এখন প্রয়োজন কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

কৃষিবিদ নিতাই চন্দ্র রায়
দেশে বাণিজ্যিক কৃষির উৎকৃষ্ট উদাহরণ যশোরের গদখালীর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন - যাযাদি
স্বাধীনতার ৪৯ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫০ লাখ। তারপরও দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪.২৩ শতাংশ। মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৪০ ভাগ এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য, পুষ্টি ও শিল্পের কাঁচমালের প্রধান উৎসও কৃষি। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষিকে কেন্দ্র করেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তার ইচ্ছে ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এবং শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। সে কারণেই স্বাধীনতার পর তিনি ডাক দিয়েছিলেন সবুজ বিপস্নবের এবং কৃষিকে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। কৃষকের মঙ্গলের কথা ভেবে তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা রহিত করেছিলেন। পাকিস্তান আমলের ১০ লাখ কৃষকের নামে দায়ের করা সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার এবং সুদসহ সমুদয় কৃষিঋণ মওকুফ করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়; সম্ভব নয় তার স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তবায়ন। কৃষির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের জন্য এ পেশায় মেধাবী মানুষের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। তাই কৃষিশিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজে মেধাবী ছাত্রদের আকর্ষণ করতে তিনি কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করেন। কৃষিকাজে জনগণকে অধিকতর সম্পৃক্ত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রবর্তন করেন। তিনি কৃষি উন্নয়ন, গবেষণা ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনসহ অনেক নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এতে কৃষিবিষয়ক শিক্ষা ও প্রযুক্তি চর্চায় মেধা আকর্ষণের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে তার সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিক্ষেত্রে বেশকিছু বাস্তব ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সারের দাম কমিয়ে পুনঃনির্ধারণ করা। সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি খাতে আর্থিক সহযোগিতা উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত এসব খাতে মোট ৬৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান, যার মধ্যে সার খাতেই সহায়তা প্রদান করা হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন বাবদ ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান। কৃষকদের মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া। ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ। ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাস করার লক্ষ্যে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে দেশের হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় কৃষকের জন্য ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ হারে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সরকারি আর্থিক সহায়তা প্রদান। এ পর্যন্ত এ খাতে ২২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে কৃষিতে অর্জিত হয়েছে অভাবনীয় সফলতা। ফসলের জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত বাংলাদেশ পেরিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সফলতার সঙ্গে আবাদ হচ্ছে। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়, চাল ও মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে সপ্তম ও আম উৎপাদনে অষ্টম। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ৪ কোটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার টন দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা গেছে। বাংলাদেশের কৃষিতে যেমন সফলতা ও সম্ভাবনা আছে, তেমনি রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- এক. শস্য রোপণ, পরিচর্যা ও কর্তনকালে কৃষি শ্রমিকের অভাব; দুই. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের অনিশ্চয়তা; তিন. কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাব; চার. ত্রম্নটিপূর্ণ বাজারব্যবস্থা; পাঁচ. উত্তম কৃষি চর্চার অভাব; ছয়. কৃষিতে বিনিয়োগের অপর্যাপ্ততা এবং সাত. কৃষিপণ্য রপ্তানিতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব ইত্যাদি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকেই প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের খোরপোষের কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ করতে হবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো কৃষিপণ্যের জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সুরক্ষার জন্য কৃষিবিমা চালু করতে হবে এবং বিমার প্রিমিয়াম ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বহন করতে হবে। মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল ক্রয়ের পরিবর্তে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে উৎপাদিত ধানের কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ ভাগ ক্রয়েরব্যবস্থা করতে হবে এবং ধানের মূল্য মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষকদের প্রদান করতে হবে। এতে কৃষক উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং সরকারি খাদ্যশস্য ক্রয়ে দুর্নীতি বহুলাংশে হ্রাস পাবে। এ ছাড়া অঞ্চলভিত্তিক কৃষিপণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিদেশে রপ্তানির ব্যাপারেও গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কৃষিতে বাজেট বরাদ্দ, প্রণোদনা আরো বাড়াতে হবে এবং প্রণোদনার সুফল যাতে প্রকৃত কৃষক পান, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৫১ দশমিক ৩ ভাগ লোক নগরে বাস করে। আগামী ২০৫০ সালে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ লোক নগরে বসবাস করবে। ২০২০ সালে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৮ কোটি ৫০ লাখ লোক এবং ২০৫০ সালে দেশের শতভাগ লোক অর্থাৎ ২১ কোটি ৫০ লাখ লোক নগরে বসবাস করবে। তখন গ্রাম বলে কিছুই থাকবে না। শহরের সব সুবিধাই পৌঁছে যাবে গ্রামে। নগরই হবে মানুষের স্থায়ী ঠিকানা। তাই এখন থেকেই গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি নগরবাসীর প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস নগর ও তার আশপাশে উৎপাদনের জন্য পরিবেশবান্ধব নগরীয় কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় দেশের দূরদূরান্ত থেকে খাদ্য পরিবহন করে অথবা বিদেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী আমদানি করে নগরবাসীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। সম্ভব হবে না নগরবাসীর দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। এখন কৃষি শুধু ধান, পাট ও আখচাষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ফলমূল, শাকসবজি ও ঔষধি উদ্ভিদের মতো মূল্যবান ফসলের চাষ, কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের বীজ উৎপাদন, মাশরুমের চাষসহ কৃষি আজ বিস্তৃত হচ্ছে সম্ভাবনাময় সব সেক্টরে। যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে হাঁস, মুরগি, গবাদিপশু ও দুগ্ধ খামার। স্থাপিত হচ্ছে ফুল, ফল ও বনজবৃক্ষের চারা উৎপাদনের জন্য প্রচুর নার্সারি। কোথাও হচ্ছে কোয়েল ও টার্কি পালনের মতো ছোট ছোট বিদেশি প্রাণী পালনের খামার। স্ট্রবেরি ও ড্রাগনের মতো বিদেশি ফলেরও চাষ হচ্ছে দেশের কোনো কোনো স্থানে। আম্রপালি, বারি আম-৪, বারি আম-১১ জাতগুলো দ্রম্নত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ফলচাষিদের কাছে। মাত্র তিন বছরে ফল উৎপাদনে সক্ষম ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারকেল; সিয়াম গ্রিন কোকোনাট ও সিয়াম বস্নু কোকোনাটের চাষ দেশের দক্ষিণ অঞ্চলসহ সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেশের বহু জায়গায় অত্যন্ত লাভজনকভাবে চাষ হচ্ছে আপেলকুল, বাউকুল, থাই পেয়ারা, রেড লেডি জাতের হাইব্রিড পেঁপে। বাণিজ্যিকভিত্তিতে রেণু থেকে পোনা, ডিম থেকে হাঁস-মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করে দেশের অনেক যুবক গ্রামীণ অর্থনীতিতে রাখছে উলেস্নখযোগ্য অবদান। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার এবং ঔষধ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে গ্রামের উদ্যোগী যুবকরা। কর্মসংস্থানে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে গ্রামীণ মহিলাদেরও। তবে বেকারত্ব এখনো দেশের অন্যতম সমস্যা। এটি নিরসনে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী 'আমার গ্রাম, আমার শহর' কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং কৃষি প্রণোদনার মাধ্যম কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও মনোযোগ দিতে হবে। সারা পৃথিবীতেই কৃষি অনিরাপদ, অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অভাব, কৃষি উপকরণ এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় কৃষিকে ফেলেছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। শুধু কৃষি ও কৃষকের জন্য নয়; দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যও এই চ্যালেঞ্জ সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে সরকারি উদ্যোগ উলেস্নখ করার মতো। কৃষির এ নতুন অভিযাত্রায় যুক্ত হচ্ছে দেশের শিক্ষিত, সাহসী ও উদ্যোগী যুবসমাজ, যাদের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতার অমর পক্তিমালা- স্বাধীনতা তুমি/ ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি। লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্‌ লিমিটেড, গোপালপুর, নাটোর।