ঢাকা কমাসর্ কলেজ রুপালি ইলিশের দেশে

প্রকাশ | ০৩ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

রায়হান শাহবুদ্দিন
শিক্ষা সফরে কমাসর্ কলেজ পরিবার
একরকম কাকডাকা ভোরেই বেরিয়ে পড়তে হলো, গন্তব্য সদরঘাট। শহরে কাক না থাকলেও কাকের বিশেষণে ভোর রয়ে গেছে। গাড়ি পুরান ঢাকার বুক চিড়ে প্রায় সদরঘাটের কাছেই। সদরঘাটে সকাল-বিকাল বলে কিছু নেই, বিশ্রি জ্যাম লেগেই থাকে, তাই বলে বিরক্তি বা খারাপ লাগছিল না, কারণ সব বিরক্তি তথা খারাপ লাগা নদী ভ্রমণের উচ্ছ¡াসে একরকম আচ্ছন্ন, পরাজিত বলা চলে। ভ্রমণে আমার সবচেয়ে প্রিয় নৌভ্রমণ; কিন্তু ঘাটে পেঁৗছে নাকে তীব্র বিশ্রি গন্ধ আসতেই মনোযোগ যখন নদীবক্ষে, তখন সব ভালো লাগা ধুয়ে মুছে গেল এবং দৈত্তাকার এই জলযানের ছুটে চলার সাথে তা ক্রমান্বয়ে ফিকে হতে হতে হতাশায় রূপ নিল। কারণ, যতই যাচ্ছি, পানির নোংরা গন্ধ ততই যেন তীব্র হচ্ছে এবং যেদিকে যত দূর তাকাচ্ছি কেবল ময়লাযুক্ত ঘোলা পানিই চোখে পড়ছিল। এই নদীতে আমার যাতায়াত দীঘর্ সময়ের। আগে তুরাগ ছেড়ে বুড়ি গঙ্গা যতই নিকটবতীর্ হতো ফেনাযুক্ত স্বচ্ছ পানি ততই চোখে পড়ত। কিন্তু এবার তার ব্যাতিক্রম হওয়ায় আমার ভ্রমণের আনন্দ ফিকে হতে থাকল। যদিও পরে ভ্রমণ বৃত্তান্ত জানতে পেরে অন্যদের উচ্ছ¡াসের ভেলায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়ার চেষ্টায় মগ্ন হলাম। কারণ, জানতে পারলাম ১৫০০ যাত্রীবোঝাই ৪ তলার সুন্দরবন নামক এই তিলত্তমা জানটির ১১৭০ জন শিক্ষাথীর্ নিয়ে ঢাকা কমাসর্ কলেজের এই নৌবিহারের অন্যতম লক্ষ্য নদী বঁাচাতে শপথ ও করণীয় নিধার্রণ করা। শুধু তাই না, দেশের রুপালি ইলিশ স্বচক্ষে অবলোকন করাসহ সদ্য ধরা ওই ফিসের ফ্রাইসহ রকমারি ডিসের স্বাদ আস্বাধন করার অভিজ্ঞতা নিতে বছরব্যাপী এই শিক্ষা সফর কমাসর্ কলেজ পরিবার নিয়মিতই করে থাকে। আগে লঞ্চভতির্ খাবার দাবার ও শিক্ষাথীের্দর নিয়ে ৩/৪ দিনের জন্য ভাসান দিত নদী ও সমুদ্রবক্ষে সাগর কন্যা কুয়াকাটা ও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের গন্তব্যে। বিগত কয়েক বছর এটি হচ্ছে না সুন্দরবনে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। গত শুক্রবার সদরঘাট নৌ টামির্নাল জেটি-২ থেকে চঁাদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় কলেজটির গভনির্ং বডির চেয়ারম্যান, সদস্য, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, শিক্ষক ও তাদের পরিবারবগর্সহ প্রায় ১৫০০ যাত্রী। সেদিন ঘাটের সুপ্রভাত হয় শত তারুণ্যের বঁাধ ভাঙ্গা উচ্ছ¡াস-উত্তেজনায়। শুধু তরুণ-কিশোর কেন বয়জ্যেষ্ঠদের মধ্যেও ছিল চাপা উত্তেজনা। সকাল ৯.৩০-এ বেলুন ও ইলিশের রেফলিকা উড়িয়ে নৌযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি গভনির্ং বডির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সফিক আহমেদ সিদ্দিক। এ সময় কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আবু সাইদ, উপাধ্যক্ষ প্রশাসন প্রফেসর মো. শফিকুল ইসলামসহ সাবেক সভাপতি, গভনির্ং বডির সদস্য ও শিক্ষকবৃন্দসহ শিক্ষাথীর্রা উপস্থিত ছিলেন। যাত্রার শুরুতে নাস্তায় তাজা ইলিশের ফ্রাই আর খিচুরি ছিল অত্যন্ত মুখরোচক, এখনও যেন মুখে লেগে আছে। নাস্তা শেষে পরিবেশন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ঠাট্টার আড্ডা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল কলেজের অভ্যন্তরের সাংস্কৃতিক দলসহ চ্যানেল আই-২০০৪-এর অন্যতম সেরা সংগীত শিল্পী নওরীন, জি বাংলা আয়োজিত মিরাক্কেলে দ্বিতীয় স্থান অজর্নকারী পাবেল, গানওয়ালা প্রতিভাবান সংগীত শিল্পী শাওনসহ অনেকেই। ছিল নৃত্য বিভাগেরও অনেক প্রতিভাবান শিল্পী। যাদের পরিবেশনা ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। কেউ কেউ লঞ্চের খোলা ছাদে নিজেরাই নদীর কলকল ঐক্যতানের সঙ্গে তাল লয়ে গলা ছেড়ে গাইছিল ও..নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তো..মারে..., ও মাঝি নাও বাইয়া যাও... ওরে ও নীল দরিয়া... আমায় দেরে দে ছাড়িয়া....ইত্যাদি গান। এসব ভাঙা ও বেসুরো কণ্ঠে সুরের মূছর্না বা বিমোহীত হওয়ার মতো কিছু না থাকলেও তৎকালীন কালজয়ী এসব সংগীত নদী বিধৌত লাল-সবুজের গাওকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মুহ‚তের্ স্মৃতির মনিকোঠায় ভেসে ওঠে দূরন্ত শৈশব, আক্রান্ত হই নষ্টালজিয়ায়। লঞ্চ চঁাদপুর পেঁৗছে ভরা দুপুরে। পূণর্ যৌবনা ক্ষেপা সূযের্র তপ্ত দুপুরও তখন ¤øান ওদের উচ্ছ¡াসে। এরপর ওখানে স্বল্প যাত্রা বিরতির মাঝখানে দশর্ন মিলল জেলেদের জালে ধরাপড়া মৎস্যরাজ রুপালি ইলিশের। পানি থেকে সামান্য উচ্চতায় উঠতেই গুটি কয়েক ঝাড়া দিয়ে রুপালি দেহটা নিথর হয়ে যায়। একই সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় নদীর মোহনা, এর শ্রোতধারা, দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের নৌপথ ও ছুটে চলা নৌযানগুলো সম্পকের্। নদীর মোহনায় যাত্রা বিরতি যেমনি কষ্টসাধ্য তেমনি ঝঁুকিপূণর্ও, তাই সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি শেষে এবার ফেরার পালা, লঞ্চ আবার ঢাকামুখী হয়। এরই মধ্যে শুরু হয় মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন। আবারও ফ্রাইসহ ইলিশের বিভিন্ন পদ, সঙ্গে খিচুরি, পোলাও, রোস্ট রেজালাসহ রকমারি আইটেম। একান্ত আালাপচারিতায় কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আবু সাইদ বলেন, আজকের দিনটি শিক্ষা সফর হলেও দিনটি শুধুই ওদের, ওরা নিজেদের মতো করে আনন্দ উচ্ছ¡লতার মধ্য দিয়ে উপভোগ করবে এবং এর মধ্য থেকেই আহরণ করবে, শিখবে। তাই আজ আমি ওদের কোনো উপদেশ নিদের্শ দিতে বারণ করেছি। উপাধ্যক্ষ প্রশাসন প্রফেসর মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা এই সফরটিকে যতটা সম্ভব ভিন্ন মাত্রায় উপভোগ করতে চাই। যে কারণে আমরা শিক্ষকসহ তাদের পরিবার ও শিক্ষাথীের্দর নিয়ে এটি ওদের সাথে একসাথে উপভোগ করি। বিশেষ করে আমি এ জাতীয় অনুষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষাথীের্দর যতটা সম্ভব কাছ থেকে পরস্পরকে জানতে ও বুঝতে, বিশেষ করে বন্ধু হতে পরামশর্ দেই। কারণ কলেজের কঠিন অনুশাসনের বেড়াজালে এটা সম্ভব হয় না। আর এভাবেই বিচিত্র সব ঘটনা আর অভিজ্ঞতায় শেষ হলো ঢাকা কমাসর্ কলেজের অন্যরকম নৌযাত্রা তথা শিক্ষা সফর-২০১৮।