আলু থেকে হবে পচনশীল পলিথিন

আলুর তৈরি পলিব্যাগ শুধু উৎপাদিত আলুর সদ্ব্যবহারই নয়, পস্নাস্টিকের দূষণ কমানোর পাশাপাশি দেশের প্যাকেজিং শিল্প, আলুচাষি ও কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের জন্যও সুফল বয়ে আনবে। ইতোমধ্যেই আলু থেকে এক্সপেরিমেন্টাল পলিথিনের শিট তৈরি করে তা থেকে ব্যাগ বানিয়ে ভর বহন ক্ষমতা পরীক্ষা করেও দেখেছেন উদ্ভাবক মাহবুব সুমন। বাণিজ্যিক উৎপাদনে গেলে প্রতিটি ব্যাগের বিক্রয় মূল্য হবে আনুমানিক ৩ টাকা। এটি ৩০ দিনের মধ্যে মাটিতে মিশে যাবে। পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি গতানুগতিক সাইজের ব্যাগগুলোর ওজন ধারণ ক্ষমতা ৫/৬ কেজি পর্যন্ত হবে।

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
আলু থেকে পচনশীল পলিথিন তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন তরুণ গবেষক প্রকৌশলী মাহবুব সুমন - যাযাদি
আমাদের দেশে প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে- বেশি করে আলু খান ভাতের ওপর চাপ কমান। এই প্রবাদ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট ধানের চেয়ে আলুর উৎপাদন বেশি কিন্তু চাহিদা কম। তাই ভাতের পরিবর্তে আলু খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন অনেক নীতি নির্ধারকরা। যদিও বিজ্ঞানীদের মতে দেশে এখন আর ভাতের অভাব নেই। আলু মৌসুমভিত্তিক ফসল হলেও সবজি হিসেবে এর প্রচলন সারাবছর। আলু ছাড়া যেন আমাদের চলেই না, এর প্রয়োজনটা অনেকটা ভাতের মতোই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে দেশে গত বছর আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ টন। দেশের মোট আলুর চাহিদা ৭০ লাখ টন। অর্থাৎ উদ্বৃত্তের পরিমাণ প্রায় ৩৯ লাখ টন। আবার ভরা মৌসুমে প্রতি বছরই আলু নিয়ে সারাদেশেই কৃষকের সমস্যায় পড়তে হয়। ক্ষেত, মাঠ, উঠান, হাট সর্বত্রই আলু আর আলু। উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় আলু যেন কৃষকদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়। চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের বহুমুখিতার অভাবই এর প্রধান কারণ। অনেকেই মনে করেন, আলু রপ্তানি বাড়াতে পারলে কৃষকের এই সমস্যা দূর করা সম্ভব। কিন্তু রপ্তানির বাজার খোঁজা এবং প্রতিযোগিতার মধ্যে সেই বাজারে স্থান করে নেয়া সহজ কথা নয়। দীর্ঘ মেয়াদি সংরক্ষণের জন্যও নেই পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ। এ ক্ষেত্রে ব্যবহারের বহুমুখিতা আনাই অন্যতম সমাধান হতে পারে। আজকে এমন এক উদ্ভাবনের কথা জানাবো- যা এই সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে পারে। সেটি হলো- আলু থেকে পলিথিন তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন। আলু থেকে পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ তৈরি করেছেন তরুণ গবেষক মাহবুব সুমন। তিনি তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক করেছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে। তেল-গ্যাস-বিদু্যৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নবায়নযোগ্য শক্তি বিশেষজ্ঞ এবং বিকল্প জ্বালানি ও বিদু্যৎ মহাপরিকল্পনা গবেষক দলের সদস্য। দেশে-বিদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে অনেকগুলো প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন। মাহবুব সুমন জানান, এটি শুধু উৎপাদিত আলুর সদ্ব্যবহার নয়- পলিথিন ও পস্নাস্টিকের দূষণ কমানোর পাশাপাশি দেশের প্যাকেজিং শিল্প, আলুচাষি ও কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের জন্যও সুফল বয়ে আনতে পারে। ইতোমধ্যেই আলু থেকে এক্সপেরিমেন্টাল পলিথিনের শিট তৈরি করে তা থেকে ব্যাগ বানিয়ে ভর বহন ক্ষমতা পরীক্ষা করেও দেখেছেন। বাণিজ্যিক উৎপাদনে গেলে প্রতিটি ব্যাগের বিক্রয় মূল্য হবে আনুমানিক ৩ টাকা। এটি ৩০ দিনের মধ্যে মাটিতে মিশে যাবে। পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি গতানুগতিক সাইজের ব্যাগগুলোর ওজন ধারণ ক্ষমতা ৫/৬ কেজি। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং বিকল্প জ্বালানি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান 'শালবৃক্ষ'-এর পক্ষ থেকে আলু থেকে তৈরি পলিথিনের ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে তার। এ ব্যাপারে অনেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের আগ্রহ দেখালেও তিনি জানান কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এটি উদ্ভাবন করেননি বরং এই প্রযুক্তিটি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে পলিথিনের ব্যবহার হ্রাস ও দূষণ রোধ করাই তার প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য প্রযুক্তিটি তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য গণমাধ্যমে বিষয়টি যেন বহুল প্রচার পায় এবং সামগ্রিকভাবে পুরো দেশের মানুষ উপকৃত হয়। সুমন বলেন, সবাই ঘরে ঘরে এই ব্যাগ বানালে দেশ জুড়ে পলেথিন, পস্নাস্টিকের দূষণ অনেক কমে যাবে। কিভাবে এই আইডিয়া এলো এমন প্রশ্নের জবাবে সুমন জানান, ২০১৮ সালের এপ্রিলে মুন্সীগঞ্জ এলাকার কোল্ড স্টোরেজগুলোতে সৌর বিদু্যতের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর আলু চাষিদের ব্যবসায়িক দুরবস্থার কথা জানতে পারি। দেশের উত্তরাঞ্চলে আলু চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় এক সময় একচেটিয়া ব্যবসা করলেও মুন্সীগঞ্জের আলুচাষি ও কোল্ড স্টোরেজগুলো ভরা মৌসুমে ন্যায্য আলুর দাম না পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েন। নতুন করে বিনিয়োগের সক্ষমতা নেই বলে আমাদের জানান কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা। এ পরিস্থিতিতে আলু থেকে কোনো সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি প্রোডাক্ট ডেভেলপ করে দিয়ে তাদের আর্থিক ক্ষতি কিভাবে এড়ানো যায় তা ভাবতে থাকি। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিসহ পণ্যটি যদি পরিবেশবান্ধব হয় তাহলে তাদের উপকারের পাশাপাশি পরিবেশের দূষণও কম হবে। মাঝখান থেকে প্রচুর নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাতো থেকেই গেল। বিষয়টি নিয়ে নানাজনের সঙ্গে আলাপচারিতার একপর্যায়ে ইয়ান শ্মিডট নামে আমার এক জার্মান এনার্জি স্পেশালিস্ট বন্ধু আমাকে 'পলকা' বানানোর একটি প্রক্রিয়া শিখিয়ে দেন। শ্মিডটের সাহায্য নিয়ে আলু দিয়ে একদমই স্থানীয় যন্ত্রপাতি ও কমনসেন্সের ব্যবহার করে আমরা যে পলিথিন বানালাম তার নামই পলকা (চঙখকঅ)। এর মধ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক নেই। পলকা কি জিনিস জানতে চাইলে গবেষক সুমন জানান, পলকা বুঝতে হলে আগে জানতে হবে পস্নাস্টিক কি? অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পস্নাস্টিককে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে তাতে হাইড্রোকার্বনের খুব ছোট ছোট কণা বা মনোমার পরপর সজ্জিত হয়ে দীর্ঘ শেকলের পলিমার সৃষ্টি করে। এ রকম অনেক পলিমার একত্র হয়ে পস্নাস্টিক তৈরি করে। পস্নাস্টিকের পাতলা ব্যাগ পলিমারের তৈরি বলে তাকে বলা হয় পলিথিন। এই হাইড্রোকার্বন পলিমার মাটিতে পচে না ও অনেক দূষণ সৃষ্টি করে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি এই পলিথিন। আমরা সবাই জানি জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ তেল, গ্যাস, কয়লা পৃথিবীকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। তাই পৃথিবী রক্ষায় পলিথিনের বিকল্প দরকার। ফলে আমরা যদি এমন পলিমার বানাতে পারি- যা একই রকম লংচেইন পলিমার কিন্তু মাটিতে দ্রম্নত পচে যাবে এবং কোন দূষণ তৈরি করবে না তাহলে ব্যাপারটা বেশ হয়। পলকা হচ্ছে সেই পরিবেশবান্ধব পচনশীল পলিমার- যা আমরা আলু দিয়ে তৈরি করেছি। পলকা বানানোর প্রক্রিয়াও জানালেন মাহবুব সুমন। এর জন্য লাগবে আলুর স্টার্চ, পানি, হোয়াইট ভিনেগার, গিস্নসারিন। আলু থেকে স্টার্চ বানানোর প্রক্রিয়া: বাজার থেকে গোল আলু কিনে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে ছিলে নিতে হবে। তারপর ছিলা আলুকে কুচিকুচি করে কেটে বা গ্রিটারে গ্রিট করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে ১০ মিনিট। তারপর হাত দিয়ে চেপে বা অন্য যে কোনো উপায়ে চেপে চেপে ভেতরের সমস্ত নির্যাস বের করে নিতে হবে। শেষে সেই পানিটা কোনো পরিষ্কার পাত্রে রেখে দিলে তলায় স্টার্চ জমা হবে। এই স্টার্চটা লালচে ময়লাযুক্ত থাকবে। একে কয়েকবার পাতন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিলে ধবধবে সাদা পরিষ্কার স্টার্চ পাওয়া যাবে। প্রতি ১০ কেজি আলু থেকে ১৩০০ থেকে ১৬০০ গ্রাম স্টার্চ তৈরি করা সম্ভব। স্টার্চ তৈরি করা যায় এমন শস্য যেমন- চাল, ভুট্টা এবং কাসাভা থেকেও এই পলকা তৈরি করা যাবে বলে জানান সুমন। স্টার্চ থেকে পলকা (চঙখকঅ) বানানোর প্রক্রিয়া: আলুর তৈরি স্টার্চ জটলা পাকানো গাদা গাদা পলিমারের একটা দঙ্গল। আগুছালো এই পলিমারের লং চেইনগুলোতে পানি মেশালে তা মোটামুটি ব্যবহার উপযোগী হয়ে উঠে। লংচেইন পলিমার যেমন হয় সে রকম হয় দেখতে। কিন্তু অণুবীক্ষণিক লেভেলে এতেও প্রচুর শাখা প্রশাখা থেকে যায়। এই শাখা প্রশাখা ছেঁটে ফেলে একে একটা সিঙ্গেল লংচেইন পলিমারে রূপান্তরের জন্য ভিনেগার বা ২০% এসিটিক এসিড প্রয়োগ করতে হবে এই অবস্থায় 'পলকা' বানালে পস্নাস্টিকের মতো একটা কিছু হবে, কিন্তু তা হবে খুবই শক্ত ও ভঙ্গুর। ভঙ্গুর প্রবণতা কমানো ও জিনিসটাকে নরম বা ফ্লেক্সিবল করার জন্য এই মিশ্রণে পস্নাস্টিসাইজার প্রয়োগ করতে হবে। এখানে আমরা পস্নাস্টিসাইজার হিসেবে গিস্নসারিন ব্যবহার করবো। গিস্নসারিনের অণুগুলো লংচেইন পলিমারের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে পড়ে একে নরম করে ফেলে। এই নরম পলকাকে কোনো ফ্ল্যাট সারফেসে লেপ্টে দিলেই পেয়ে যাব আমাদের কাঙ্ক্ষিত পলকা শিট। শিট থেকে পরে আমরা ব্যাগ বার্ যাপিং পেপার বানিয়ে নিতে পারব সহজেই। পরীক্ষা করার জন্য একটা পাত্রে ১০ গ্রাম স্টার্চ, ৫ মিলি ভিনেগার, ৫ মিলি গিস্নসারিন, ৬০ মিলি পানি ভালো করে মিশিয়ে গরম করতে হবে। কিছুক্ষণ গরম করলে এটি ঘন থিকথিকে হয়ে উঠবে। গরম অবস্থাতেই একে কোনো ফ্ল্যাট সারফেসে লেপে দিয়ে ওভেন বা ড্রায়ারে ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১ ঘণ্টা শুকাতে হবে। শুকানোর পর যে পলিমার শিট পাওয়া যাবে সেটাই 'পলকা'। এবার ওই পলকা শিট যে কোনো আকৃতিতে কেটে নিয়ে ব্যাগ, ডৎধঢ়ঢ়রহম চধঢ়বৎ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আলু থেকে পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ তৈরির এই উদ্যোগে প্রয়োজন সরকারি- বেসরকারি সহায়তা। নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানাতে গিয়ে এই তরুণ গবেষক জানান, আমার প্রধান কয়েকটি পরিকল্পনার হচ্ছে প্রথমত, ১ টাকায় পলকা ব্যাগ বাংলাদেশের মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়া। দ্বিতীয়ত, পাহাড় আর সমতলে পানি শূন্য কিছু জায়গা আছে। আবার কিছু জায়গায় আছে লোনা পানি। খাওয়া যায় না ব্যবহার করা যায় না। তাদের জন্য কমপক্ষে খাবার পানির ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া বিভিন্ন পস্নাস্টিক পণ্যের বিকল্প তৈরি করে যাওয়া। চতুর্থত বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য নতুন একটা নবায়নযোগ্য শক্তির সর্বসাধারণের ব্যবহার উপযোগী প্রযুক্তি উন্নয়ন করা। যার কাজ ইতোমধ্যে চলছে। কিন্তু গবেষণা আর মানুষের হাতে এই উদ্ভাবনগুলো পৌঁছে দেয়ার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। কোথায় এত টাকা পাব, জানি না। শুধু জানি, কাজগুলো আমাকে করতেই হবে।