গদখালীতে ফগার ইরিগেশনে সমন্বিত ফুল ও সবজি চাষ

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আকরামুজ্জামান
পলিশেডে ফগার ইরিগেশন ব্যবহার করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একই ক্ষেতে বছরজুড়ে ফুল ও সবজিচাষ করে সাড়া ফেলেছে যশোরের গদখালীর চাষিরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই নিরাপদ বিষমুক্ত ও রপ্তানিমুখী সবজি ও ফুল উৎপাদন করে তারা বেশ সফল হয়েছেন। এখানকার চাষিদের সফলতা দেখে জেলার অন্যান্য এলাকার চাষি ফুল এবং সবজিচাষে পলিশেড ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী অঞ্চল ফুলচাষের জন্য বিখ্যাত। দেশের মোট ফুলের ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয় এই গদখালীতে। তবে ফুলচাষ করতে গিয়ে প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে চাষিদের মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে প্রচন্ড শীত, গরম ও ভারী বৃষ্টির কারণে লাখ লাখ টাকার ফুল নষ্ট হয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় তাদের। কৃষকদের এ ক্ষতির দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি সেচ) উদ্যোগে গদখালীতে পলিহাউসের মাধ্যমে ফুলচাষের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গদখালীতে সাতটি পলিহাউসে বর্তমানে একই সঙ্গে চাষ হচ্ছে ফুল ও সবজির। এতে চাষিরা অল্প খরচে বেশি লাভবান হচ্ছেন বলে জানান। চাষিরা বলছেন, যশোর সবজি, ফুল ও মাছের জেলা হিসেবে সারাদেশে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক আগে থেকেই। তবে গদখালী অঞ্চলে শুধুমাত্র ফুলচাষের জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে সবজিচাষের তেমন প্রচলন ছিল না। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষক এখন একই ক্ষেতে বছরজুড়ে ফুল, সবজিচাষ করে বাড়তি আয় করতে সক্ষম হচ্ছেন। পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, আধুনিক পলিহাউসে পানি সাশ্রয়ী ডিপ ইরিগেশন, স্প্রিংকলার ইরিগেশন, সৌরচালিত পাম্প, কাইমেট স্মার্ট টেকনোলজিসহ নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে কোনো ঝামেলা ছাড়াই প্রায় বছরজুড়ে ফুল ও সবজিচাষ করে লাভবান হচ্ছেন তারা। তিনি বলেন, গদখালী এলাকার ফুলচাষিরা প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক সমস্যায় পড়েন। বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টিপাত হলে ক্ষেতের ফুল নষ্ট হয়। আবার গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ক্ষেতেই ফুলের সর্বনাশ হয়ে যায়। একই অবস্থা শীতকালেও। কিন্তু এ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষ করে তারা মোটেও সমস্যায় পড়েন না। পলিহাউসের কারণে বৃষ্টির পানিতে ক্ষেতের ফসলের কোনো সমস্যা হয় না। অপরদিকে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ফগার ইরিগেশনের মাধ্যমে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। একই কথা বলেন, ফুলচাষি শের আলী সর্দার। তিনি বলেন, পলিহাউস সিস্টেম আমাদের অঞ্চলে ফুলচাষে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তিনি বলেন, আমি এক বিঘা জমিতে পলিহাউসের মাধ্যমে ফুল ও সবজিচাষ করছি। একই জমিতে জারবেরা, গস্নাডিউলাস, রজনী গন্ধা, গোলাপসহ ১২ প্রকার সবজিচাষ করছি। এসব ফসল চাষে আমার কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। সৌরচালিত পাম্পের মাধ্যমে এখন ফুল ও সবজিচাষ করছি। বাংলাদেশ ফাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, পলিহাউসের মাধ্যমে যে ফুলচাষ করা হচ্ছে তা শতভাগ রপ্তানি মানের ফুল। এ পদ্ধতিতে ফুলচাষ করলে ফুলের ফলন ও গঠন ভালো হচ্ছে। তিনি বলেন, গদখালী অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বাইরের বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রের ডেলিগেট আসেন। তারা আমাদের অঞ্চলের উৎপাদিত ফুলের চাহিদার কথাও জানান। তবে শর্ত বেঁধে দেন মানসম্মত ফুল উৎপাদনের জন্য। তিনি বলেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে আমাদের ইচ্ছা থাকলেও শতভাগ রপ্তানিযোগ্য ফুল উৎপাদন করতে পারি না। কিন্তু বিএডিসির এ প্রকল্প আমাদের জন্য বর্তমান সহায়ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ পদ্ধতিতে চাষ করে আমরা রপ্তানিযোগ্য ফুল ও সবজি উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছি। ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস বলেন, বৈশিক জলবায়ু মোকাবিলায় আধুনিক পলিহাউস পদ্ধতি ফুল ও সবজিচাষ সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষক এ প্রযুক্তিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি জেলার অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া যায় কি না সে বিষয়ে কৃষি বিভাগ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি সেচ) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম বলেন, উন্নত এ প্রযুক্তি দেশে সর্বপ্রথম গদখালীতে চালু করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি চালু হলেও এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক এখন পলিহাউসে ফুল ও সবজিচাষ করতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি বলেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের কৃষকদের সারা বছরই নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এসব দিক বিবেচনা করে এ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে সবজি ও ফুলচাষ করলে যশোরের কৃষি অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যে সফলতা পেয়েছি এটি এখন আরও বড় আকারে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হবে। শুধু যশোর নয়, এ অঞ্চলের অন্যান্য জেলাতেও ফুল এবং সবজিচাষে এ উন্নত প্রযুক্তি অনুসরণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।