক্ষতিকর কিছু নাও থাকতে পারে, তবে পর্যায়ক্রমে সব দুধের নমুনা পরীক্ষা করে এর ফলাফল সবাইকে জানানো হবে। মাঠপর্যায়ে কর্মরত ভেটেরিনারি ডাক্তারদের ভাষ্যমতে গবাদিপশুর চিকিৎসায় এনরোফ্লক্সাসিন এবং লেভোফ্লক্সাসিন অ্যান্টিবায়োটিক কখনো ব্যবহার করা হয় না; এই ২টি হলো মানুষে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক। কাজেই, প্রশ্ন হলো ওই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো দুধে প্রবেশের উৎস কি? পৃথিবীর অনেক দেশের গরুর দুধেই অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু পাওয়া যায় এবং একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত এদের উপস্থিতি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। আর সে জন্যই আন্তর্জাতিকভাবে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদানের জন্য নির্দিষ্ট গধীরসঁস জবংরফঁব খরসরঃ (গজখ)। হাইর্কোটের আদেশের পর কোম্পানিগুলো তরল দুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো- কৃষকের গাভিগুলো কি দুধ উৎপাদন এবং খাওয়া বন্ধ রাখবে? উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম গাভির দুধ বিক্রি করতে না পেরে আজ খামারিরা ভাষাহীন, প্রতিবাদ জানাচ্ছে সড়কে দুধ ঢেলে। গাভির জীবন বাঁচাতে কৃষক সর্বস্ব হারিয়ে হলেও উচ্চমূল্যের গোখাদ্য খাওয়াবে। অথচ কৃষককে বাঁচিয়ে আমরা দুধের ভেজাল নির্মূলের বিকল্প উপায় পেলাম না! বাজারের দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলকে সরব মনে হচ্ছে। খবরটি সাধারণ জনমনে এমন প্রভাব ফেলছে যেন দুধে অ্যান্টিবায়োটিক নয়- বিষের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু দুধে ক্ষতিকারক উপাদানের প্রকৃত উৎস এবং সেগুলো প্রবেশ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ তথা দেশকে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে করণীয় সম্পর্কে কথা বলার লোকের বড্ড অভাব। একইভাবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত নিম্নমানের গুঁড়া দুধের ভেজাল নির্ণয়েও আমাদের আগ্রহ কম। এই সমস্যাটি মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ডেইরি শিল্প ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের উৎস ও প্রবেশ রোধে করণীয় বিষয়ে আজও কোনো সভা বা সেমিনার জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হলো না। আমাদের সমস্যা হলো আমরা কোনো জাতীয় বা জনস্বাস্থ্য বিষয়ে একসঙ্গে বসে সম্মিলিত উদ্যোগ ও করণীয় ঠিক করতে পারি না। দুধের দূষণ সমাধানে যেমন আমরা একসঙ্গে বসতে পারি না- তেমনি বসতে পারি না ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের সমাধানেও। আর সে কারণেই দূষণ আজ সমাজের রন্ধেরন্ধে, শুধু গরুর দুধেই নয়। দুগ্ধশিল্প বিকাশে আরেকটি বড় বাধা হলো প্রান্তিক খামারিদের কাছে ভেটেরিনারি সেবার অপ্রতুলতা। বর্তমানে একটি উপজেলার ৭-৮ লাখ গবাদিপশু-পাখির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার জন্য মাত্র ১ জন ভেটেরিনারি ডাক্তার নিয়োজিত রয়েছেন। ভেটেরিনারি ডাক্তারের অভাবে খামারিরা গবাদিপশু-পাখিতে যাচ্ছেতাই বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করছে। এ ছাড়া অনেক সময় পশুপাখির চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পর নির্দিষ্ট রেসিডুয়াল পিরিয়ড না মেনে গাভির দুধ বিক্রি করছেন। পশুতে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কুফল সম্বন্ধে ভেটেরিনারি ডাক্তার কর্তৃক প্রান্তিক খামারিদের সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোকে দুধ সংগ্রহের পূর্বে আধুনিক যন্ত্র দ্বারা ক্ষতিকারক পদার্থের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে কেবল নিরাপদ দুধ সংগ্রহ করতে হবে। বর্তমানে হাজার হাজার বেকার ভেটেরিনারি ডাক্তার চাকরি প্রত্যাশায় হতাশ জীবনযাপন করছে। কাজেই, সরকারের উচিত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে অতিরিক্ত জনবল সংবলিত নতুন অর্গানোগ্রাম পাস করে প্রতি উপজেলায় কমপক্ষে ৬ জন করে ভেটেরিনারি সার্জন নিয়োগ দিয়ে খামারিদের দোরগোড়ায় ভেটেরিনারি সেবা পৌঁছে দেয়া। সম্প্রতি মানুষের চিকিৎসায় রেজিস্টার্ড ডাক্তারের এবং পশু-পাখির চিকিৎসায় রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ব্যতিত কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না এই মর্মে মহামান্য হাইকোর্ট ২টি আলাদা আদেশ জারি করেছেন। যাচ্ছেতাই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারায়। অধিকন্তু, মানুষ ও পশু-পাখিতে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্য চেইন ও পরস্পরের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। কাজেই, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিকের সুনির্দিষ্ট ও সীমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে হাইকোটের আদেশকে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নসহ আদেশ অমান্যকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপাত্ত মোতাবেক দুধের বর্তমান উৎপাদন বাৎসরিক চাহিদার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ (৬২.৫৮%)। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বিদেশ থেকে গুঁড়া দুধ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২৭০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরাম এ দেশে দুগ্ধ বিপস্নব ঘটনার লক্ষ্যে বিদেশি গুঁড়া দুধ আমদানি শুল্ক ৫০% করার দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু জাতীয় সংসদের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গুঁড়া দুধ আমদানিতে মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। দুঃখের বিষয় কিছু দেশি বিশেষজ্ঞ বিদেশি কোম্পানির গুঁড়া দুধে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর বিপক্ষে কথা বলছেন। নিকট ভবিষ্যতে আমরা যদি নিরাপদ দুধ উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে চাই- তবে বিদেশি উন্নত দুধাল জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে দেশীয় গাভিগুলোকে কৃত্রিম প্রজনন করাতে হবে। ফলস্বরূপ আমাদের দেশীয় গাভির জাত উন্নয়ন ও দুধ উৎপাদন বাড়বে। পাশাপাশি ভ্রূণ স্থানান্তর প্রযুক্তি প্রয়োগ করে অল্প সময়ে অধিকসংখ্যক এই ভালো মানের গাভির সংখ্যা বৃদ্ধি করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। অধিকন্তু আমাদের পর্বতসম বেকার জনগোষ্ঠীকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী পশুপালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তরল দুধের সংরক্ষণ, সরবরাহ ও ন্যায্যমূল্য, পর্যাপ্ত ভেটেরিনারি সেবা ও অ্যান্টিবায়োটিকের যথার্থ ব্যবহার। এতে একদিকে যেমন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্ম সংস্থান হবে, অন্যদিকে দেশের চাহিদার দুধ উৎপাদনসহ বিদেশে আমাদের প্রস্তুতকৃত গুঁড়া দুধ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে। দুধের সমস্যায় অবশ্যই কথা বলতে হবে এবং সে সমস্যা নিরূপণে সরকারকে কার্যকারী পদক্ষেপ নিতে বাধ্যও করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সিদ্ধান্তের ত্রম্নটির কারণে যেন দরিদ্র দুগ্ধ খামারিদের পথে বসতে না হয় এবং বিদেশি গুঁড়া দুধ কোম্পানিগুলো দুগ্ধশিল্পের সিংহভাগ দখলে না নিয়ে যায়। কাজেই, দুধ উৎপাদন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং ক্ষতিকারক উপাদানের উৎস নির্ণয় করে তা অনুপ্রবেশের সব রাস্তা বন্ধকরণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। চলুন নিজেদের মনকে দূষণমুক্ত করি এবং আমাদের সব খাবারকে দূষণমুক্ত করতে পরস্পরকে সহযোগিতা করি। কেবল তাতেই, ভেজালমুক্ত বাংলাদেশে নির্ভেজাল গরুর দুধ পাওয়া যাবে। লেখক: পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক, অবিহিরো ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন, জাপান।