ফাতেমার স্বনির্ভর হওয়ার লড়াই

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পরের গাছের রস চুরি করে খেয়ে রাত কাটিয়েছেন। গভীর রাতে সন্তানের কান্না থামাতে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পানি দেওয়া ভাত চেয়ে খাইয়েছেন। সেই ফাতেমা আজ শুধু কেঁচো কম্পোস্ট থেকেই প্রতি মাসে আয় করেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। কাজের প্রতি ইচ্ছা আর আন্তরিকতা থাকলে যে কোনো ক্ষেত্রে সাফলতা অর্জন সম্ভব তা দেখিয়ে দিয়েছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কৃষানি ফাতেমা বেগম। শুধু কৃষিকাজই তার জীবনের চাকা বদলে দিয়েছে। ফাতেমার বসবাস কালীগঞ্জ উপজেলার বলাকান্দর গ্রামের শিরিষ খালের পাড়ে সরকারের খাস জমিতে। বড় ছেলে কাইয়ুম আলী এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী আর ছোট মেয়ে তৃপ্তি খাতুন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। কৃষানি ফাতেমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার সংগ্রামী জীবনের সুখ-দুঃখের গল্প। মাত্র ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। স্বামীর সংসারে সুখের পরিবর্তে অনাহারে অথবা অর্ধহারে দিন কেটেছে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বিয়ের ১০ বছরের মাথায় দূরারোগ্য ব্যাধিতে স্বামী মারা যায়। এরপর বিধবা ফাতেমার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। স্বামী মারা যাওয়ার পর অভাবের সংসারে খেয়ে না খেয়ে কেটে যায় পাঁচ বছর। এবার দ্বিতীয় বিয়ে হয় পাশের গ্রাম ষাটবাড়িয়া গ্রামের আশরাফুল হাদির ছেলে ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। এরই মধ্যে সংসারে আসে প্রথম সন্তান। পরের গল্প একেবারেই ভিন্ন। নিজের কর্ম প্রচেষ্টায় এখন কষ্টের দিন পাল্টে গেছে। বাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করে বিক্রির মাধ্যমে ফাতেমা সংসারে সুখ ফিরেছে। ফাতেমার অব্যাহত চেষ্টায় তার স্বামী এখন মাদক ছেড়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। ২০০৫ সালের কথা। মাত্র একটি চাড়িতে কেঁচো দিয়ে শুরু। এখন তার ৩৫০টি চাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট রয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদিত সার ও কেঁচো বিক্রি করে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করেন। সেই টাকা দিয়ে বাড়ি করার জন্য পাঁচ শতক জমি কেনা ছাড়াও সাড়ে নয় বিঘা জমি লিজ নিয়ে নিজেই চাষ করেন। গ্রামের অন্যান্য কৃষকের মতো কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠের কৃষিখেতে কাজ করেন এই ফাতেমা। উৎপাদন করেন বিষমুক্ত খাদ্য। ফাতেমা বেগম জানান, রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাষ করা ব্যয়বহুল। তাছাড়া সার দিয়ে উৎপাদিত ফসল খেয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত নানান জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া রাসায়নিক সার জমিতে মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাভাবিক স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। ২০০৫ সালে জাপানভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট সারের উৎপাদন শুরু করেন। স্থানীয় মাটির চাড়িগুলোর মধ্যে গোবর দিয়ে এর মধ্যে ছেড়ে দেন এক ধরনের কেঁচো। কেঁচোগুলো গোবর খেয়ে যে উচ্ছিষ্ট থাকে সেটাই কেঁচো কম্পোস্ট সার। চাড়িগুলো বসত ঘরের পাশের একটি চালা ঘর তৈরি করে বসানো হয়েছে। এরপর থেকে বাড়িতে এ সার তৈরি করে এলাকার সবজি, পানচাষিদের নিকট বিক্রি করছেন। প্রথম দিকে নিজের গরু না থাকায় গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে গোবর কুড়িয়ে ও কিনে কম্পোস্ট সার তৈরি করতেন। সে সময় লাভ অনেকটা কম হতো। বর্তমানে তার তিনটি গরু রয়েছে। ফলে বাইরের গোবরের আর প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রতি কেজি সার ১২ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করছেন। আর কেঁচো বিক্রি করছেন কেজি এক হাজার টাকা থেকে ১২০০ টাকা। যেখান থেকে প্রতি মাসে তিনি কমপক্ষে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার সার ও কেঁচো বিক্রি করতে পারছেন। ফাতেমা আরও জানায়, বাবার সংসার থেকে স্বামীর সংসার কোথাও অভাব আমার পিছু ছাড়েনি। একটি সময় নিজে উৎপাদনশীল কোনো কাজ করবেন বলে ভাবতে থাকেন। যা দিয়ে সংসারের গতি ফেরাতে পারবেন। তখন থেকে আমার সুখের জন্য নতুন যুদ্ধ শুরু করি। যে যুদ্ধে আমি জয়ী হতে চলেছি। প্রতিবেশী ইউপি মেম্বার আব্দুল আজিজ জানান, মাঠে ফাতেমার বা তার স্বামীর নিজের কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কম্পোস্ট সার তৈরি করে বিক্রির মাধ্যমে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। কৃষি কাজ করেই সামান্য জমি কেনা ছাড়াও আরও নয় বিঘা জমি লিজ নিয়ে অর্গানিক পদ্ধতিতে ফসল চাষ করছেন। মাঠে অন্য দশজন পুরুষের মতোই কাজ করেন ফাতেমা, বলছিলেন এই ইউপি সদস্য। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, তিনি ফাতেমা বেগমের কৃষি ও কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন পদ্ধতি নিজে দেখেছেন। একজন কৃষানির চেষ্টায় শূন্য থেকে শুরু করে সফলতা অর্জন দেশের কৃষক-কৃষানিদের জন্য অনুকরণীয়। যখন দেশের অগণিত কৃষকরা কৃষি কাজে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরা ক্ষমতা কমে যাচ্ছে তখন ফাতেমার জৈব পদ্ধতির চাষাবাদ সবাইকে চমকে দিয়েছে। ফাতমার এই চাষপদ্ধতি একদিকে যেমন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে অন্যদিকে কৃষিকাজে খরচ সাশ্রয় হচ্ছে।