বিদেশে যাচ্ছে ফুলঝাড়ু

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

আসমা অন্বেষা
বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম ঈদ উপলক্ষে। বাচ্চারা খাবার ফেলেছিল মেঝেতে। বান্ধবী ফুলঝাড়ু নিয়ে এলো ঘর পরিষ্কার করতে। বাংলাদেশের ফুলঝাড়ু দেখে অবাকও হলাম আবার ভালোও লাগল। জানতে পারলাম টরন্টোর বাঙালি দোকান থেকে কিনেছেন। প্রশ্ন করলাম, এখানকার ঝাড়ু কি দোষ করল? উত্তর এলো, ‘এখানকার ঝাড়ুতে আমাদের দেশের ফুলঝাড়ুর মতো পরিষ্কার হয় না ঘরবাড়ি’। বাঙালিপাড়ায় মাঝে মাঝে যেতে হয় দেশি জিনিস কেনার জন্য। এখানকার এই একটি এলাকার দোকানের সাইনবোডর্গুলোও বাংলায় লেখা থাকে। দেখে ভারি মজার লাগে এবং মনটাও খানিকটা ভালো হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায় এখানে। সবজি, ফ্রোজেন মাছ, গুড়, পিঠার ছাচ, চাল, ডাল, মশলা এমন কি ফুলঝাড়ুও। ফুলঝাড়ু গাছ সাধারণত বাংলাদেশে খাড়া পাহাড়ের ঢালে, বনজঙ্গলে জন্মে। নদীর তীরের বালুমাটিতে, আদ্র খাড়া গিরিখাতের কিনারেও ভালো জন্মে। এই গাছগুলো অপেক্ষাকৃত কম উবর্ব জমিতে এবং মারজিনাল ল্যান্ডেও হয়। বাংলাদেশে পূবার্ঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকায় এই গাছ সহজলভ্য। বাংলাদেশে ফুলঝাড়ু গাছের চাষ করার প্রয়োজন পড়ে না, পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় এই গাছ। রাইজোম থেকে নতুন গাছ জন্মায় মে অথবা জুন মাসের দিকে। কাÐসহ শাখান্বিত পুষ্পমঞ্জুরি ঝাড়ু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পুষ্পমঞ্জুরি ম্যাচিউর করলে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পযর্ন্ত শুরু হয় ফুল সংগ্রহ করা। শীতের সময়ে ফুল সবুজ রঙের থাকে। এরপর বসন্তে এই মঞ্জুরি বাদামি বণর্ ধারণ করে ধীরে ধীরে। তারপর ফুল কেটে ঝাড়ু বানানো হয়। বনের পাশে, নদীর ধারে, নিবিড় অরণ্যে এবং পাহাড়ের ঢালে এই গাছগুলোকে বেশ সুন্দর দেখা যায়। আমাদের দেশে খাগড়াছড়ির পানছড়ি, দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা ও পাশের জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও সাজেকের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফুলঝাড়ু সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশে এই ফুলঝাড়ু বিক্রি করে চলে সহস্রাধিক পরিবার। পাহাড়ে ফুলঝাড়ুর চাহিদা বাড়ছে দিনদিন, কারণ অন্যান্য ঝাড়ুর চেয়ে এটি সহজে ব্যবহার করা যায় এবং বেশি কাযর্করী। দেশের সব জায়গায় এই ফুলের ঝাড়ু বেশ ব্যবহার হয়। এই ঝাড়ুগুলো দেখতে সুন্দর, দাম কম এবং টেকে বেশিদিন। পাহাড়ি এলাকার শিশুরাও বড়দের মতো এই গাছ থেকে ঝাড়ু বানাতে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে। এসব এলাকায় সপ্তাহে গড়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার ফুলঝাড়ু বিক্রি হয়। ফুলঝাড়ু বিক্রির মাধ্যমে বন বিভাগের রাজস্ব আয় হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। পাহাড়ের চাষিরা ফুলঝাড়ু তৈরি করে বিক্রি করেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে। খাগড়াছড়ি শহরে ফুলঝাড়ু পাইকারিতে বিক্রি হয় কলেজপাড়া এলাকায়। সেখানে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন উপজেলা থেকে খুচরা দরে ফুলঝাড়ু কিনে এনে মজুদ করেন। পাইকাররা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন বাজার থেকে সাপ্তাহিক হাটের দিন ফুলঝাড়ু সংগ্রহ করেন। সেখান থেকে ফুলঝাড়ুর প্রতি আটি কেনেন ১০ থেকে ১৫ টাকায়। প্রতি আটিতে ২০ থেকে ২৫টি কাঠি থাকে। খাগড়াছড়িতে নিয়ে আসা পযর্ন্ত প্রতি আটিতে খরচ হয় ১২ থেকে ২০ টাকা পযর্ন্ত। এরপর রোদে শুকিয়ে জেলার বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয় ২২ থেকে ২৬ টাকায়। প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকার ফুলঝাড়ু বিক্রি হয়। পাহাড়ের মানুষের বাড়তি আয়ের পথ খুলে দিয়েছে ফুলঝাড়ু। বন থেকে ফুল সংগ্রহ করার জন্য কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না কারণ এটি বনাঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র পণ্য। তবে জেলার বাইরে নিতে গেলে প্রতি আটিতে ৩৫ পয়সা কর ধরা হয়। সম্প্রতি এ পেশার সঙ্গে পাহাড়ি ছাড়াও অন্যান্য বাঙালি জনগোষ্ঠীর লোকজনও জড়িয়ে পড়েছেন। দিনে দিনে পাহাড়ের ফুলঝাড়ুতে সমৃদ্ধ হচ্ছে পাহাড়ের অথর্নীতি। বিভিন্ন হাত ঘুরে পাহাড়ের ফুলঝাড়ু রফতানি হচ্ছে নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও টাঙ্গাইলের মতো বড় বড় শহরে। পাহাড়ের ফুলঝাড়ুর কদরও অনেক বেশি সমতলের জেলাগুলোতে বলে মনে করেন পাইকাররা। ফুলঝাডু (ইৎড়ড়স মৎধংং) গাছের বৈজ্ঞানিক নাম থাইসানোলিনা ল্যাটিফোলিয়া (ঞযুংধহড়ষধবহধ ষধঃরভড়ষরধ)। এটি ঘাস পরিবারের একটি উদ্ভিদ। ফুলঝাডু গাছ চড়ধপবধব (এৎধসরহবধব) গোত্রের লম্বা গাছ। উচ্চতা প্রায় ৪ মিটার পযর্ন্ত হয়ে থাকে। তৃণকাÐ মসৃণ, গোলাকার ও পেনসিলের মতো পুরু। পাতা অনেকটা বঁাশপাতার মতো। মঞ্জুরি ৩০-৪০ সেমি লম্বা। অজস্র ছোট ছোট ফুলে ঘনবদ্ধ মঞ্জুরি কাশফুলের মতো ফোলানো। থাইসানোলিনা জেনাসে থাইসানোলিনা ল্যাটিফোলিয়া একমাত্র পরিচিত উদ্ভিদ। নেপালে ফুলঝাড়ু একটি ভালো ব্যবসায়িক পণ্য। নেপালে খুব বিস্তৃত ভাবে জন্মে। ২০০০ মিটার অলটিচিউডে হয় এই গাছ। প্রধাণত মহিলারাই এই কাজটি করে থাকে সেখানে। আথির্ক উন্নয়নের পাশাপাশি এর সবুজ পাতা গৃহপালিত পশুদের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গাছের শিকড় মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং শুকনো কাঠি সবজির বাগানের সাপোটর্ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ফুলঝাড়ু গাছ জমির আদ্রতা এবং উবর্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই গাছের বেশ কিছু ওষধি গুণ আছে, যা ওই সমস্ত এলাকার বাসিন্দারা ব্যবহার করে আসছে বহুদিন ধরে। ঝাড়ু গাছ চাষ করার একটি সরাসরি ভালো দিক হচ্ছে এই গাছ মাটির ধ্বস নামা বন্ধ করে। ঝাড়ু গাছ গুচ্ছাকারে থাকতে পছন্দ করে। অনেক শিকড় মাটির নিচে প্রায় এক মিটার গভীরে একে অপরকে জড়িয়ে থাকে। ফলে পাহাড়ি এলাকায় মাটির ইরোশন ঠেকানো সম্ভব হয়।