ক্যাম্পাসের করোনাকালীন শিক্ষাজীবন

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

মো. বাবুল হোসেন
পৃথিবী আছে আগের মতোই। আছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সমাজনীতি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ। তবে অনেক নিয়ম-কানুন ও বিধি-নিষেধের মধ্যে মানুষের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। সারাবিশ্বে দেশভেদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু চললেও কমবেশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষাঙ্গন প্রায় স্থবির হয়ে আছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের পদচারণা, চঞ্চলতা, কোলাহল, গল্প, আনন্দ, উলস্নাস, কর্মব্যস্ততা এবং ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা সবকিছুই হারিয়ে গেছে। প্রথমদিকে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সারা পৃথিবীতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট থেকে দূরে থাকতে হলেও বর্তমানে অনলাইনে সীমিত আকারে ক্লাস ও পরীক্ষা চলছে। আবাসিক হল বন্ধ থাকায় ক্যাম্পাসের প্রায় সব শিক্ষার্থী এখন নিজেদের বাড়ি বা বাসায় অবস্থান করছে। ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ধাপে ধাপে ছুটি চলছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশ ভালোভাবেই অনলাইনে ক্লাস চলছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে শিক্ষার্থীদের হলে না থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সশরীরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা নিচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম অনেকদিন আগে থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে যথারীতি এখন পুরোদমে চলছে। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কর্মকান্ডই চলছে এখন আগের মতোই। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ছুটি চলছে। তবে করোনার শুরু থেকেই পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস চলে আসছে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আয়োজনে ধারাবাহিক ওয়েবিনার চলছে। ১০৬তম ওয়েবিনার সম্পন্ন করে এখনো চলমান আছে। ইতিমধ্যে করোনা বিষয়ে সচেতনতার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন সশরীরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্নাতক শেষবর্ষ ও স্নাতকোত্তর শেষবর্ষের পরীক্ষা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কার্যক্রম অনেকদিন আগে থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে যথারীতি এখন পুরোদমে চলছে। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কর্মকান্ডই চলছে এখন আগের মতোই। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১টি বিভাগে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। শুরুতে করোনার কারণে প্রায় সব শিক্ষার্থী তাদের নিজ নিজ বাড়িতে চলে গিয়েছিল। পরীক্ষার কারণে এখন অনেক শিক্ষার্থী মেসে বা বাসায় আসতে শুরু করেছে। করোনার শুরু থেকেই অনেক শিক্ষার্থী অবশ্য মেসে থেকে চাকরির জন্য পড়াশোনা করছে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি হল আছে। একটি ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল এবং ছাত্রীদের জন্য শেখ হাসিনা হল। দুটি হলে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী থাকতে পারেন। অন্য শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে শহরের আশপাশে বিভিন্ন মেস বা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। স্থানীয় শিক্ষার্থীরা অনেকেই নিজ বাড়িতে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে করোনার কারণে হলে কোনো শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন না। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক, জেলাভিত্তিক, বিভাগভিত্তিকসহ বিভিন্ন সংগঠন তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। তবে করোনার কারণে তাদের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু কর্মকান্ড সংগঠনগুলো অনলাইনে পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। যেসব সংগঠনগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে : সাংস্কৃতিক সংগঠন অনিরুদ্ধ নাট্যদল, আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠস্বর, আবৃত্তি দল, ব্যান্ড বা গানের দল ডিসটিউন, কাব্য, বিতর্ক সংগঠন পাস্ট ডিবেটিং সোসাইটি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম আলো বন্ধুসভা, স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন; ফটোগ্রাফিক বা ফিল্মবিষয়ক ক্লাব পাস্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, পাস্ট ফিল্ম সোসাইটি, বিজ্ঞান সংগঠন সাইনটেরিয়া, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টবিষয়ক সংগঠন ইয়ুথ অ্যালাইন্স আইইইই সলভার গ্রিন, ফার্মা ক্যারিয়ার ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী বা সেবামূলক সংগঠন জোনাকি, নতুন সূর্যোদয়, আগামীর সূর্য, হেল্প, বন্ধু, রোভার স্কাউট গ্রম্নপ, ইয়েলো ল্যাম্প ও ইয়েলো ল্যাম্প কয়েন। প্রতিটি বিভাগেরই নিজস্ব বিভাগীয় সমিতি রয়েছে : অর্থনীতি সমিতি, গণিত সমিতি, ফার্মেসি অ্যাসোসিয়েশন, সমাজকর্ম সমিতি, পদার্থবিজ্ঞান সমিতি, রসায়ন সমিতি, পরিসংখ্যান সমিতি, আইসিই সমিতি, লোকপ্রশাসন সমিতি। এছাড়া বিভিন্ন জেলা সমিতি : টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতি, আরশীনগর, সুন্দরবন, যশোর, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ময়নামতি, জালালাবাদ, বৃহত্তর রাজবাড়ী, জামালপুর, শেরপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, বরিশাল, বৃহত্তর, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ইত্যাদি জেলা সমিতি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'জোনাকী'র সাধারণ সম্পাদক অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয়বর্ষের ছাত্র মো. বিলাল হোসেন বলেন, ক্যাম্পাসে যতগুলো সংগঠন রয়েছে প্রায় সবই ক্যাম্পাসভিত্তিক। করোনার কারণে সব সংগঠনই কাজ আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারছে না। অনলাইনে অতীব প্রয়োজনীয় কিছু প্রোগ্রামের আয়োজন করলেও ডিভাইস ও দুর্বল ইন্টারনেটের কারণে ভালোভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। এসব সংগঠন থেকে শিক্ষার্থীরা যে সেবাগুলো প্রদান করত সেগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা এবং এ অঞ্চলের দরিদ্র জনসাধারণ। সেবামূলক সংগঠন থেকে যে সেবাগুলো গ্রহণ করতে পারত এখন তা পাচ্ছে না। ফার্মেসি বিভাগের পঞ্চমবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম আবির করোনাকালীন ক্যাম্পাসের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, করোনাভাইরাসের এ সময়ে সারা পৃথিবী যেখানে স্থবির, সেখানে আমাদের মতো হাজারো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জীবন স্থির হয়ে গেছে? নেই কোনো ক্লাস, ল্যাব, অ্যাসাইনমেন্ট বা পরীক্ষার চাপ। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেই কর্মচঞ্চলতা, ব্যস্ততা তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে সব বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়ররা মিলে যে আড্ডা, আনন্দ, র্উ‌লাসগুলোও। এগুলো খুবই পীড়াদায়ক। করোনার সময় বাড়তি হিসেবে যোগ হয়েছে মানসিক দুশ্চিন্তা, ভয়, সংশয়। শিক্ষাজীবনে সেশনজট আমাদের দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। করোনায় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দক্ষতা, উন্নয়নমূলক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠনের সরাসরি সব কার্যক্রম প্রায় বন্ধ বললেই চলে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মফিদুল ইসলাম করোনাকালীন ক্যাম্পাসের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, বিগত বছরে শীতকালীন ছুটির শেষের দুদিন বাকি থাকতেই ক্যাম্পাসের জন্য মন ছটফট করত। আর এখন এ পুরো বছরটাই ক্যাম্পাস থেকে দূরে আছি। কতটা খারাপ লাগছে বোঝানো কঠিন। ফিজিক্সের ল্যাবটা খুব মিস করছি। গ্রম্নপ করে ল্যাবে কাজ করতাম। বন্ধুগুলো এখন অনেক দূরে। শীতকালে শিউলিগাছের নিচে আমাকে একবার যেতেই হবে! ঝরেপড়া শিউলির সৌন্দর্য দেখে আমি ক্লাসের দিকে পা বাড়াতাম! ক্লাসের ফাঁকে ক্যাফেটোরিয়ায় বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে উঠত আমাদের চায়ের সময়টা! গেটের রাজনৈতিক আড্ডাগুলো আমি আর কোথায় পাবো? আমার দম বন্ধ লাগে, আমি ক্যাম্পাসে ফিরতে চাই। ক্যাম্পাসের সঙ্গে আরও কিছু প্রেম হোক, কিছু অমলিন স্মৃতি তৈরি হোক। অনলাইনে ক্লাস করা যায়, ক্যাম্পাস পাওয়া যায় না! বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এখন অনলাইনেই সময় অতিবাহিত করছেন। গ্রামে কিছু শিক্ষার্থী কৃষি কাজে যুক্ত হয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপার্জনের একটি বড় খাত টিউশনি। অনেক শিক্ষার্থী টিউশনি করে নিজে চলেন এবং গ্রামের বাড়িতে পরিবারকে টাকা পাঠান। ঢাকা শহরের মতো সারাদেশের শিক্ষার্থীদের করোনার কারণে টিউশনি না থাকায় উপার্জনও বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী করোনাকালে জীবিকার তাগিদে সবজি চাষে যুক্ত থেকে সফলতা পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র করোনার প্রথম দিকে সবজি বিক্রি করেছেন এবং ঘটনাটি ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে অনুপ্রেরণামূলক হিসেবে দেখেছেন। কিছু শিক্ষার্থী অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত আছেন এবং কেউ কেউ পার্ট টাইম জব করছেন। যারা বাড়িতে আছেন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অলসভাবেই সময় কাটাচ্ছেন। এর ফলে তাদের একাকিত্ব, দুশ্চিন্তা, সংশয়, অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বেড়ে গেছে এবং অনেক শিক্ষার্থীই বিচ্ছিন্নতা বোধ করছেন। পড়াশোনায় অমনোযোগী ও মনোবল হারিয়ে ফেলছেন। করোনাভাইরাসের কারণে মাসের পর মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সেশনজটের সম্মুখীন হচ্ছেন। ২০১৯ সালে ৩১ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথমে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ভাইরাসটি দ্বারা এখন পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ৮ কোটি ৬০ লাখ মানুষ আক্রান্ত ও ১৮ লাখ ৫০ হাজার মানুষ মৃতু্যবরণ করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে লকডাউনের পর শিথিলতা আনছে আবার কিছু দেশ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে লকডাউনেও যেতে হচ্ছে। কিন্তু তারপরও মানুষ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের দেশেও অনেক মানুষ তাদের স্বজন হারিয়েছেন। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, আবার চাকরি থাকলেও কম বেতন পাচ্ছেন, আবার কারও চাকরি আছে বেতন পাচ্ছেন না। কেউ কেউ ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার পৃথিবীর অনেক বড় বড় কোম্পানি তাদের ব্যবসা হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ করোনা মহামারির সময়ে অর্থনৈতিক সংকট খুব ভালোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। রাত যত গভীর ও অন্ধকার থাকুক না কেন, অন্ধকার কেটে গিয়ে একসময় সূর্য উঠবে এবং অন্ধকারও কেটে যাবে। প্রকৃতির ধারাবাহিক নিয়মেই পৃথিবীর সব কিছু পরিচালিত হবে। একসময় পৃথিবীব্যাপী এ দুর্যোগ কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরতে পারবে। আবার মেতে উঠবে আনন্দ, উলস্নাস আর উন্মাদনায়। লেখক :মো. বাবুল হোসেন জনসংযোগ কর্মকর্তা, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা।