কোরবানির জন্য প্রস্তুত সোয়া কোটি গবাদিপশু

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিবৃতি অনুযায়ী, গত বছর কোরবানিতে দেশে ১ কোটি ৪ লাখ পশু জবাই হয়েছিল। এবার ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য প্রায় সোয়া কোটি গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণী রয়েছে। তাই এ বছর কোরবানির হার ৫ শতাংশ বাড়লেও গরু-ছাগলের অভাব হবে না এমনটিই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের... বিস্তারিত লিখেছেনÑ এসএম মুকুল

প্রকাশ | ১৯ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আসন্ন কোরবানির ঈদে কমপক্ষে ৭০ লাখ গরু-মহিষ ও ৮০ লাখ ছাগল-ভেড়া কোরবানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে
ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী জমে উঠে হাজার হাজার কোটি টাকার কোরবানি পশুর বাজার। ঈদ অথর্নীতির আকার বড় হচ্ছে প্রতি বছর। এর কারণ মানুষের আথির্ক সমৃদ্ধি বেড়েছে। সামনে জাতীয় নিবার্চন থাকায় এ বছর কোরবানিতে রাজনীতির প্রভাব পড়বে বলে অনেকের ধারণা। তাছাড়া কোরবানির জন্য প্রবাসীরাও দেশে অথর্ পাঠান। সব মিলিয়ে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়া এবং এবার নিবার্চনের বছরে ঈদ হওয়ায় দেশের অথর্নীতিতে বাড়তি দুই হাজার কোটি টাকা যোগ হতে পারে বলে ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন। প্রতি বছরের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা আশা করছেন সব মিলিয়ে কোরবানির ঈদ অথর্নীতিতে আথির্ক লেনদেন পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। কোরবানির অথর্নীতি কোরবানি বাংলাদেশের অথর্নীতির অন্যতম বড় একটি খাত। ২০১৮ সালে কমপক্ষে ৭০ লক্ষ গরু-মহিষ ও ৮০ লক্ষ ছাগল-ভেড়া কোরবানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ৭০ লাখ গরু গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে হলে কমপক্ষে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হবে। ৮০ লক্ষ ছাগল গড়ে ১০ হাজার টাকা করে হলে ৮ হাজার কোটি টাকা। তার মানে শুধু কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অথর্নীতিতে সম্পৃক্ত হবে কমবেশি ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও কোরবানির পশু বঁাধার রশি, খুঁটি, বঁাশ, সাজ-সজ্জার উপকরণ, পশুর খাবার- খড়, ভুষি, ঘাস-পাতা এবং কোরবানির পশু হাটে আনা- নেয়ায় জড়িত ট্রাক, লঞ্চসহ অন্যান্য পরিবহন খাতে বিপুল পরিমাণ আথির্ক লেনদেন ঘটে। সেই সঙ্গে লাখো লোকের রুটি-রুজির সম্পকর্ রয়েছে। আরও আছে পশুর হাটে হাসিল আদায় ও আদায়ের কাজে জড়িতদের আয়। আছে চামড়া থেকে আয়, গড়ে ২ হাজার টাকা করে ৭০ লাখ গরুর চামড়া থেকে আসে ১৪শ কোটি টাকা এবং ৮০ লক্ষ ছাগলের চামড়া গড়ে ২শ’ টাকা ধরা হলো ১৬০ কোটি টাকা। মোট প্রায় ১৫৬০ কোটি টাকার অথর্নীতি এই খাতের সাথে সম্পৃক্ত। আবার জুতা, ব্যাগসহ অন্যান্য চামড়াজাত পণ্যের বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা রয়েছে। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য চামড়ায় লবণের ব্যবহার হয়ে থাকে। জানা যায় এর পরিমাণ প্রায় ২ লাখ টন। আরও আছে কোরবানির পশুর হাড়, চবির্, শিং, দঁাত, লেজের পশম ইত্যাদির বহুমুখী শিল্প ব্যবহার। যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুল পরিমাণ অথৈর্নতিক লেনদেন হয়। পশুর ভ‚ড়ির বজর্্য উন্নতমানের সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পশুর রক্ত মাছের সবচেয়ে উন্নতমানের প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হিসেবে বিশ্বজুড়ে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। তাছাড়া পবিত্র কোরবানিকে ঘিরে মশলার ব্যবসাই হয়ে থাকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। কাজেই দেশের অথর্নীতির চাকার গতি সঞ্চার করতে কোরবানির একটি বড় ভ‚মিকা রয়েছে। চাহিদা মিটবে দেশি গরুতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য ১ কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণী রয়েছে। অধিদপ্তরের বিবৃতি থেকে জানা যায়, কোরবানির জন্য পশুর মধ্যে ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭১ লাখ ছাগল-ভেড়া ও প্রায় ৩২ হাজার উট-দুম্বা প্রস্তুত রয়েছে। খামারে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া গরু-মহিষের মধ্যে প্রায় ২৯ লাখ ১০ হাজার। বাকি ১৫ লাখ ৪৬ হাজার অনুৎপাদনশীল বা বয়স্ক। এ বছর ছাগল-ভেড়ার মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট ১৮ লাখ ২৬ হাজার এবং অনুৎপাদনশীল ৫২ লাখ ৭৩ হাজার। তাহলে দেশি গরুতেই ঈদুল আজহার কোরবানির চাহিদা মিটবে বলে আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিবৃতি অনুযায়ী, গত বছর কোরবানির ঈদে দেশে ১ কোটি ৪ লাখ পশু জবাই হয়েছিল। তাই এ বছর এই হার ৫ শতাংশ বাড়লেও গরু-ছাগলের অভাব হবে না এমনটিই প্রত্যাশা তাদের। তাছাড়াও কোরবানির বাজারে ওঠানোর জন্য খামারে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া গরু-মহিষের সংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ ১০ হাজার। দেশের গরু পরিপূণর্ হতে চার-ছয় বছর সময় নেয়। স্বল্প সময়ে উৎপাদন বাড়াতে ব্রাজিলের বুল এবং প্রযুক্তি এনে তা ব্যবহারের মাধ্যমে দেড়-দুই বছরের মধ্যে গরু জবাইয়ের উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সামগ্রিক পদক্ষেপের ফলে দেশি পশুতে কোরবানির চাহিদা মেটানোর সুযোগ-সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে নিবিড় তদারকির মাধ্যমে এই উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিয়ে পশুর মাংস চাহিদার চেয়ে অধিক উৎপাদন সম্ভব হবে দেশেই। দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ এটি একটি আশাবাদের খবর। অন্যান্য বছর ট্যাবলেট খাইয়ে, ইনজেকশন পুশ করে যারা গবাদপশু কোরবানির বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে মোটাতাজা করেছেন তাদের মাঝে অনেকেই এবার দেশীয় পদ্ধতিতে গবাদিপশু মোটাতাজা করেছেন কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য। কৃষক, গৃহস্থ ও খামারিরা কঁাচা ঘাস, ধানের খড়ের পাশাপাশি গরুকে খৈল, কুঁড়া, ভুসি খাওয়াচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন খামারিদের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত খবরে এসব তথ্য জানা গেছে। বিভিন্ন খবর বিশ্লেষণে দেখা গেছে সরকারের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রচারণা, নিদের্শনা ও তদারকির ফলে খামারিদের মাঝে এমন সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেখা গেছে, গত বছর যারা মোটাতাজাকরণের ট্যাবলেট খাইয়ে গরু নাদুসনুদুস করে হাটে তুলেও দাম পায়নি, তারাই এবার দেশীয় পদ্ধতিতে গরু লালন-পালন করেছেন। খবরে প্রকাশ, কিছু খামারি অধিক লাভের লোভে কোরবানির ঈদের আগে গরুকে ইনজেকশন দিতেন অথবা বড়ি খাওয়াতেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যে গরু ফুলে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেত। কিন্তু গত বছর কোরবানির ঈদের হাটে নাদুসনুদুস গরুর প্রতি মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই এবার কৃষক, গৃহস্থ’ ও খামারিরা ইনজেকশন ও ট্যাবলেট ছেড়ে দেশি পদ্ধতিতে খৈল, কুঁড়া, ভুসি খাইয়ে গরু মোটাতাজা করছেন। সচেতন ক্রেতারা খামারমুখী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২৮ লাখ পরিবার সরাসরি গবাদি পশু পালনের সঙ্গে জড়িত। দেশে ৬০ শতাংশ গরু পালন করা হয় কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলায়। সাদা ধবল গরু আর ভুটানের বুট্টি গরুর জন্য খ্যাত মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের ধবল গরু বানাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। ভারত ও ভুটানের আবাল-পশ্চিমা সাদা ষঁাড় ও সাদা গাভীর বাচ্চা কিনে আনেন মীরকাদিমের খামারিরা। প্রতিটি গরু বড় করতে ও কোরবানির হাটে বিক্রি করার জন্য উপযোগী করে তুলতে ৪-৬ মাস সময় লাগে। ধান-চাল আর তেলের কারখানা থাকার কারণে মিরকাদিমের গরুকে মিনিকেট চালের খুদ, এক নাম্বার খৈল, ভাতের মার, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভুসি, গমের ভূষি, বুটের ভূষি খাওয়ানো হয়। এসব গরুর সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ গনিমিয়ার হাটে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে খাওয়ায় সুস্বাদু এই গরু কিনতে আসেন রহমতগঞ্জের গনিমিয়ার হাটে। নিরাপদ পশুর জন্য বিশেষত ঢাকার ক্রেতারা পশু কিনতে খামারমুখী হচ্ছেন। হাটে মানুষের ভিড়ে পশু ঠিকমতো দেখা যায় না। দেখে-বুঝে কোরবানির পশু পছন্দ করার জন্যই আগ্রহীরা খামারের পরিবেশকে অনেক ভালো মনে করছেন। এ ছাড়াও সেখানে নেই দালালদের দৌরাত্ম্য, প্রতারকদের খপ্পর। তাছাড়া খামারে যখন-তখন পশু কেনা যায়। জেনে, শুনে, বুঝে নিরাপদ পশু কেনার জন্য অনেকে সরাসরি খামারে ছুটছেন। আশার খবর হচ্ছেÑ ভারতীয় গরু আমদানিতে সীমান্তবতীর্ রাজশাহী, যশোর, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৩১টি করিডোরের ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। লেখক : অথর্নীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক