বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

করোনায় কৃষি ও কৃষিবিদ

প্রকাশ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

আতিকুর রহমান ও মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর
'আমি তোদের পদমর্যাদা দিলাম, তোরা আমার মান রাখিস'- ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সবুজ চত্বরে কৃষিবিদদের এভাবেই প্রথম শ্রেণির মর্যাদার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন মঞ্চে বাকুবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (বাকসু) কর্তৃক আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় কৃষিবিদদের চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদার ঐতিহাসিক ঘোষণার পথ ধরেই আজ কৃষিবিদরা সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কৃষিশিক্ষা ও কৃষিবিদদের যথাযথ মূল্যায়ন এবং প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদানের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা আজও বাকৃবির সবুজ চত্বর তথা পুরো ক্যাম্পাসের আকাশে-বাতাসে সদা প্রতিধ্বনিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জাগানিয়া ঐতিহাসিক স্থানটি চিহ্নিত করে গড়ে তোলা হয়েছে 'বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচত্বর'। তার দেওয়া কৃষিবিদদের এ সম্মানকে স্মরণীয় করে রাখতেই ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রম্নয়ারি কৃষিবিদরা দিবসটিকে 'কৃষিবিদ দিবস' হিসেবে পালন করে আসছেন। বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিই মূলত জাতীয় উন্নয়নের ধারক। যে চারটি খুঁটির উপর বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে, কৃষি তার মধ্যে প্রধান। শুধু কৃষির উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে দেশের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ৪১ শতাংশ মানুষ। তাই তো কৃষি ও কৃষিবিদদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতে এসে এমন একটি কৃষিবিদ দিবসের সামনে আমরা, যেখানে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভয়াল বিস্ফোরণ এবং কৃষিকে কেন্দ্র করে বিপর্যয় সামাল দেওয়ার বিশাল চ্যালেঞ্জ। ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে দেশে কৃষিজমি ছিল প্রচুর কিন্তু সে অনুযায়ী উৎপাদন করা হতো না। বেশির ভাগ ফসলের চাষ হতো স্থানীয় জাত দিয়ে, যা উচ্চফলনশীল ছিল না। ফলে খাবারের জন্য মানুষের হাহাকার লেগেই থাকত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান শাসনামলেও এদেশের কৃষি ছিল অবহেলিত। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষিতে নতুন স্বপ্ন দেখান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেননা তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির সম্পূর্ণ বিকাশ ও উৎকর্ষ ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের মতো ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করেন। সেদিন থেকে কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়। এর আগে সত্তরের দশকে শুধু চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীরা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করতে পারতেন। কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদানের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে দেশের কৃষি খাত। আগ্রহ বাড়ে গবেষণায়, গুণগত মান বৃদ্ধি পায় কৃষিপণ্যের, প্রসারিত হয় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্ভাবনা। দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফল হিসেবে আমরা আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছি। অথচ প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মানুষের খাদ্যের চাহিদা। স্বাধীনতার সময় যেখানে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, বর্তমানে তা প্রায় ১৭ কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষিবিদরা দিনরাত পরিশ্রম করে নতুন নতুন জাত আবিষ্কার করছেন। উৎপাদিত নতুন জাত কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়েও দিচ্ছেন তারা। উন্নতজাতের বীজ, সুষম সারের ব্যবহার ও সেচ সুবিধার কারণে আমাদের কৃষি উৎপাদন উলেস্নখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে কৃষিতে এখন বহুমুখীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি লবণাক্ত পানি সহিষ্ণু, জলাবদ্ধতা ও খরাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের ফলে ধান চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে কৃষিকে কেন্দ্র করে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এরই মধ্যে দেশে ডেইরি ও পোল্ট্রি শিল্প বিকশিত হয়েছে। এ ছাড়া উন্নতমানের ফল ও রকমারি ফুলের চাষও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই কৃষিকে আর কৃষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কোনো অবকাশ নেই। আজ কৃষি একটা শিল্প, আধুনিক বিশ্বের বিপস্নব। পরমাণু শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মোট ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে এবং দেশের কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ঈর্ষণীয় অবদান রেখে চলছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। মাছ ও ছাগল উৎপাদনেও বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আমে সপ্তম, আলুতে অষ্টম এবং ফল উৎপাদনে দশম। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয় তার ৮৬ শতাংশই হয় আমাদের দেশে। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন একটি উদাহরণ। মৌসুমি ফলগুলো এখন সারা বছরই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষির এই অগ্রযাত্রায় হঠাৎ বাধা হয়ে আসে মহামারি কোভিড-১৯। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় কৃষকদের। এরপর লকডাউনে অচল হয়ে যায় সবকিছু, কৃষকরা হয়ে পড়ে বেকার। এরই মাঝে ঘূর্ণিঝড়, একাধিক বন্যার মতো দুর্যোগে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে কৃষি উৎপাদন। যার প্রভাব পড়েছে বর্তমান বাজারে। তবে করোনা মহামারিতে বিপুল খাদ্যসঙ্কটের যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সেরকম কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। সে জন্য আমাদের কৃষক ও কৃষিবিদরা অবশ্যই কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য, সেটি না বলার কোনো অবকাশ নেই। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ কৃষির মানোন্নয়নে যুগোপযোগী কর্মপন্থা ঠিক করার এখনি সময়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কৃষিকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বাংলাদেশ। ধারণা করা হচ্ছে, করোনা-উত্তর পৃথিবীতে কৃষিই হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। আর আধুনিক স্মার্ট ফার্মগুলো হবে তার বাহক। সেই যান্ত্রিক প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের দেশেও হওয়া প্রয়োজন। নগর কৃষি, ছাদ কৃষি, গ্রামীণ অর্থনৈতিক শিল্পনির্ভর কৃষি, খাদ্য পুষ্টি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতি গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই লক্ষ্যে সরকার ও কৃষিবিদদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে- এবারের কৃষিবিদ দিবসে এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কৃষি নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। তিনি বলেন, 'কৃষিবিদদের যোগ্য মর্যাদা প্রদানের ফলেই কৃষির মানোন্নয়ন সম্ভব হয়েছে, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। এখন আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ভবিষ্যৎ কৃষির দিক নির্ধারণেও কৃষিবিদরাই নেতৃত্ব দেবে।' আতিকুর রহমান, শিক্ষার্থী কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এবং মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।