দেশেই করা যাবে প্রাণিজ খাদ্যের মাননিয়ন্ত্রণ গবেষণা

প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

কৃষিবিদ সামছুল আলম
দিন যত যাচ্ছে আমাদের চারপাশে ভেজাল খাদ্যে সয়লাব হচ্ছে। এতে করে ভোক্তারা নানান মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই সরকার জনসাধারণের জীবনকে নিরাপদ রাখতে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন, উপকরণ ও প্রাণিজাত খাদ্যের মাননিয়ন্ত্রণে সর্বাধুনিক গবেষণাগার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এতে করে একদিকে দেশের মানুষের জীবন যেমন রক্ষা পাবে, অন্যদিকে মানুষ নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাদ্যের নিশ্চয়তা পাবে। জানা যায়, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রাণিসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও গুণগতমান সম্পন্ন প্রাণিজাত খাদ্যের উৎপাদন আজ হুমকির সম্মুখীন। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ ও উৎপাদিত দ্রব্যাদির মাননিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করা এবং সর্বোপরি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে 'প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উপকরণ ও প্রাণিজাত খাদ্যের মাননিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার স্থাপন প্রকল্প' হাতে নিয়েছে সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১ জুলাই শুরু হলেও এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের ৩০ জুন এবং এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে এবং প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১০৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা করা হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বাধুনিক এ গবেষণাগারের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাদ্য ও ফিড এডিটিভসের গুণগত মাননিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া প্রাণিজাত খাদ্য তথা মাংস, ডিম ও দুধের নমুনায় ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ওষুধ, হরমোন, স্টেরয়েড ইত্যাদির রেসিডিউ পরীক্ষা করার পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ হতে উৎপাদিত পণ্য ও উপজাতের রুটিন এনালাইসিস পরিচালনা করবে। অন্যদিকে আধুনিক গবেষণাগারটি প্রাণিসম্পদের খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ এবং প্রাণিজাত পণ্যের গুণগতমানের সনদ প্রদান করবে। তা ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করবে। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ৬তলা বিশিষ্ট একটি মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাব, ৪তলা বিশিষ্ট একটি ডরমিটরি ভবন, ডিপটিউবওয়েল, গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য গ্যাসের সংরক্ষণাগার তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গবেষণাগারটিতে ক্রমান্বয়ে স্থাপিত হচ্ছে ২৩০টি সর্বাধুনিক মেশিন। ইতোমধ্যে গবেষণাগারে ঘওজঝ (ঘবধৎ রহভৎধৎবফ জবভষবপঃধহপব ঝঢ়বপঃড়ৎংপড়ঢ়ু) মেশিন স্থাপন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে খুব অল্প সময়ে পশুপাখির খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করে তার মধ্যকার পুষ্টিমান সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া রয়েছে ঐচখঈ (ঐরময-ঢ়বৎভড়ৎসধহপব খরয়ঁরফ পযঁৎড়সধঃড়ৎমৎধঢ়যু) মেশিন, যার মাধ্যমে অধিক মুনাফার আশায় খামারিরা পশুপাখির খাদ্যে এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহার করলে খাদ্যের নমুনা এইচপি এলসি যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করে তা শনাক্ত করা যাবে। এই গবেষণাগারে থাকছে খঈগঝ (ষরয়ঁরফ পযৎড়সধঃড়মৎধঢ়যু সধংং ংঢ়বপঃড়সবঃ. পশুপাখি থেকে উৎপাদিত দুধ, ডিম, মাংসে কোন এন্টিবায়োটিক রেসিডিউ খুব অল্প পরিমাই থাকলেও তা শনাক্ত করা যাবে এলসি এম এস যন্ত্রের মাধ্যমে। এ ছাড়াও পশুপাখির খাদ্য ও পশুপাখি থেকে উৎপাদিত দুধ, ডিম ও মাংসে কোনো ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ থাকলেও তা এএএস অঅঝ (ধঃড়সরপ ধনংড়ৎঢ়ঃরড়হ ংঢ়বপঃৎড়সবঃৎু) যন্ত্রের মাধ্যমে জানা যাবে। আগামী জানুয়ারি থেকে ল্যাবরেটরিতে কিছু কিছু পরীক্ষার কাজ শুরু হবে। তবে জুলাই ২০২০ থেকে পূর্ণাঙ্গরূপে সব পরীক্ষার কাজ শুরু হবে। এই ল্যাবরেটরি থেকে স্বল্পমূল্যের নির্ধারিত ফি'র মাধ্যমে খামারিরা এসব পরীক্ষা করাতে পারবেন। এ ছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় ল্যাবে গবেষণাধর্মী বইয়ের একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মূল ভবনের পাশে একটি ইটিটি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট পস্নান্ট) স্থাপন করা হয়েছে। এই পস্নান্টের মাধ্যমে ল্যাবে গবেষণার ফলে উৎপন্ন বর্জ্য পানি পরিশোধিত হয়ে পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী বাগানে ব্যবহৃত হবে। এ ছাড়া অটোমেটেড ল্যাব, কনফারেন্স সিস্টেম ও সৌর প্যানেল স্থাপন করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫০০ জন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ৫০০ জন কর্মচারীকে ২ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বিদেশে মাননিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়েছে এ প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পটির পরিচালক ড. মো. মোস্তাফা কামাল বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রাণিসম্পদের সব উপকরণের মাননিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত রোগজীবাণু, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও জৈব রাসায়নিক পদার্থের অনুপ্রবেশকে রোধ করা যাবে। প্রাণিসম্পদ খাতের উপকরণ আমদানি, রপ্তানি, বিপণন বাজারজাতকরণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এই গবেষণাগারের প্রত্যয়নপত্রকে বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে উপকরণের গুণগত ও পুষ্টিগত মাননিয়ন্ত্রণ করা যাবে। পশুপাখির উৎপাদন ব্যয় হ্রাস ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। ফলে কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র হ্রাসকরণ ঘটবে।