সাপ তাড়ানো উদ্ভিদ ঘুঘুলতা

প্রকাশ | ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৫৯

জায়েদ ফরিদ
একটি গাছের ফুল, দেখতে যদি বেলি, জবা, জিনিয়া বা কসমসের মতো হয় তখন তার সৌন্দর্যকে স্বাভাবিক ভাবী। কেন্দ্র থেকেই পাপড়িগুলো বিকশিত হয়। কিন্তু যখন তা দেখতে লম্বা লেজ ঘুঘুপাখি বা হংস-দেহের মতো হয় তখন নানারকম কৌতূহল ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ইংরেজিতে ঘুঘুলতার সবচেয়ে প্রচলিত নাম 'ডাচম্যানস্‌? পাইপ' কারণ একে দেখতে বাঁকানো ডাচ পাইপের মতো লাগে। ঘুঘুর গায়ের ফুটকিগুলোর সঙ্গেও বেশ মিল রয়েছে ঘুঘুলতা ফুলের। অনেকে একে সাপুড়ের বিন বাঁশির সঙ্গেও তুলনা করেন। এবার উদ্ভিদ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। এই উদ্ভিদের আমাদের দেশে যে কয়টি প্রজাতি দেখেছি তার মধ্যে অ্যারিস্টোলোকিয়া লিটোরালিস (অৎরংঃড়ষড়পযরধ ষরঃঃড়ৎধষরং) প্রজাতির হংসলতা নামটি বেশ মানানসই। হাঁসের দেহের মতো অবয়ব, গলাটাও মেলানো যায়। দেখতে লাগে যেন বেগুনি রঙের হাঁস। হাঁসের বেগুনি পালকের ডিজাইনটা কম্পিউটার থেকে উৎপাদিত ফ্রাক্‌?টাল আর্টের মতো, যা আর কিছু নয় কেবল মৌলিক দাগের জ্যামিতিক পুনরাবৃত্তি। এই ফ্রাক্‌টাল ডিজাইন উপমহাদেশের সহজলভ্য অ্যারিস্টোলোকিয়া ইন্ডিকা প্রজাতিতে দেখা যায় না। ফুলগাত্রে ফ্রাকটাল ডিজাইন না থাকলেও ইন্ডিকা প্রজাতির বীজাধার দেখতে অপূর্ব, মনে হয় শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা কিছু। এই প্রজাতির গাছ চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা যায় বেশি, ফুল বেশ ছোট। দেশি কিছু মূল্যবান ওষুধ তৈরি হয় এই প্রজাতি থেকে। তবে তা মারাত্মক রকমের বিষাক্ত বলে এর ব্যবহারিক মাত্রা নির্ধারণ করা একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ইন্ডিকা প্রজাতির গাছকে সংস্কৃতে বলে রুদ্রজটা, হিন্দিতে এবং বাংলাদেশের অঞ্চলবিশেষে বলে ঈশের মূল। এই মূল পেটের পীড়া, ম্যালেরিয়ার কম্পজ্বর, হাঁপানি, বহুমূত্র, ঋতুনিঃসারণে ও গর্ভনাশে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ ছাড়া এর একটি অদ্ভুত ব্যবহার রয়েছে যার বর্ণনা পাওয়া যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে। আমাদের উপমহাদেশে রাস্তার পাশে সাপখেলা দেখায় সাপুড়েরা। কখনো কখনো তাদের ঝোলায় এক ধরনের শিকড় থাকে যা তারা বিক্রি করে সর্প নিরোধক হিসেবে। সেই শিকড় সামনে আনা মাত্র সাপ ফণা তোলার পরিবর্তে মাথা নিচু করে পালিয়ে যেতে চায়। এই শিকড়টি 'ঈশের মূল' বা অ্যারিস্টোলোকিয়া ইন্ডিকার শিকড়। অ্যারিস্টোলোকিয়া সারপেনটারিয়া (অ. ংবৎঢ়বহঃধৎরধ) প্রজাতির গাছের সাপ তাড়ানোর ক্ষমতা বেশি। সর্পবহুল এলাকায় বিদেশে অনেকে নিরাপত্তার জন্য এই গাছ রোপণ করে থাকেন। অ্যারিস্টোলোকিয়া জেনাসে রয়েছে ৫ শতাধিক গাছ। এই গণের অন্তর্গত অধিকাংশ গাছের পাতা দেখতে গুলঞ্চ পাতার মতো, হার্ট আকৃতির। এদের ফুলের কিছু অনুপম বৈশিষ্ট্য আছে যা মূলত পরাগায়ণের জন্য। অ্যারিস্টোলোকিয়া গাছের যুক্তবৃতি ফোলানো ফুল দেখতে অস্বাভাবিক। তবে একই কারণে একে অস্বাভাবিক সুন্দরও বলা চলে। অ্যারিস্টোলোকিয়া জেনাসের 'লোকিয়া' অর্থ 'চাইল্ড বার্থ।' এই গাছ থেকে প্রস্তুত ওষুধ সন্তান জন্মের আগে ব্যথা-বেদনা ও ক্ষতনাশক হিসেবে কাজ করত বলে এর এক নাম হয়েছে 'বার্থওয়ার্ট।' 'রিনজেনস্‌?' বা 'লিটোরালিস' প্রজাতির ফুল দেখে মনে হয় মাংসাশী কলসি উদ্ভিদ, যা পোকামাকড় আটকে জারক রসে ডুবিয়ে ভক্ষণ করে। এসব গাছও পোকামাকড় আটকাতে পারে তবে তাদের ভক্ষণ করে না, ব্যবহার করে পরাগায়ণের জন্য। ফুলের ফোলা অংশের ভেতরে তৈরি হয় একপ্রকার কটুগন্ধ রসায়ন, অনেকটা পচা মাংসের মতো। এই গন্ধে মাছি-জাতীয় পোকা চলে আসে এবং টিউবের গায়ে একমুখো হুলের কারণে ভেতরে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকে। এতে পরাগে মাখামাখি হয়ে যায় পোকার গাত্র। এক সময় এই হুল সঙ্কুচিত হলে পোকারা বেরিয়ে গিয়ে অন্য ফুলে পরাগায়ণ করে। এই পরাগায়ণ, আটকানো ফুলের চেয়ে অন্য ফুলেই বেশি হতে দেখা যায়। সৌন্দর্যের কারণে এই কাষ্ঠল লতাকে ভূদৃশ্যে কাজে লাগানো হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় ওজন কমানো, বাত ও ঋতুসংক্রান্ত কারণে এর ব্যবহার থাকলেও ২০০১ সালে মারাত্মক বলে এই ওষুধ ব্যান করে দেয়া হয়। আমাদের দেশে আয়ুর্বেদ একে এখনো ব্যবহার করে।