সম্ভাবনাময় মেস্তা ফসল চুকুর

চুকুর পাতা রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। এর মাংসল বৃতি (শঁাস) কনফেকশনারি খাদ্যসামগ্রী যেমন-জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান থাকে। চুকুরের ফলে পেকটিন থাকায় শুধু চিনি ও চুকাই দিয়ে সহজেই জ্যাম তৈরি করা যায়...

প্রকাশ | ০৫ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
পাটজাতীয় মেস্তা ফসল সাধারণত দুই ধরনের হয়। অঁাশের জন্য (ঐরনরংপঁং ংধনফধৎরভভধ াধৎ. ধষঃরংরসধ) এবং সবজি মেস্তার জন্য (ঐরনরংপঁং ংধনফধৎরভভধ াধৎ. ংধনফধৎরভভধ)। সবজি মেস্তার ইংরেজি নাম রোসেলা বা সরেল। এর পাতা ও ফলের মাংসল বৃতি (শঁাস) টক এবং সুস্বাদু। পৃথিবীর অনেক দেশেই সবজি মেস্তার বাণিজ্যিক চাষ করা হয় এবং খাদ্য হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। উপগুল্মজাতীয় এই উদ্ভিদের জনপ্রিয় নাম চুকুর। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে ফলটি পরিচিত। রাজশাহীতে চুকাই, খুলনায় ও সাতক্ষীরায় অ¤øমধু, ধামরাই এবং মানিকগঞ্জে চুকুল, সিলেটে হইলফা, কুমিল্লায় মেডশ, চাকমারা বলেন আমিলা, মগরা চেনেন পুং ও ত্রিপুরারা উতমুখরই নামে। আবার কেউ কেউ বলেন হুগ্নিমুখুই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হয় খড়গুলা। সব শব্দের সরল বাংলা অথর্ টক। ফলটির স্বাদ তার নামের মধ্যেই প্রকাশিত। পাবর্ত্যাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের প্রায় প্রত্যেকের ঘরের আঙিনা বা বাণিজ্যিকভাবে মেস্তার চাষ করতে দেখা যায়। যে কোনো জেলার উঁচু এবং মধ্যম উঁচু জমিতে মেস্তার চাষ করা যায়। দো-অঁাশ এবং বেলে দোÑঅঁাশ মাটি মেস্তা চাষের উপযোগী। তা ছাড়া পাহাড়ি এলাকায়, বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের জমি, অনুবর্র আবাদযোগ্য প্রান্তিক জমিতে মেস্তা চাষ করা যায়। ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, সিলেট ও অন্যান্য জেলার উষর জমিতে মেস্তার ফলন অধিক হয়। তা ছাড়া যে সব উঁচু বা টান জমিতে বষার্র পানি দঁাড়ায় না সেখানেও মেস্তার আবাদ করা যায়। তবে মেস্তা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। খরা সহনশীল ও নেমাটোড প্রতিরোধী মেস্তার চাষে কিছুটা সুবিধা হলো তা শুষ্ক অঞ্চলের প্রান্তিক জমিতে আবাদ করা যায় এবং স্পাইরাল বোরার ও শিকড়ে গিঁট রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় না। মেস্তা বেশ খরা সহিষ্ণু এবং পাটের তুলনায় কম উবর্র জমিতে স্বল্প খরচে এর চাষ করা যায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বন্য প্রজাতির মেস্তা (এম-৭১৫) থেকে বিশুদ্ধ সারি নিবার্চন ও গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সবজি হিসেবে খাবার উপযোগী একটি উন্নত মেস্তার জাত উদ্ভাবন করেছে এবং জাতীয় বীজ বোডর্ কতৃর্ক ২০১০ সালে বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১) নামে অবমুক্ত করা হয়েছে। এ জাতের চলতি নাম চুকুর হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। চুকুরের কাÐ তামাটে রঙের এবং শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট। কাÐ ও পাতায় কোনো কঁাটা থাকে না। পাতা আঙ্গুল আকৃতির (খÐিত), পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো, গাঢ় সবুজ এবং পরিণত অবস্থায় তামাটে লাল রং ধারণ করে। চুকুরের পাতা স্বাদে টক ও সুস্বাদু। পাতার বৃন্ত ১০-১১ সেমি। ১৩০-১৪০ দিনে গাছে ফুল আসে। ফুলের ব্যাস ৫-৭ মিমি, দল হলদে, গোড়ায় মেরুন দাগ রয়েছে। চুকুরের একটি গাছে ৪০-৬০টি ফল ধরে। ফল অপ্রকৃত, ক্যাপসুল আকৃতির, ওপরের দিকে চোখা ও রোমমুক্ত এবং বৃতি পুরু ও মাংসালো। এক হেক্টর জমিতে ৭,৭৮৯ কেজি সবুজ পাতা এবং ২০০০-২০৫৫ কেজি বৃতি উৎপাদন হয়। বীজ গাঢ় বাদামী, রেমিফমর্ ও কিডনি আকারের। চুকুরের ১০০০টি বীজের ওজন প্রায় ২০ গ্রাম। চুকুর পাতা রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। এর মাংসল বৃতি (শঁাস) কনফেকশনারি খাদ্যসামগ্রী যেমন-জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান থাকে। চুকুরের ফলে পেকটিন থাকায় শুধু চিনি ও চুকাই দিয়ে সহজেই জ্যাম তৈরি করা যায়, আলাদাভাবে পেকটিন মেশাতে হয় না। অস্ট্রেলিয়া, বামার্ এবং ত্রিনিদাদে এই ফলটি জ্যাম তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। মিয়ানমারের জনপ্রিয় সবজি হিসেবে চুকুর পরিচিত। ইতালি, আফ্রিকা ও থাইল্যান্ডে চুকুর পাতা ভেষজ চা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মেস্তার খৈল গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ থেকে ২০% খাবার তৈল উৎপাদন হয়। মেস্তার তেলে ১৫.৮% পালসিটিক এসিড, ৬.৮% স্টিয়ারিক এসিড, ৫১% অলিক এসিড ও ২৬.৮ লিনোলিক এসিড থাকে। মেস্তার তৈল পৃথিবীর অনেক দেশে সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং খাবার তেলে মেশানো হয়। পাটের চেয়ে সবজি মেস্তার বীজ বড় হওয়ায় জমি চাষ করার সময় মাটি তত মিহি না করলেও চলে। তবে এর শিকড় মাটির বেশ গভীর থেকেও খাদ্যরস সংগ্রহ করে, তাই জমি গভীর করে চাষ দেয়া ভালো। জমির প্রকারভেদে আড়াআড়িভাবে দুই-তিনবার চাষ ও মই দিতে হবে। আগাছা বাছাই করে ফেলতে হবে। প্রতি হেক্টর জমির জন্য ইউরিয়া ১৩২ কেজি, টিএসপি ২৫ কেজি এবং এমওপি ৪০ কেজি পরিমাণ সার দরকার। তবে শুকনা গোবর সার ব্যবহার করা হলে প্রতি হাজার কেজি শুকনো গোবর সার ব্যবহারের জন্য ১১ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার নিধাির্রত মাত্রার চেয়ে কম প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে দস্তা ও গন্ধকের অভাব দেখা না গেলে জিপসাম ও সালফেট সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই। বীজ সারিতে ও ছিটিয়ে বপন করা যায়। ৩০ সেমি পর পর সারি করে বীজ বুনতে হবে। সবজি মেস্তা বৈশাখের প্রথম থেকে শ্রাবণের শেষ পযর্ন্ত সময় বপন করা যায়। ছিটিয়ে বপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে ১২-১৪ কেজি এবং সারিতে বপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে ১০-১২ কেজি পরিমাণ বীজ প্রয়োজন হয়। রোগ দমনের জন্য রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সম্ভব হলে বীজ বপনের আগে শোধন করে নিতে হবে। চারা গজানোর পর প্রয়োজন অনুসারে নিড়ানি ও গাছ পাতলা করে দিতে হবে। পাটের চেয়ে সবজি মেস্তার নিড়ানি ও পরিচযার্ কম লাগে। বাংলাদেশে খুব সহজে ও অনায়াসে এর চাষ করা যায়। বপনের ১৩০-১৫০ দিন পর সবজি মেস্তার ফুল আসা শুরু হয়। ফুল আসার পরে উপযুক্ত সময়ে ফল পরিপুষ্ট হলে হাত দিয়ে ফল ছিঁড়ে অথবা মাংসল বৃতি (শঁাস) সংগ্রহ করা হয়। এই বৃতি (শঁাস) সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রী তৈরির জন্য কনফেকশনারিতে প্রেরণ করা হয় বা রান্না করে খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা হয়। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের বাজারগুলোতে টক পাতা ও ফল হিসেবে সবজি মেস্তা বিক্রি করা হয়। কৃষিবিদ মো. আল-মামুন ঊধ্বর্তন বৈজ্ঞানিক কমর্কতার্ প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা