বন্ধুপোকা লেডিবাগ বিটলস

প্রকাশ | ১৯ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

জায়েদ ফরিদ
জৈব নিয়ন্ত্রণের কথা মানুষ অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভেবে এসেছে। চীনের লেবুচাষিরা পাতা-খাওয়া পোকা নিধন করার জন্য অঙ্কফিলা (ঙহপড়ঢ়যুষষধ ংসধৎধফরহধ) পিঁপড়ার বাসা লাগিয়ে রাখত গাছে, আবার এক গাছ থেকে আরেক গাছে পিঁপড়াদের চলাচলের জন্য তৈরি করে দিত বঁাশের সঁাকো। ১২০০ সালের দিকে ইয়েমেনিরাও পাহাড় থেকে সংগ্রহ করে আনতো বাসাসহ শিকারজীবী পিঁপড়ে, মরুদ্যানে খেজুর বাগানের পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য। মরিশাস দ্বীপে আখের ক্ষেতে পঙ্গপালের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল ঝঁাকঝঁাক শালিক পাখি। এই ফসল বিনষ্টকারী পঙ্গপালদের পরিপূণর্ভাবে জৈব নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের সময় লেগেছিল ১৭৬২ থেকে ১৭৭০ সাল পযর্ন্ত, আট বছর। বিদেশিনী এক মালঞ্চবালা জবাগাছের চারদিকে ইউক্যালিপ?টাসের বিষাক্ত মালচ্? যাতে গাছে পিঁপড়ে না ওঠে। জবার কচি পাতা আর ফুলের কুঁড়ি নষ্ট করে ফেলে এফিড পোকারা। এই এফিড ধরার জন্য পিঁপড়ে ওঠে গাছে। পিঁপড়েরা পোকাগুলো ধরে নিয়ে যায় তাদের গণবসতিতে। আস্তানার দেয়ালের পাশে এগুলোকে রাখে তারা আর ব্যবহার করে দুধেল-গাভীর মতো। মাথার শুঁড় দিয়ে সুড়সুড়ি দিলে এই পোকার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে একপ্রকার মধুরস যা পিঁপড়েরা তাদের বাচ্চাদের খাওয়ায়। এখন প্রশ্ন হলো, পিঁপড়ে ওঠা বন্ধ হলে জবাগাছের এফিড সমস্যা তো আরও প্রকট হবে। মালঞ্চবালা জানালো, এর জন্য সে গাছে লেডিবাগ ছাড়বে। লেডিবাগ তার বাচ্চাদেরও প্রিয়, অতএব, ভালোই হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে লেডিবাগ আদৌ বাগ? নয়, বিটলস। আমেরিকাতে প্রথমে এর নাম ছিল লেডিবাডর্ যা ক্রমেই লেডিবাগে রূপান্তরিত হয়েছে। জামাির্নতে এখনো এর নাম গধৎরবহশধভবৎ যার অথর্ মেরি বিটলস। বেশির ভাগ বাগ?দের পিঠ দেখতে সাধারণত কৌণিক চেক ডিজাইনের কিন্তু বিটল?দের পিঠ মাঝখান থেকে লম্বালম্বি দুইভাগ করা। আমাদের দেশি গুবরে পোকা এক ধরনের বিটলস, এফিড ও গান্ধিপোকা বাগ। বাজার থেকে কালচার করা লেডিবাগ কেনা হলো প্রায় শ’দুয়েক। কিন্তু রাত্রি গভীর হলে অন্ধকারে পোকাগুলো ছাড়তে গেলেন তিনি, কারণ দিনের বেলা ছাড়লে না কি সেগুলো এদিক-ওদিক উড়ে যেতে পারে। পরদিন থেকে লেডিবাগের জন্য এফিডের সংখ্যা কমতে থাকল, ফুটতে থাকল বড় বড় পঁাচপাপড়ি জবা ফুল। এই যে জৈব উপায়ে অপকারী পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেল এটা জৈবনিয়ন্ত্রণ বা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে অতি ক্ষুদ্রকায় ফিলক্সেরা পোকার আক্রমণে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল আঙুর বাগানগুলো। মাইলের পর মাইল ধরে শুকিয়ে যাচ্ছিল বাগানের আঙুরলতা। পাতা, কাÐ শেকড় কোথাও বাদ ছিল না পোকার আক্রমণ। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, আঙুরগাছ পরিপূণর্ভাবে লুপ্ত হয়ে যাবে সমগ্র পৃথিবী থেকে। রেস্টুরেন্ট ও মদ্য ব্যবসায়ীরা ঋণগ্রস্ত হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ায় স্কুল-কলেজ ছুটি দেয়া হয়েছিল যাতে ছাত্ররা ঝঁাঝর দিয়ে তুঁতের দ্রবণ ঢালতে পারে গাছের গোড়ায়। মাটির নিচে গাছের শিকড় থেকে রস শুষে খাচ্ছিল এই পোকা, দ্রবণ ঢালার কারণে সাময়িকভাবে বিরত হলেও কাজ হচ্ছিল না তাতে। ফ্রান্সে এই আক্রমণ ছিল ভয়াবহতম। এমন দুঃসময়ে পোকাদের জৈবনিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের জনক ‘চালর্স ভ্যালেন্টাইন রিলে’ আমেরিকা থেকে ফ্রান্সে পাঠিয়েছিলেন এক ধরনের পরজীবী কীট (ঞুৎড়মষুঢ়যঁং ঢ়যুষষড়ীবৎধব)। এই কীট খানিকটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল কিন্তু তেমন ফলপ্রসূ না হওয়ায় তিনি ফরাসি আঙুরগাছকে সফলভাবে গ্রাফটিং করেছিলেন আমেরিকান আঙুরগাছ (ঠরঃরং ষধনৎঁংপধ)-এর গোড়ার সঙ্গে যা ছিল ফিলোক্সেরার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। নিষ্ঠ পতঙ্গবিদ ভ্যালেন্টাইন রিলের আঙুরগাছকে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখার এই অবদানকে মানুষ নিষ্ঠার সঙ্গে স্মরণ করবে চিরকাল। লেডিবাগ খুব আস্তে করে ধরতে হয়, একটু চাপ লাগলেই এরা কটুগন্ধ হলুদ রক্ত নিঃসৃত করে, যা বের হয় হঁাটুর সন্ধি থেকে। এদের কালচার করা কঠিন কিছু নয়। খাবার হিসেবে এফিডসহ ছোট ডাল কেটে দেয়া যায়, অথবা একটু জল দিয়ে হালকা করা মধুর রস তুলায় লাগিয়ে রাখা যায়, যাতে দুদিন চলতে পারে। পলিথিন দিয়ে গাছের এফিডসমৃদ্ধ এলাকাটা আটকে দিতে হবে ছিদ্র রেখে, আর খেয়াল রাখতে হবে যাতে গাছে পিঁপড়ে উঠে না পড়ে। লেডিবাগের শত্রæ কম হলেও এরা গলদা ফড়িং, বোলতা, মাকড়সা ও কাকের খাদ্য। ইউরোপে এক সময় এফিডের আক্রমণ চরমে উঠেছিল। কৃষকরা সে সময় নিরুপায় হয়ে দলগতভাবে ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রাথর্না করেছিল। তখন আকস্মিকভাবে লেডিবাগের আবিভার্ব হয় সেখানে। প্রথমদিকে তারা ঘাবড়ে গিয়েছিল, একে নতুন কোনো শস্য-ধ্বংসকারী পোকা মনে করে। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারল এটা পরম উপকারী পোকা, তাদের সম্পদ তথা জীবনকেও রক্ষা করছে, তখন তারা মনে করল এটা নিশ্চয়ই ঈশ্বরের অবদান; তাই যিশুমাতার স্মরণে লেডিবাগ নামটির জন্ম হলো সেই থেকে। এফিড ও অঁাশপোকা দূর করার জন্য লেডিবাগ বেশ কাযর্কর। যদিও পিঁপড়েরা সামান্য কিছু এফিড ধরে নিয়ে যায় তাদের ফামির্ংয়ের জন্য কিন্তু জবা বা গোলাপগাছকে এফিডমুক্ত করার জন্য লেডিবাগ একটি উত্তম প্রাকৃতিক সমাধান। বিদেশে লেডিবাগ কিনতে পাওয়া যায়, অনলাইনেও খবর পাওয়া যায়। বাগগুলো ছাড়তে হয় রাতের বেলায়, ফ্রিজে একটু ঠাÐা করে নিলে আরেকটু ভালো হয়। প্রায় ৫০০০ প্রজাতির লেডিবাগের মধ্যে কয়েকরকম বেশ চোখে পড়ে আমাদের। খুব সাধারণ ৭ ফেঁাটা লেডির নাম কক্সিনেলা (ঈড়পপরহবষষধ ংবঢ়ঃবসঢ়ঁহপধঃধ). তবে এফিড নিধনে সবচেয়ে উপযোগী বোধ হয় ঐরঢ়ঢ়ড়ফধসরধ পড়হাবৎমবহং. গড়পড় তা একটি লেডিবাগ দিনে ৫০টি এফিড খায় আর জীবদ্দশায় ৫০০০টি, যা অবিশ্বাস্য মনে হয়। যদি লেডিবাগ সংগ্রহকে সমস্যা বলে মনে হয় তবে উপদ্রæত ডালে ও পাতায় উগ্রগন্ধী ইউক্যালিপটাস অয়েল স্প্রে করা যেতে পারে, তাতেও এফিড চলে যাবে। তবে এই তেল সংগ্রহেরও ঝামেলা আছে কারণ সব দেশে সব বাজারে এবং মালঞ্চবালার দেশে এটা অনায়াসলভ্য নয়। এফিড তাড়ানোর একটি সহজ উপায় হলো, খুব হালকা ডিশওয়াশিং সোপ-সলিউশান দিয়ে স্প্রে করা। এতে অবশ্য ফুলে ফুলে মৌমাছি দেখা যাবে না, কারণ প্রাণঘাতী সোপ-সলিউশনের আশপাশে মৌমাছি থাকে না, আর সে কারণে বাগানের বহু গাছের পরাগায়ন ব্যাহত হতে পারে। অতএব, যেসব বাগানে মৌমাছিকে বিকট সমস্যা মনে করা হয় কেবল সেখানেই সাবান-পানি ছেটানো সমীচীন।