শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফল আর্মিওয়ার্ম থেকে ভুট্টা রক্ষায় করণীয়

ফল আর্মিওয়ার্ম বা সাধারণ কাটুই পোকা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি মূলত আমেরিকা মহাদেশের পোকা হলেও ২০১৬ সালে আফ্রিকা এবং ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে- বিশেষত ভারত, শ্রীলংকায় এ পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। উদ্বেগের বিষয় হলো ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে স্থাপনকৃত ফেরোমোন ফাঁদে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে এ পোকার উপস্থিতি দেখা যায়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদনকারী প্রায় সব জেলাতেই এ পোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফল আর্মিওয়ার্ম সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন- ড. মু. আবুল কাসেম/ ড. মো. ফারুক হাসান/ কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম
নতুনধারা
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বিশ্বব্যাপী ভুট্টার একটি মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিধ্বংসী পোকা হলো ফল আর্মিওয়ার্ম বা সাধারণ কাটুই পোকা যার বৈজ্ঞানিক নাম ঝঢ়ড়ফরঢ়ঃবৎধ ভৎঁমরঢ়বৎফধ। অত্যন্ত ক্ষতিকর, বিকল্প পোষকের উপস্থিতি এবং সেই সঙ্গে দমন ব্যবস্থাপনা কঠিন হলেই কেবল একটি পোকা মারাত্মক ক্ষতিকর বা মুখ্য ক্ষতিকর পোকা হয়ে উঠে। এ তিন বৈশিষ্ট্যের প্রতিটিই রয়েছে এ পোকার মধ্যে। এটি মূলত আমেরিকা মহাদেশের পোকা হলেও ২০১৬ সালে আফ্রিকা এবং ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে- বিশেষত ভারত, শ্রীলঙ্কায় এ পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। উদ্বেগের বিষয় হলো ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে স্থাপনকৃত ফেরোমোন ফাঁদে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে এ পোকার উপস্থিতি দেখা যায়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদনকারী প্রায় সব জেলাতেই এ পোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এই পোকা চেনার উপায়

এ পোকার বাচ্চা বা কীড়ার দেহের উপরি ভাগে দুপাশে লম্বালম্বিভাবে গাঢ় রংয়ের দাগ রয়েছে। দেহের তলপেটের ৮ম অংশের উপরিভাবে ৪টি স্পষ্ট কালো দাগ আছে। মাথায় উল্টা 'ণ' অক্ষরের মধ্যে জালের মতো দাগ রয়েছে।

আক্রমণের মাত্রা, জীবনকাল ও ক্ষতির লক্ষণ

এ পোকা ভুট্টা, সরগম, বাদাম, তামাক, বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজিসহ প্রায় ৮০ প্রকারের ফসলে আক্রমণ করে থাকে। তবে ভুট্টায় আক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। পোকাটি বাচ্চা বা কীড়া অবস্থায় গাছের পাতা ও ফল খেয়ে থাকে। কীড়ার প্রাথমিক অবস্থায় খাদ্য চাহিদা কম থাকে, তবে কীড়া বড় হতে থাকলে বিশেষ করে শেষের দিকে চাহিদা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পায়। সে কারণে শেষ ধাপসমূহে (৪-৬ ধাপ) অর্থাৎ কীড়া পূর্ণাঙ্গ বা বড় আকারের হলে রাক্ষুসে হয়ে উঠে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। এমনকি এক রাতের মধ্যে সমস্ত ফসল নষ্ট করে দিতে পারে।

এ পোকার জীবনকাল ডিম-কীড়া-পুত্তলি-পূর্ণাঙ্গ পোকা- এ চার ধাপে সম্পন্ন হয়। গ্রীষ্মকালে পোকাটি ৩০-৩৫ দিনের এবং শীতকালে ৭০-৭৫ দিনের জীবনকাল সম্পন্ন করে। স্ত্রী পোকা গাছের গোড়ার দিকের কান্ডের সঙ্গে পাতার সংযোগস্থলের নিচের দিকে ১০০-২০০টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বের হওয়া বাচ্চাগুলো পাতা খেতে শুরু করে এবং পাতায় ছোট ছোট সারি ছিদ্র (জড়ি ড়ভ যড়ষবং ষরশব ংুসঢ়ঃড়স) তৈরি করে। কচি গাছের পাতার কানের মতো মুড়ানো অংশ এবং বড় গাছের ভুট্টার মোচার চারপাশে মুড়ানো পাতা খেতে পছন্দ করে। ভুট্টার মোচার চারপাশের পাতা খাওয়ার পর এরা মোচার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং মোচায় তৈরি হওয়া নরম দানাগুলো খেতে থাকে। এর মধ্যে ফল আর্মিওয়ার্মের কীড়াগুলো পরিণত ও বড় হয়ে পাতা খেয়ে ঝাঝরা করে ফেলে এবং ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে ভুট্টা গাছের মাথার দিকে পৌঁছায়। কচি গাছ হলে বৃদ্ধি বন্ধ হয় এবং নতুন কোনো পাতা গজায় না। মোটামুটি ১৪ দিন পর পূর্ণাঙ্গ কীড়া পিউপা বা পুত্তলি দশায় পৌঁছার জন্য মাটিতে পড়ে। এ সময় এরা ১-৩ ইঞ্চি গভীরে অবস্থান করে। মাটি খুব বেশি শক্ত হলে ঝরে পড়া পাতা দিয়ে নিজেদের ঢেকে রাখে। এর প্রায় ৮-৯ দিন পর পূর্ণাঙ্গ মথ মাটি থেকে বের হয়ে আসে এবং পুনরায় জীবনচক্রটি শুরু করে।

পোকা বিস্তারের মাধ্যম

পোকাটি পৃথিবীব্যাপী সঙ্গনিরোধ বালাই হিসেবে পরিচিত। ডিম, কীড়া, পুত্তলি অবস্থায় বিভিন্ন উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত উপাদান যেমন- চারা, কলম, কন্দ, চারা সংলগ্ন মাটি ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। পূর্ণাঙ্গ পোকা অনেক দূর পর্যন্ত উড়তে পারে। এমনকি ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে কয়েক শত কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারে।

পোকা দমনে আমাদের করণীয়

যেহেতু পোকাটি ইতোমধ্যে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলসহ সারাদেশে ভুট্টা আবাদকৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে ব্যাপক ফসল হানির সম্ভাবনা রয়েছে। পোকাটি যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় পোকাটির অবস্থান চিহ্নিত করতে হবে। চারা গজানোর পর থেকে মোচা আসা পর্যন্ত নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মনে রাখবেন মোচায় আক্রমণ হলে এ পোকা দমন করা প্রায় অসম্ভব এবং ফলন শূন্যের কোটায় চলে আসতে পারে। পোকার উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য ফসল লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য ভুট্টা ও অন্যান্য পোষক ফসলের জন্য বিঘাপ্রতি অর্থাৎ ৩৩ শতকে ৫ থেকে ৬টি ফাঁদ পাততে হবে এবং সব সময়ই খেয়াল রাখতে হবে পোকার উপস্থিতি আছে কিনা। পোকাটি রাতের বেলা আক্রমণ করে থাকে, দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে। তাই ভুট্টা গাছে সরাসরি খাওয়ার লক্ষণ বা এদের মল দেখেও আক্রান্ত গাছ শনাক্ত করা যায়। পূর্ণাঙ্গ পোকা, পোকার কীড়া কিংবা ক্ষতির লক্ষণ চেনার জন্য প্রয়োজনে আপনার বস্নকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাহায্য নিতে পারেন।

ক্ষতিকর ও রাক্ষুসে এ পোকাকে দমন বা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের কী কী করতে হবে তা জানা অতি জরুরি। প্রথমত ভুট্টা লাগানোর সময় কোরাজেন (১ মিলি/কেজি বীজ) জাতীয় কীটনাশক দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। গাছের দুই-তিন পাতা অবস্থা থেকেই আক্রান্ত গাছ হতে ডিম বা সদ্য ফোটা দলাবদ্ধ কীড়া সংগ্রহ করে পিষে মেরে ফেলতে হবে অথবা এক ফুট গর্ত করে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। এ ছাড়া হাত বাছাই (ঐধহফ ঢ়রপশরহম) ভুট্টার মোচা আসা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। আক্রান্ত গাছ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় (৯০-১০০ ফুট এলাকা জুড়ে) অতিদ্রম্নত জৈব বালাইনাশক স্পোডোপটেরা নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস (এসএনপিভি) এক লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। এভাবে ৭ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার জৈব বালাইনাশক এসএনপিভি স্প্রে করতে হবে। সম্ভব হলে উপকারী পোকা ব্রাকন হেবিটর (ইৎধপড়হ যবনবঃড়ৎ) আক্রান্ত এলাকায় ছেড়ে দিতে হবে। এরা ফল আর্মিওয়ার্মের কীড়ার গায়ে ডিম পাড়ে। ফলে ওই কীড়াগুলো ভুট্টার ক্ষতি করতে পারে না। যদিও এ পোকা দমনে রাসায়নিক কীটনাশক তেমন কার্যকর নয়, তবে একান্ত প্রয়োজনে প্রোক্লেইম (১ গ্রাম/লি.) বা স্পিনোসেড ট্রেসার (০.৪ মিলি/লি.) বা ভিরতাকো (০.৬ গ্রাম/লি.) বা নাইট্রো (১ মিলি/লি.) জাতীয় কীটনাশক আক্রান্ত জমি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পড়ন্ত বিকেলে ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। কারণ বিক্ষিপ্তভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আর্থিক ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতি এমনকি কীটনাশকের প্রতি পোকার প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হতে পারে। আক্রান্ত ফসলে সেচ দেয়ার সময় যতটুক সম্ভব ঢালাও বা পস্নাবন সেচ দিতে হবে।

ভুট্টা চাষিরা চিন্তিত হবেন না, সমস্যা যেমন আছে তার উপযুক্ত সমাধানও আছে। আপনাদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়ার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়- এমনকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত রয়েছে। পোকাটির ক্ষতির মাত্রা অনুধাবন করে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার তথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় ওয়েব পোর্টালে ক্ষতিকর এ পোকা সম্পর্কিত ভিডিও চিত্রটি দেয়া আছে। প্রান্তিক কৃষকের কথা বিবেচনা করে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইতোমধ্যে কৃষি, প্রাণিসম্পদ বা মৎস্যবিষয়ক যে কোনো পরামর্শের জন্য কৃষক সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

লেখক: ভাইস-চ্যান্সেলর, হাবিপ্রবি/চেয়ারম্যান, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ/পিএইচডি ফেলো (এনএটিপি), কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<88699 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1