শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশি শিমের পোকা ব্যবস্থাপনা

কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম
  ২২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশে শীতকালীন সবজির মধ্যে দেশি শিম অন্যতম জনপ্রিয় একটি সবজি। আমিষসমৃদ্ধ পুষ্টিকর সবজিটির কচি অবস্থা ছাড়াও এর বীজ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়। অন্যান্য লতাজাতীয় সবজির মতো এটি মাচায় চাষ করা হয়, তবে বসতবাড়িতে ঘরের চালে বা বেড়ায়, গাছে, জমির আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুর পাড়ে লাগানো যায়। দেশি শিম চাষে বেশ কিছু সমস্যা দেখা যায়। এর মধ্যে জাব পোকা, পাতা সুরঙ্গকারী পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শনের মাধ্যমে সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া সম্ভব হয়।

জাব পোকা : চারা বাড়ন্ত গাছ বা গাছে ফল ধরা অবস্থায় জাব পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। তবে ফুলের কুঁড়ি, ফুল ও কচি ফলে জাব পোকার আক্রমণে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। শিম গাছে যে জাব পোকা আক্রমণ করে তা খুব ছোট আকৃতির ও দেখতে কালো রংয়ের। বাড়ন্ত লতার কচি ডগা, কচি পাতায়, ফুলের ডগায়, ফুলে ও কচি ফলে আক্রমণ করে। জাব পোকা শিমের অন্যতম ক্ষতিকর পোকা। অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্ত বয়স্ক পোকা শিম গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে (কচি ডগা, পাতা, কুঁড়ি, ফুল ও কচি ফল) এর রস চুষে খায়। এতে প্রথমত গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। পরে আক্রান্ত ফুল ও ফল নষ্ট হয়ে যায়।

নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা : জাব পোকা নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত ফুলের ডগার জাব পোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হয়। গাছের গোড়া এবং শিম মাচার সব খুঁটির গোড়ার চারদিকে ছাই (ধানের তুষের ছাই হলে ভালো) ছিটিয়ে দিলে জাব পোকার শরীর থেকে বের হওয়া মধুরস খাওয়ার জন্য পিঁপড়ার আনাগোনা বন্ধ হয়, এতে নিজের শরীরের মধুরসে পোকার শরীর ঢেকে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে পোকা মরে যায়। এ ছাড়া আক্রান্ত ফুলের ডগায় কেরোসিন মিশ্রিত ছাই (এক কেজি ছাইয়ের সঙ্গে ২-৩ চামচ কেরোসিন) ছিটানো যায়। ১ কেজি অর্ধ ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২-১৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে অথবা ১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম (২ চা চামচ) গুঁড়ো সাবান গুলিয়ে নিয়ে সকালের দিকে স্প্রে করতে হয়। তবে আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরপিড জাতীয় কীটনাশক (ইমিটাফ/ এম্পায়ার/ এডমায়ার ইত্যাদি) স্প্রে করতে হয়।

;

পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা : চারা বা গাছ ছোট অবস্থায় এ পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। এ পোকার মথ দেখতে হালকা লালচে বাদামি রংয়ের। সামনের পাখার রং গাঢ় বাদামি। এ পোকা বছরে ৮ বারেরও বেশি বার বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। এরা বাড়ন্ত গাছের কচি পাতা আক্রমণ করে থাকে। এ পোকার ডিম থেকে লার্ভা বের হয়েই শিমের নতুন বা কচি পাতার ভেতরে ঢুকে সুড়ঙ্গ তৈরি করে সবুজ অংশ কুরে কুরে খেতে থাকে। এতে করে পাতার উপরের দিকে সবুজ অংশের মাঝে সাদা সাদা আঁকা-বাঁকা দাগ দেখা দেয়। পাতা ধীরে ধীরে লালচে বাদামি রং ধারণ করে, কুঁকড়িয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। শেষে পাতা দুর্বল হয়ে মরে যায় এবং অনেক সময় ঝরে পড়ে। এতে শিমের ফলন কমে যায়।

নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা : শিম গাছ বা শিমের মাচা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে এ পোকার উপদ্রব কম হয়। এ জন্য রোপণ দূরত্ব ঠিক রাখার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেতে ভালোভাবে আলো-বাতাস প্রবেশ করার ব্যবস্থা করতে হয়। এ ছাড়া শিম গাছের গোড়ার দিকে ৩-৪ পর্ব বা গিঁট পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় শাখাসহ ঝোপালো অংশ ছেঁটে পাতলা করে দিতে হবে। ক্ষেতের আশপাশে লেবু জাতীয় গাছে বা বেগুন/টমেটো/বরবটি ক্ষেতে এ পোকার উপস্থিতি থাকলে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হয়। পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা নিয়ন্ত্রণে ফেনিট্রথিয়ন ৫০ ইসি (সুমিথিয়ন বা লিথিয়ন) অথবা ফেনথিয়ন ৫০ ইসির (লেবাসিড বা ড্রাগন) যে কোনো একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হয়। আক্রমণ কম হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার ফেনিট্রথিয়ন ৫০ ইসি (সুমিথিয়ন বা লিথিয়ন) বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি মিশিয়ে পাতার উপর ও নিচে স্প্রে করতে হয়।

\হ

ফল ছিদ্রকারী পোকা : গাছের ফল ধরা অবস্থায় এ পোকার আক্রমণে শিম বা ফল খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। শিম বাজারজাত করতে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়। ফল ছিদ্রকারী পোকার কীড়ার মাথা গাঢ় বাদামি থেকে কালো রংয়ের হয়ে থাকে। দেহ হলদেটে সাদা ও নরম এবং পিঠের দিকে মধ্য রেখা বরাবর লম্বালম্বি লালচে ফোটা দেখা যায়। মাথার অংশ শক্ত। পূর্ণ বয়স্ক পোকা দেখতে কালচে ছাই রংয়ের। নীলচে রংয়ের পাখা দেখতে সাদা তুলার মতো। শিমের ফলছিদ্রকারী পোকা শিমের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা। স্ত্রী পোকা ফুলের কুঁড়ি, কচি ফল বা শুঁটি এবং কচি ডগায় ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বের হয়ে কীট ফলন্ত গাছের এসব অংশে আক্রমণ করে থাকে। বিশেষ করে ফুলের কুঁড়ি ও কচি ফল ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে বীজ ও শাঁস খায় ও মল ত্যাগ করে শিমের শুঁটিটি খাওয়ার অনুপযোগী করে ফেলে। আক্রান্ত ফল অনেক সময় কুঁকড়ে যায় ও অসময়ে ঝরে পড়ে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে শিমের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।

নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত কুঁড়ি, ফুল বা শুঁটি সংগ্রহ করে কম পক্ষে ১ ফুট গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হয়। ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হয়। কীটনাশকমুক্ত শিম চাষাবাদে এমএনপিভি (নিউক্লিয়ার পলিহেড্রিসিস ভাইরাস) প্রয়োগ করে এ পোকার আক্রমণ কমানো সম্ভব এবং প্রতি সপ্তাহে একবার করে ডিম নষ্টকারী পরজীবী পোকা ট্রাইকোগ্রামা কাইলোনিজ (হেক্টর প্রতি এক গ্রাম পরজীবী পোকা আক্রান্ত ডিম, যেখান থেকে ৪০,০০০ থেকে ৪৫,০০০ পূর্ণাঙ্গ ট্রাইকোগ্রামা বের হয়ে আসে) ও কীট নষ্টকারী পরজীবী পোকা ব্রাকন (হেক্টর প্রতি এক বাংকার বা ৮০০-১২০০টি হিসেবে) পর্যায়ক্রমে অবমুক্ত করতে হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে কীটনাশক প্রয়োগের আগে খাওয়ার উপযোগী শিম সংগ্রহ করতে হয়। শিমের ফল ছিদ্রকারী পোকা নিয়ন্ত্রণে ডাইমেথোয়েট জাতীয় (স্টার্টার/টাফগর/ডায়মেথিয়ন/সেলাথয়েট/ বিস্টারথয়েট/ ডেলথয়েট ইত্যাদি) অন্তর্বাহী বিষক্রিয়াসম্পন্ন কীটনাশক বা কার্বারিল জাতীয় (সেভিন) কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। দু'সপ্তাহ পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হয়। স্প্রে করার পর ১৫ দিন পর্যন্ত কোনো শিম সংগ্রহ করা উচিত নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<80894 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1