শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেরপুরের ব্র্যান্ডিং সুগন্ধি তুলসীমালা চাল

শেরপুর জেলার ব্র্যান্ডিং নির্ধারণ হয়েছে 'পর্যটনের আনন্দে, তুলসীমালার সুগন্ধে'। এরপর থেকেই সুগন্ধি চাল তুলসীমালার চাহিদা শেরপুর জেলার বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বেড়েই চলছে। শুধু দেশেই নয়, তুলসীমালা এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তুলসীমালার চাল দিয়ে সুস্বাধু সুগন্ধি ভাত থেকে শুরু করে পোলাও, রিবিয়ানি, খিচুড়ি, ফিন্নি ও পায়েসসহ বিভিন্ন মজাদার খাবার তৈরি করা যায়। তাই স্বাদের ক্ষেত্রে তুলসীমালার বিকল্প নেই। দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা প্রজাতির সুগন্ধি ধানের চাল উৎপাদিত হলেও শেরপুরের সুগন্ধি তুলসীমালার চাল অতুলনীয়।
রফিক মজিদ, শেরপুর
  ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৫৫

আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহ্যকে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচারের লক্ষ্যে সম্প্রতি সারাদেশের প্রতিটি জেলায় ব্র্যান্ডিং নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় বিভিন্ন পণ্য, খাদ্য ও দর্শনীয় স্থান সুপরিচিতি লাভ করেছে। যেমন- খাদ্যের মধ্যে বগুড়ার দই, টাঙ্গাইলের চমচম, ময়মনসিংহের মন্ডা, কুমিলস্নার রসমালাই, চাঁদপুরের ইলিশ ইত্যাদি দেশ জুড়ে খ্যাতি রয়েছে। ঠিক তেমনি শেরপুরের ছানার পায়েসেরও জুড়ি নেই।

তবে সম্প্রতি শেরপুর জেলার ব্র্যান্ডিং নির্ধারণ হয়েছে 'পর্যটনের আনন্দে, তুলসীমালার সুগন্ধে'। এরপর থেকেই শেরপুর জেলার ব্র্যান্ডিং সুগন্ধি চাল তুলসীমালা সম্প্রতি জেলার বাইরে বিভিন্ন জেলায় এর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। শুধু দেশেই নয়, তুলসীমালা এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশেও বিস্তার লাভ করছে। এমন সুগন্ধি ও সুস্বাধু চালের ভাত থেকে শুরু করে পোলাও, রিবিয়ানি, খিচুড়ি, ফিন্নি ও পায়েসসহ বিভিন্ন মজাদার খাবার তৈরিতে তুলসীমালার বিকল্প নেই।

দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা প্রজাতির সুগন্ধি ধানের চাল উৎপাদিত হলেও শেরপুরের সুগন্ধি চাল তুলসীমালার বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে জেলা ওয়েবসাইট 'আওয়ার শেরপুর' শেরপুরের সুগন্ধি চাল ও জেলা ব্র্যান্ডিং তুলসীমালাকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে। ফলাফলও বেশ ভালো হয়েছে। এই ফেসবুক পেজে তুলসীমালার চাষ নিয়ে এক কবি লিখেছেন- চাঁনপুর বিলে এখনো চলে, তুলসীমালার চাষ; ধান কেটে বিল ভরে রেখে, চাষা হাসে এক রাশ; চাঁনপুর বিলে বাবাও ফলায় হরেক রকম ধান; বিলে বিলে ছুটে তাই ফেলে রোজ সকাল বিকাল ঘাম। ভালো ফলনে বাবা খুশি বেশ, গুন গুন করে গান; বাবার সাথে আমরাও খুশি, খুলে হাসি মনপ্রাণ।

সাধারণত তুলসীমালা চাল এখানে ৫০ কেজি বস্তা থেকে খুচরা বিক্রেতারা কেজি দরে বিক্রি করে থাকে। আওয়ার শেরপুর এটাকে দেশ- বিদেশে চাহিদা বাড়াতে ১ কেজি সাইজের প্যাকেট জাত করে অনলাইন ও ফেসবুকে প্রচারণা চালিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে এর নাম ও সুনাম। প্রতিদিনই বাড়ছে এর চাহিদা। তুলসীমালা সুগন্ধি চালের বিষয়ে বিশেষ করে এ চাল দিয়ে বিভিন্ন সুস্বাধু খাবার রান্না করে তা ইতোমধ্যেই ফেসবুকে পোস্ট করায় ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটছে। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) ফেসবুকে গ্রম্নপ থেকে নেয়া বিভিন্ন জনের মন্তব্য- ফাতেমা-তুজ-জহুরা রজনী তার ফেসবুক পোস্টে তুলসীমালা নিয়ে লিখেছেন, আমার সংসারে একমাত্র ইন্ডিয়ান পণ্য হচ্ছে 'দাওয়াত' বাসমতী চাল আর পাকিস্তানি পণ্য হচ্ছে 'শান' বিরিয়ানির মসলা। আওয়ার শেরপুরের দেলোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে তুলসীমালা আনার পরে হঠাৎ করে পিঠা শপের আনিস ভাই কল দিলেন যে, উনি আসবেন। তখনই আমি তুলসীমালা রান্না করি। এরপর ভাইয়ায় সঙ্গে খেতে খেতে জীবনের প্রথমবারের মতন বুঝলাম যে ভাতেরও স্বাদ হয় ! এই তুলসীমালা খেতে এতই মিষ্টি যে আমার মনে হয়েছে এটা এমনিতেই খাওয়া যায়। আমার মেয়ে ও মজা করে খেয়েছে।

মাশিয়াত মাসুদ মুমু তার ওয়ালে লিখেছেন, 'তুলসীমালার ইলিশ পোলাও, সাতক্ষীরা শপের ঘি', সকাল বেলা ঘুমই ভাঙলো আমার হাজব্র্যান্ডের হইচই। আম্মু নাকি বিশাল মজার এক ডিশ বানিয়েছে। উঠতেই টেবিলে দেখি ইলিশ পোলাও আর চিংড়ির মালাইকারী। আম্মু বললো 'আরেহ তোমার চাল আর ঘি তো কামাল করে দিসে।' আম্মু আর আমার জামাইয়ের ভাষ্যমতে চাল আর ঘি দুটিই একদম অরিজিনাল। দুটির ঘ্রাণই একদম মনমাতানো। আমার জামাই তো অলরেডি দেশের বাইরে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করবে আর সেখানে এই চালের তৈরি খাবার রাখবে এই ঘোষণা দিয়ে দিসে। আমার এটা শোনার পর মনে হচ্ছে মাত্র ২ কেজি না নিয়ে আরো বেশি নেয়া উচিত ছিল।

ফারিয়া আবেদীন রাফার লেখা, তুলসীমালা পুরাই বাজিমাত করে ফেলেছে। তুলসীমালা দিয়ে পায়েস অনেক মজা হয়েছে, আমি পুরো এক বাটি খেয়ে ফেলসি। ভাবতেছি মেয়ের খিচুড়ি, সুজির জন্য ভাঙিয়ে নেব।

জেলা ওয়েবসাইট 'আওয়ার শেরপুর' এর প্রতিষ্ঠাতা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, শেরপুর জেলাকে ফেসবুক আর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সারাদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে আমি দুই বছর ধরে কষ্ট করে যাচ্ছি। এতদিনে এর সুফল দেখতে পাচ্ছি বলা যায়। তুলসীমালা শেরপুরের গর্ব এবং অনেকেই আমাকে বলেছে যে, এই চাল খেতে সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর এবং খাবার পর আরাম লাগে শরীরে। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) থেকে আমি সর্বাত্মক সাহায্য পেয়েছি। তারা দেশি পণ্য নিয়ে অনলাইনে প্রতিদিন কাজ করছে এবং এর সুফল আমি নিজেই পেয়েছি। তুলসীমালার শতভাগ কাস্টমারই এই গ্রম্নপের। ফারহানা কানন লাকী ফেসবুকের মাধ্যমে ৫ কেজি চালের অর্ডার করেন এবং সুন্দরবন কুরিয়ারের মাধ্যমে পার্সেল হাতে পেয়ে এ চালের ভাত খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেন কোরিয়ায় থাকা পরিবারের সদস্যদের জন্য নিয়মিত তুলসীমালা চাল পাঠাবেন। চলতি মাসের ২৫ তারিখে কোরিয়ায় পাঠানোর জন্য ২০ কেজি চালের অর্ডারও করেছেন।

এদিকে জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় ১৪ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে তুলসীমালা ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪ হাজার ৮০০, নকলায় ২ হাজার ৫৯০, নালিতাবাড়ীতে ৪ হাজার ৬০, ঝিনাইগাতীতে ২ হাজার ১১০ এবং শ্রীবর্দী উপজেলায় ৯৮০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এতে চাল হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, সম্প্রতি তুলসীমালাকে জেলা ব্র্যান্ডিং করে জেলা প্রশাসন থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর কারণে এর আবাদ এবং চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্বের ধান চাষের আদি ভূমি এই বাংলায় এক সময় অঞ্চলভেদে সহস্রাধিক জাতের ধানের চাষ হতো। জল-কাদায় গড়া এই বঙ্গীয় বদ্বীপে ধানের জাতের নাম হয়েছে তাই জলকুমারী, মধুমালা, জলকাদা, খেজুরঝুপি, তুলসীমালা, জামাই পাগল প্রভৃতি। ধান বিজ্ঞানীদের মতে, এমন হাজারো সরু সুগন্ধি ধানের জাত বাংলার জীবন ও রূপকথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুণ, বৈশিষ্ট্য, সমাজ আর ইতিহাস প্রতিটি ধানের নামের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। উফশী ধানের পাশাপাশি এগুলোকে বিভিন্নভাবে ব্র্যান্ডিং করা গেলে দেশের মানুষ যেমন উপকৃত হবে বিদেশেও আমাদের চালের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<86023 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1