বিদেশি ফল রাম্বুটান, পুষ্টিগুণে অফুরান

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
কৃষিবিদ এম এনামুল হক যেসব বিদেশি ফল এ দেশে সফলভাবে চাষ হচ্ছে এবং লাভজনক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তার মধ্যে রাম্বুটান অন্যতম। এ ফল অনেকটা লিচুর মতো, তবে লিচুর চেয়ে আকারে বড়, ডিম্বাকৃতি, কিছুটা চ্যাপ্টা। পাকা ফল উজ্জ্বল লাল, কমলা বা হলুদ আকর্ষণীয় রঙের হয়ে থাকে। ফলের পুরু খোসার উপরিভাগ কদম ফুলের মতো শত শত চুল দিয়ে আবৃত। মালয়েশিয়ার ভাষায় রাম্বুটানের অর্থ চুল। একই কারণে এ ফল চুল বা দাড়ি বিশিষ্ট লিচু বলে অনেকের নিকট পরিচিত। রাম্বুটান লিচুর মতোই চিরহরিত, মাঝারি উচ্চতা বিশিষ্ট লম্বা গাছ। বর্ষাকালে (জুলাই-আগস্ট মাসে) ফল পাকে। উৎস ও বিস্তার : মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এ ফলের আদি নিবাস। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ব্রম্ননাই ও শ্রীলঙ্কায় প্রচুর পরিমাণে রাম্বুটান উৎপন্ন হয়ে থাকে। এ সব দেশ থেকে অনুরূপ আবহাওয়াবিশিষ্ট দেশে বা দেশের অংশ বিশেষে এ ফলের বিস্তার আরম্ভ হয়। শীতের তীব্রতা কম এমন দেশে যেমন ভারত ও বাংলাদেশের এমন কিছু অংশেও এ ফলের বিস্তার ও চাষ জনপ্রিয়তা বাড়ছে। জলবায়ু : ট্রপিক্যাল ও সাবট্রপিক্যাল আবহাওয়া বিশিষ্ট অঞ্চল রাম্বুটান চাষের জন্য উপযোগী। এ ফলগাছের শীতের তীব্রতা সহ্য শক্তি নেই। শীতকালে তাপমাত্রা ১০০ সেলসিয়াসের নিচে নেমে ৫-৭ দিন বিরাজ করলে গাছ মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও পার্বত্য অঞ্চলীয় জেলাসহ বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ও যশোর জেলায় এ ফল সম্প্রসারণ সম্ভাবনা বিরাজ করছে। রাঙ্গামাটি জেলায় কিছুসংখ্যক রাম্বুটানগাছ ৩০-৪০ বছর ধরে ফল দিচ্ছে। নেত্রকোনা জেলার কিছুসংখ্যক চাষি প্রায় ২০ বছর ধরে রাম্বুটান ফল উৎপাদন বিপণন করে বেশ লাভবান হচ্ছে। এ ছাড়া নরসিংদী জেলায় শিবপুর উপজেলার কয়েকজন রাম্বুটান চাষির সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তদাঞ্চলে লটকন চাষের পাশাপাশি রাম্বুটান চাষে অনেকেই আকৃষ্ট হচ্ছে। পুষ্টিগুণ : রাম্বুটান একটা ঔষধিগুণসম্পন্ন ফল। এ ফলে প্রচুর আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ফাইবার এবং ক্যালোরি রয়েছে। এন্ট্রিঅক্সিডেন্টাল গুণসমৃদ্ধ ফ্যাট-ফ্রি এ ফলে সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলস রয়েছে। মাটি : প্রায় সব ধরনের মাটিতে এ ফল চাষ করা যায়। তবে পানি সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উর্বর দোআঁশ মাটি এ ফল চাষে বেশি উপযোগী। মাটি শক্ত, কাঁকরময় বা বেশি এঁটেল হলে গাছ রোপণের জন্য মাদা তৈরি কালে ৫-৭ ফুট চওড়া ও গভীর করে মাটি সরিয়ে তৈরি গর্ত উপযোগী পটিং মিডিয়া দিয়ে ভরাট করে এ ফলগাছ রোপণ করা হলে চাষে বেশি সফলতা পাওয়া যায়। রাম্বুটান চাষের জন্য মাটির পি-এইচ মাত্রা ৫.৫-৬.৫ হলে ভালো হয়। বংশবিস্তার : প্রধানত বীজ থেকে উৎপাদিত চারা দিয়ে রাম্বুটান ফল চাষ করা হয়। পাকা ফলের বীজ বের করে তা তাজা অবস্থায় চারা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৫-৭ দিনের বেশি থাকে না। এ জন্য বীজ সংগ্রহের পর পরই বীজবপনের প্রয়োজন হয়। বীজ বসানোর জন্য উপযোগী পটিং মিডিয়া তৈরি করে নেয়া জরুরি। মিডিয়া তৈরির জন্য মোটা বালু (সিলেট স্যান্ড)-২৫%, নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া (কোকোডাস্ট)-২৫%, লতাপাতা বা আর্বজনা পচা জৈব সার- ২৫%, এবং ভিটে মাটি (নার্সারির কাজে ব্যবহার উপযোগী মাটি) - ২৫%। এগুলো একত্রে মিশিয়ে ছিদ্র বিশিষ্ট মাটির টবে মিশ্রণ দিয়ে ভরাট করে তার ওপর বীজ বসাতে হয়। বীজের চওড়া ভাগ নিচে রাখতে হবে এবং বীজ বসানোর পর উপরিভাগ সামান্য মাটি (হাফ ইঞ্চি পুরু) দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। অঙ্কুরিত বীজ পিঁপড়া খেয়ে নষ্ট করতে যেন না পারে এ জন্য কীটনাশক ব্যবহার বা অন্য উপায়ে গজানো বীজকে নিরাপদে রাখতে হবে। টবের মাটি যেন শুকিয়ে না যায় এ জন্য মাঝে মাঝে পানি স্প্রে করে হালকাভাবে মাটি ভেজাতে হবে। মাটি সব সময় হালকা ভেজা অবস্থায় থাকবে, প্রয়োজনের বেশি পানি দেয়া উচিত হবে না। বীজ বসানোর ১০-২০ দিনের মধ্যে বীজ অঙ্কুরিত হবে, চারা গজানো শুরু করবে। চারা/কলম সংরক্ষণ : চারার বয়স ৬ মাস হলে গাছের গোড়া ছেড়ে টবের কিনারে গভীর নালা করে ইউরিয়া-২০ গ্রাম, টিএসপি- ৫০ গ্রাম এবং পটাশ ৩০ গ্রাম হারে তিন মাসের ব্যবধানে দু'বার প্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে তিন মাসের ব্যবধানে আরো দু'বার এ সারের পরিমাণ দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। চারার বয়স এক বছর হলে অপেক্ষাকৃত বড় টবে নতুনভাবে পটিং মিডিয়া দিয়ে ও অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণ জৈব সার/ কম্পোস্ট এবং একেকটা গাছের জন্য ২৫০ গ্রাম হাড়ের গুঁড়া মিশিয়ে রিপটিং করতে হবে। সংরক্ষিত চারা আধা ছায়ায় রেখে ১.৫-২ বছরের বয়স্ক বড় চারা জমিতে রোপণের জন্য উপযোগী হয়। এক বছর বয়স্ক চারায় বাডিং, সাইড গ্রাফটিং অথবা জোড় কলম পদ্ধতি অবলম্বনে কলম করা চারা রোপণ করার প্রচলন এখন বাড়ছে। গাছের লিঙ্গ : চারা থেকে প্রাপ্ত গাছ তিন ধরনের হয়ে থাকে। এতে পুরুষ, স্ত্রী ও উভয়লিঙ্গিক গাছের জন্ম হতে পারে। অর্থাৎ বীজের চারায় অনেকটা পেঁপে গাছের মতো ভিন্নতর লিঙ্গের গাছ পাওয়া যায়। পুরুষ গাছ হলে তাতে ফল ধরে না, তবে তা স্ত্রী গাছে পরাগায়নের মাধ্যমে ফল ধরতে সহায়ক হয়। চারার গাছে মাতৃ গুণাগুণ বজায় থাকে না। ফল ধরতে ৫-৬ বছর সময় লেগে যায়। বর্তমানে কলম করা গাছ আমদানি করে কিছু সংখ্যক নার্সারিম্যান পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে উভয়লিঙ্গিক রাম্বুটান কলম করা গাছ বিপণন করছে। চারা/কলম রোপণ : রাম্বুটান ফল গাছ প্রধানত : ৩০-৩৫ ফুট দূরত্বে রোপণ করা হয়। গাছ রোপণের আগে 'লে-আউট' পস্নান তৈরি করে নির্ধারিত স্থানে গাছ রোপণের জন্য গর্ত তৈরি করে নেয়া দরকার। সাধারণ অবস্থায় গাছ রোপণের জন্য গর্তের মাপ হবে ৩-৪ ফুট চওড়া ও গভীর। যে সব মিশ্রণ দিয়ে তৈরিকৃত গর্ত ভরাট করতে হবে তা হলো- মোটা বালু (সিলেট স্যান্ড) ১৫%, ৩নং গ্রেডের ইটের মার্বেল সাইজের ছোট খোয়া ১৫%, নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া (কোকাডাস্ট) ১৫%, উর্বর মাটি (ভিটে মাটি) ২৫%, পচা গোবর / আর্বজনা পচা ৩০ শতাংশ। সবগুলো একত্রে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে ১৫ দিন রেখে দেয়ার পর গাছ রোপণের জন্য উপযোগী হবে। পানি সেচ ও নিষ্কাশন : গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকা এবং মাটিতে রসের অভাব উভয়ই রাম্বুটান গাছের জন্য ক্ষতিকর। এ জন্য বাগানের দু'সারি গাছের মধ্য ভাগে র্২-২.র্৫ চওড়া ও গভীর করে নালার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থায় বাগানে পানি জমা রোধ হবে। শুকনা মৌসুমে অবশ্যই ৮-১০ দিনের ব্যবধানে গাছের গোড়ার চারিধারের মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে প্রয়োজনীয় রসের অভাব দূর করতে হবে। শুকনা মৌসুমে গাছের গোড়া থেকে ৩-৪ ইঞ্চি ছেড়ে প্রায় ৩ ফুট দূর পর্যন্ত শুকনা খড়কুটো, কচুরিপানা অথবা লতা-পাতা দিয়ে মালচিং দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ছায়ার ব্যবস্থা: গাছ রোপণের প্রথম তিন বছর খরা মৌসুমে রোদের তাপ সহ্য ক্ষমতা রাম্বুটান গাছের কম। এ জন্য গাছের ১.৫-২ ফুট গোড়া ছেড়ে ৫-৬ ফুট উচ্চতায় দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চট বা ছালার বেড়া দেয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে গাছকে আধা ছায়াদানের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ ব্যবস্থায় রোদের তাপে পাতা পুড়ে/জ্বলে যাওয়া রোধ হয়। গাছের গোড়া ছেড়ে কয়েকটা ধৈঞ্চা, বকফুল, অড়হড় গাছ লাগিয়েও আধা-ছায়ার ব্যবস্থা করা যায়। ট্রেনিং-প্রম্ননিং : গাছ যেন চারধারে বেশি ডাল ছড়ায় এ জন্য গাছ লম্বায় র্৩-র্৪ উঁচু হলেই আগা কেটে প্রথম ৩-৪টা শাখা তৈরি করে নিয়ে গাছকে উপরে ও পার্শ্বে বাড়তে না দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ ছাড়া ছোটু দুর্বল ডাল মাঝে মাঝে ছেঁটে দিলে গাছের কাঠামো সুন্দর হয়ে বেড়ে উঠে। বেশি লম্বা না হয়ে ঝাকড়া গাছে ফল ধরা ও পাড়ার সুবিধা বেশি। এ জন্য ট্রেনিং-প্রম্ননিং পদ্ধতি অবলম্বনে সেভাবে গাছের কাঠামো তৈরি করে নিতে হবে। সার প্রয়োগ: রাম্বুটান গাছে জৈব উৎস থেকে নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করা ভালো। রাম্বুটান গাছে ফসফরাস সারের চাহিদা অনেক বেশি। বিভিন্ন বয়সী রাম্বুটান গাছে বছরে যে পরিমাণ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন তা হলো- সুপারিশকৃত ডোজের ৪০% ভাগ ফেব্রম্নয়ারি-মার্চ মাসে ফুল-ফল ধরার আগে/সময় প্রথমবার প্রয়োগ করতে হবে। এ সময় গাছের গোড়া কোপানো যাবে না। হালকাভাবে আঁচড়া দিয়ে মাটি আলগা করে সারগুলো গাছের ক্যানোপি বরাবর ছিটিয়ে মালচিং দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। অবশিষ্ট ৬০% সার ফল সংগ্রহের পর একইভাবে গাছের গোড়ার চারধারে ছিটিয়ে দিয়ে হালকাভাবে কুপিয়ে তা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই পানি দিয়ে মাটি ভালোভাবে ভেজাতে হবে। ফল সংগ্রহ : রাম্বুটান গাছে মার্চ মাসে ফুল ফোটা শুরু হয় এবং এপ্রিল মাসে কচি সবুজ রঙের ফল ধরতে আরম্ভ করে। ফুল ফোটার ৩-৪ মাস পর জুলাই-আগস্ট মাসে ফল পাকে। ফল পুষ্ট হলে সবুজ রঙের ফল হঠাৎ করে লাল, মেরুন রঙে রূপান্তর হতে থাকে। এ অবস্থা শুরু হওয়ার ১৫-২০ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করতে হয়। লিচু ফল সংগ্রহের ন্যায় এ ফল হাত দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। একটা ফলন্ত বয়স্ক গাছ থেকে বছরে ১৫০-২৫০ কেজি ফল পাওয়া যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় এ ফল বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। ফল পাড়ার ৭ দিনের মধ্যে বিপণন বা আহারের কাজ শেষ করতে হয়। তবে ১০-১২০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হলে সেলফ লাইফ আরও ৮-১০ দিন বাড়ানো যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে এ ফলের বাজারমূল্য প্রতিকেজি প্রায় ৪০০-৫০০/- টাকা। নরসিংদী এবং নেত্রকোনার রাম্বুটান চাষি ৮-১০ বছর বয়স্ক প্রতি গাছের ফল বিক্রি করে প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০/- টাকা আয় করে আসছে। তারা প্রতিটা ফলের বীজ ৫-৭ টাকায় বিক্রি করে। এ লাভজনক ফল চাষে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই রাম্বুটান ফল চাষ সম্প্রসারণে অনুপ্রেরণা পাচ্ছে এবং এ ফল চাষ সম্প্রসারণ এ দেশে বেগবান হচ্ছে। লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর