বিলুপ্তির পথে ঔষধি গাছ

চিনলে জরি, না চিনলে খড়ি

প্রকাশ | ২০ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

মো. নজরুল ইসলাম, মধুপুর
চিনলে জরি, না চিনলে খড়ি- প্রচলিত এ কথাটির একটি মমার্থ রয়েছে। এক সময়ে বনে-জঙ্গলে গজিয়ে ওঠা ঔষধি গাছ আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। সে সময় সাধারণ জ্বর, সর্দিসহ অনেক জটিল রোগ এসব ঔষধি গাছের মূল, কান্ড, পাতা বা বাকলের রস অথবা চূর্ণ দ্বারা তৈরিকৃত ওষুধে রোগ নিরাময় হতো। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আজ ওই সব ভেষজ ওষুধের দিকে না তাকিয়ে বর্তমানে উন্নত মানের ওষুধ সেবন করে রোগ নিরাময় করছেন। এ কারণে গ্রাম-গঞ্জে আগের মতো ঔষধি গাছ আর লাগানো ও পরিচর্যা করতে দেখা যায় না। টাঙ্গাইলের মধুপুর, ধনবাড়ী ও ঘাটাইল উপজেলার কয়েকটি গ্রামে নব্বই দশক পর্যন্ত এসব ঔষধি গাছে যেমন ভরপুর ছিল, তেমনি এসব গাছ দ্বারা তৈরিকৃত ওষুধে চিকিৎসা করতেন কবিরাজরা। মধুপুর উপজেলার মলকা গ্রামের কবিরাজ দুলাল মিয়া জানান, আমার বাবা এক সময় গ্রামের ঝুপ-ঝাড়ে জন্মানো ঔষধি গাছ দিয়ে মানুষের জটিল ও কঠিন রোগ নিরাময় করতেন। ঘাটাইলের শালিয়াবহ গ্রামের কবিরাজ মধু চন্দ্র বর্মণ জানান, সে সময় কিশোর হতে যুবক বয়স পর্যন্ত কোনো অসুখ হলে দাদি-নানিরা এসব ঔষধি গাছের বাকল, পাতার রস করে খাওয়াত। রোগও নিরাময় হতো। কিন্তু আজ ওই সব ঔষধি গাছ ৮-১০টি গ্রাম ঘুরলেও পাওয়া দুষ্কর। সরকার অফিস-আদালতসহ বাড়ির আশপাশ এলাকায় কমপক্ষে একটি করে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ কাজটি যদি আমরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে করতে পারি তাহলে অবশ্যই আগের মতো আবারও ঔষধি গাছ কাছেই পাব এবং অনেক ছোটখাটো রোগ থেকে সহসাই আরোগ্য পাব। গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গাছের মধ্যে কালোমেঘ, নিমগাছ, তুলসি, আমলকী, বহেরা, হরীতকী, শতমূলী, তেলাকুচা, আশোকগাছ, বাসক, থানকুনি, ভূঁইকুমড়া, পাথরকুচি ইত্যাদির গাছের বাগান করে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। পাথরকুচির ঔষধি গুণ পাথরকুচি অতিপরিচিত একটি ঔষধি উদ্ভিদ। চিকিৎসার ক্ষেত্রে নানা প্রকার ঔষধি গাছ প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। পাথরকুচি দেড় থেকে দুই ফুট উঁচু হয়। পাতা মাংসল ও মসৃণ, আকৃতি অনেকটা ডিমের মতো। চারপাশে আছে ছোট ছোট গোল খাঁজ। এই খাঁজ থেকে নতুন চারার জন্ম হয়। অনেক সময় গাছের বয়স হলে ওই গাছের খাঁজ থেকে চারা গজায়। পাতা মাটিতে ফেলে রাখলেই অনায়াসে চারা পাওয়া যায়। মেহ, সর্দি, মূত্র রোধে, রক্তপিত্তে, পেটফাঁপায়, শিশুদের পেটব্যথায়, মৃগীরোগে পাথরকুচির ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে। চলুন আরো কিছু গুণাগুণ জেনে নেই পাথরকুচি পাতার। যে সর্দি পুরানো হয়ে গেছে, সেই ক্ষেত্রে এটি বিশেষ উপযোগী। এই কফ বিকারে পাথরকুচি পাতা রস করে সেটাকে একটু গরম করতে হবে এবং গরম অবস্থায় তার সঙ্গে একটু সোহাগার খৈ মেশাতে হবে। ৩ চা চামচের সঙ্গে ২৫০ মিলিগ্রাম যেন হয়। তা থেকে ২ চা চামচ নিয়ে সকালে ও বিকালে ২ বার খেতে হবে। এর দ্বারা পুরানো সর্দি সেরে যাবে এবং সর্বদা কাশি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কলেরা, ডাইরিয়া বা রক্ত আমাশয় রোগ সারাতে পাথরকুচি পাতার জুড়ি নেই। পাথরকুচি পাতা জন্ডিসের মহাঔষধ। লিভারের যে কোনো সমস্যা থেকে রক্ষা করতে তাজা পাথরকুচি পাতা ও এর জুস অনেক উপকারী। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং মূত্রথলির সমস্যা থেকে পাথরকুচি পাতা তুলনা হয় না। চিরতরে মুক্তি দিতে পারে এই পাতা মূত্রথলির সমস্যা থেকে। পাথরকুচি পাতার রসের সঙ্গে গোল মরিচ মিশিয়ে পান করলে পাইলস ও অর্শ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও পাথরকুচি পাতায় প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে যা ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। সঙ্গে সঙ্গেই এর মধ্যে জ্বালাপোড়া কমানোর ক্ষমতা থাকে। যারা ত্বক সম্বন্ধে অনেক সচেতন তারা পাথরকুচি পাতা বেটে ত্বকে লাগাতে পারেন। ব্রণ ও ফুস্কুড়ি জাতীয় সমস্যা দূর হয়ে যাবে। তোকমার ঔষধি গুণ তোকমা এক প্রকার গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। তোকমা উদ্দীপক, এসিডিটি নিরাময়ক ও তৃষ্ণা নিবারক। ঘর্মগ্রন্থিকে সচল রাখে। জ্বর কমায়, ঠান্ডাজনিত শ্লেষ্মা দূর করে। বিভিন্ন রকম চর্মরোগ দূর করতে সাহায্য করে। তোকমার পাতা ক্যান্সার ও টিউমার প্রতিরোধক। বাতের রোগীদের জন্য এর পাতার রস বিশেষ উপযোগী। লিভারকে ভালো রাখে। পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্যসহ পাকস্থলীর যে কোনো সমস্যা দূর করে। পাইলসের উপশমকারী। তোকমার বীজের রস মূত্রনালির সমস্যা রোধ করে। তুলসীর ঔষধি গুণ তুলসী একটি ঘন শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট ২/৩ ফুট উঁচু একটি চিরহরিৎ গুল্ম। এর পাতা, ফুল ও ফলের একটি ঝাঁজালো গন্ধ আছে। সর্দি ও দীর্ঘদিনের খুসখুসে কাশিতে কিছু তুলসী পাতা গরম পানিতে জ্বাল দিয়ে নির্যাস বের করে নিয়ে সামান্য আদা ও মধু দিয়ে খেলে সর্দি-কাশি ও জ্বর ভালো হয়। তুলসীর এই নির্যাস খেতে হবে পাঁচ থেকে সাত দিন তিন বেলা করে। শিশুর সর্দি-কাশিতে চার থেকে ১০ ফোঁটা তুলসী পাতার রসের সঙ্গে তিন থেকে পঁাঁচ ফোঁটা মধু মিশিয়ে তিন বেলা খাওয়ালে সর্দি-কাশি দুই তিন দিনের মধ্যে ভালো হবে। ব্রংকাইটিস ও ডাইরিয়াতে ভালো ফল দেয় তুলসী। গরমে কেউ না ঘামলে ঘাম ঝরাতে ভূমিকা রাখে তুলসী। এসব ক্ষেত্রে তুলসীর পাতা প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচটি খেতে হবে কয়েক সপ্তাহ ধরে।