গাছের রোগ প্রতিরোধে পুষ্টি উপাদান

ফসলের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব খনিজপুষ্টি ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও রোগে প্রতি গাছের সংবেদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে। পুষ্টির অভাবে ফসল রোগাক্রান্ত হতে পারে আবার পর্যাপ্ত পুষ্টি ফসলকে কষ্ট সহিষ্ণু ও রোগ প্রতিরোধী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। ফসলের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতানির্ভর করে বংশগতির ওপর। পুষ্টির অভাবে অনেক সময় ফসল নির্দিষ্ট একটি রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হয় না...

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম
মাটির অম্স্নমান, নাইট্রোজেনের গঠন ও পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা রোগ ব্যবস্থাপনায় ওপর বিরাট ভূমিকা রাখে - সংগৃহিত
ফসল উৎপাদনে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রোগ অন্যতম একটি কারণ- প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব। অধিকাংশ কৃষকই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে থাকেন। যদিও রোগ নিয়ন্ত্রণে খনিজপুষ্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাসায়নিক ছত্রাকনাশক ব্যবহারের ফলশ্রম্নতিতে ফসল উৎপাদনে আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়। ফসলের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব খনিজপুষ্টি ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও রোগে প্রতি গাছের সংবেদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে। পুষ্টির অভাবে ফসল রোগাক্রান্ত হতে পারে আবার পর্যাপ্ত পুষ্টি ফসলকে কষ্ট সহিষ্ণু ও রোগ প্রতিরোধী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। ফসলের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতানির্ভর করে বংশগতির ওপর। পুষ্টির অভাবে অনেক সময় ফসল নির্দিষ্ট একটি রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হয় না। কিছু কিছু পুষ্টি উপাদান অন্যান্য প্রভাবকের চেয়ে ফসলের রোগের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। একটি নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান বিভিন্ন রোগের বিপরীত ফলাফল প্রদর্শন করতে পারে। যেমন, একই পুষ্টি উপাদান কোনো রোগের বৃদ্ধির কারণ হলেও আরেকটি রোগ কমানোর জন্য কাজ করতে পারে। মাটির অম্স্নমান, নাইট্রোজেনের গঠন ও পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্যতা রোগ ব্যবস্থাপনার ওপর বিরাট ভূমিকা রাখে। পর্যাপ্ত জৈব বা অজৈব সার প্রয়োগে মাটিতে ফসলের পুষ্টি চাহিদা মিটানো সম্ভব। এ ছাড়াও মাটিতে ফসলের গ্রহণোপযোগী অবস্থায় আনতে বিভিন্ন পরিচর্যা ব্যবস্থাপনা যেমন- মাটির অম্স্নমান সমন্বয়ে চুন প্রয়োগ, সেচ প্রদান, পানি নিকাশ, জমিচাষ, জৈব চাষাবাদ ইত্যাদি। ফসলের রোগ প্রতিরোধে জাত নির্বাচন, পরিচর্যা ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক ব্যবহার ও পুষ্ঠি উপাদানের সঠিক ব্যবহার কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। ফসলে পুষ্টি উপাদান দু'ভাবে কাজ করে। ১. যান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার গঠন (যেমন- কোষ প্রাচীরের পুরুত্বের ওপর) ২. প্রাকৃতিক প্রতিরোধী যৌগের সংশ্লেষণে (এন্টিঅক্সিডেন্টসমূহ, ফাইটোঅ্যালেক্সিনস ও ফ্লাভেনয়েডসমূহ)। আসলে সব রোগই ৩-৫টি চক্রের অংশ। এ চক্রের অংশ মূলত রোগজীবাণু, পোষক ও পরিবেশ। তবে কখনো কখনো বাহকও এ চক্রের অংশ হয়। যে কোনো রোগই প্রতিরোধ বা দমন করা সম্ভব হতে পারে- যদি এই চক্রে বাধা সৃষ্টি করা হয় বা চক্র ভেঙে দেয়া যায়। বিভিন্ন রোগের কারণ যেমন ভিন্ন ভিন্ন জীবাণু, তেমনি তাদের সংক্রমণ কৌশলও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ফসলের এপিডার্মিস বা বহিরাবরণের কোষে সরাসরি বা দুটি কোষের মধ্যবর্তী অংশ দিয়ে ছত্রাক প্রবেশ করে। কোষ প্রাচীর প্রাকৃতিকভাবে ছত্রাক প্রতিরোধী এবং শক্তিশালী কোষপ্রাচীরগুলো রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। কিছু পুষ্টি উপাদান যেমন- ক্যালসিয়াম শক্তিশালী কোষ ও কোষ প্রাচীর গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখে। গাছের শরীরের ভেতর থেকেও বিভিন্ন ধরনের যৌগ নিঃসৃত হয়। যখন কোনো একটি পুষ্টি উপাদান নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম নিঃসরিত হয়, তখন নিঃসরিত যৌগটিতে উচ্চ মাত্রায় চিনি ও এমাইনো এসিড থাকে- যা ছত্রাককে ফসলে স্থায়ী হতে সহায়তা করে। ব্যাকটেরিয়া ফসলের ক্ষতস্থান, পোকা আক্রান্ত স্থান ও পাতার পত্ররন্ধ্র দিয়ে সংক্রমণ ঘটায়। এরা ফসলের দেহে আন্তঃকোষীয় স্থান দিয়ে দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের এনজাইম নিঃসৃত করে- যা উদ্ভিদ কোষকে বা কোষ প্রাচীরকে দ্রবীভূত করে দেয়। ক্যালসিয়াম ব্যাকটেরিয়ার এই এনজাইম নিঃসরণে বাধা দেয়। গাছের কোষের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের সক্ষমতা নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ কোষের শক্তির ওপর, যা মূলত খনিজপুষ্টির প্রভাবেই শক্তিশালীভাবে গঠিত হয়। অন্য আরেকটি কৌশল হলো- জাইলেমের মধ্য দিয়ে ব্যাকটেরিয়া গাছের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাকটেরিয়া জাইলেম ভেসেলগুলোকে এক ধরনের আঠালো পদার্থ দিয়ে আটকে দেয়। এর ফলে কান্ড ও পাতায় খাদ্য চলাচল বন্ধ হয়ে যায় ও এগুলো মরে যেতে শুরু করে। কিছু কিছু পুষ্টি উপাদান ব্যাকটেরিয়ার এই আঠালো পদার্থ গঠনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। রস চোষণকারী পোকা ও ছত্রাকের মাধ্যমে গাছে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। দেখা গেছে যে, সিলিকন যা গাছের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান নয়, তার উপস্থিতির কারণে রস চোষণকারী পোকা যেমন, জাব পোকা, সাদামাছি, জ্যাসিড, থ্রিপসের খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় বা কমে যায়। এর ফলে গাছ থেকে গাছে ভাইরাস সংক্রমণ কমে যায়। গাছের অনেক রোগ মাটির উচ্চ বা নিম্ন অম্স্নমান অথবা উচ্চ অ্যামোনিয়াম বা নাইট্রেট-এর গঠনের কারণে এবং উচ্চ বা নিম্ন আর্দ্রতার কারণে হয়ে থাকে। আবার চাষাবাদ পরিস্থিতির কারণে মাটিতে নাইট্রোজেনের উপস্থিতি মাটির অম্স্নমানের ওপর প্রভাব ফেলে, এতে রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সবজির ভার্টিসিলিয়ামজনিত কারণে ঢলে পড়া রোগ, তুলার ফাইম্যাটোট্রিকাম মূল পচা, থিয়েলাভিওপসিস মূল পচা রোগ ক্ষারীয় মাটির কারণে হয়ে থাকে। আবার আলুর স্ক্যাব রোগ কম অম্স্নমানযুক্ত মাটিতে কম হয়। স্ক্যাব রোগ নিয়ন্ত্রণে সালফার ও অ্যামোনিয়াম মাটির অম্স্নমান কমাতে এবং ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও নাইট্রেট মাটির অম্স্নমান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। গাছে রোগের বেলায় একই পুষ্টি উপাদানের বিপরীত কার্যকারিতা দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন গঠনের কারণে। নাইট্রোজেন, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ ও আয়রনের বেলায় এটা সত্য। উদাহরণ স্বরূপ, নাইট্রেট ও অ্যামোনিয়াম গাছের বিভিন্ন বিপাক প্রক্রিয়ায় কাজে লাগে এবং গাছের রোগের ওপর বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন, কিন্তু অতিরিক্ত নাইট্রোজেন গাছের রোগ সংক্রমণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন গাছের কোষের দেয়ালকে পাতলা ও দুর্বল করে দেয়, গাছ দ্রম্নত বৃদ্ধি পায়। এতে একক এলাকায় গাছের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়ে কম আলো ও উচ্চ আর্দ্রতাময় পরিবেশের সৃষ্টি করে- যা যে কোনো ধরনের রোগজীবাণু দ্বারা রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ ছাড়া অতিরিক্ত নাইট্রোজেন গাছের কোষের পরিপক্কতা প্রাপ্তিকাল পিছিয়ে দেয়, ফলে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। নাইট্রোজেন ও পটাশিয়ামের অনুপাত ফলন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। পটাশিয়াম গাছের রোগ প্রতিরোধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। শক্ত ও মজবুত কান্ড গঠনে পটাশিয়ামের ভূমিকা রয়েছে। এটি গাছের বিভিন্ন কোষীয় কার্যক্রমের ওপর প্রভাব বিস্তার করায় রোগের ব্যাপকতা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও নেমাটোড প্রতিরোধে পটাশিয়াম কার্যকর ভূমিকা রাখে। মাটিতে অতিরিক্ত চুন ব্যবহারের ফলে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি হলে মাটি থেকে পটাশিয়ামের পরিশোষণ ব্যবহৃত হয়। এতে গাছে রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। আবার জৈব নাইট্রোজেনকে গাছের গ্রহণযোগ্য করার জন্য ক্যালসিয়াম উপকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। খনিজপুষ্টি উপাদান ও চাষাবাদে পরিচর্যা ব্যবস্থাপনা গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সুষম মাত্রায় উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষক সর্বনিম্ন পরিমাণে রোগনাশক ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে। এতে পরিবেশ ঠিক রেখে ফসল উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় সাশ্রয় হয়। একটি নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান ব্যবহার করে কোনো রোগই সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করা সম্ভব নয়, তবে পুষ্টি উপাদানের পর্যাপ্ত প্রয়োগে রোগের ব্যাপকতা রোধ করা সম্ভব। এ জন্য নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন বা ফসলের ক্ষেত পরিদর্শন করে রোগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে হয় এবং ফসল আবাদের আগে নিয়মিতভাবে মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সুষম মাত্রায় সঠিক সার সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হয়। লেখক: উদ্যান বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর