বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে অবসর :শিক্ষার্থীদের ভাবনা

নতুনধারা
  ১০ জুলাই ২০২১, ০০:০০

হুসাইন আহমদ

আলেম, প্রাবন্ধিক,

শিক্ষার্থী, ইফতা, দারুস-সুন্নাহ মাদরাসা টাঙ্গাইল।

সময়ের মূল্য নিয়ে স্কুলজীবনে সবাই রচনা লিখলেও বাস্তবে কিন্তু আমরা সময়কে মূল্যায়ন খুব কমই করি। আর অবসর সময়কে তো শুয়ে-বসে, টিভি-সিনেমা, ফেসবুক-ইউটিউব, গেমস, চায়ের দোকান ও বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় হারিয়ে ফেলি। যা আমাদের জীবনের বড় একটি অংশ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এটা নিয়ে আমাদের যেমন নেই কোনো আফসোস-অনুশোচনা, তেমনি নেই কোনো পদক্ষেপ ও সচেতনতা। আর এজন্য প্রয়োজন সময়ের মূল্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ও অবসর সময়কে কাজে লাগানোর সুফল সম্পর্কে জানা। তাই লকডাউনকালে অবসর সময়ের মূল্য ও করণীয় নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সুচিন্তিত মতামত তুলে ধরেছেন মুহাম্মদ আব্দুলস্নাহ

বর্তমান এই লকডাউনকালে অবসর সময়ে কিছু শিক্ষার্থী হয়তো মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগছে। আবার হয়তো অনেকে স্বপ্নপূরণের পথে উদ্যমতা হারিয়ে থমকে উঠছে। কারণ অবসর সময়ে কাজের চেয়ে অলসতায় আর ভুল পথেই বেশি ব্যয় হয়। তবে কেউ যদি এই অবসর সময়কে কাজে লাগায়, অবসর সময়কে মূল্যায়ন করে। সে জীবনে অনেক কিছুই অর্জন করতে পারবে। কারণ যারা জীবনে বড় কিছু হয়েছে, তারা জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই অবসর সময়কে অবশ্যই কাজে লাগিয়েছে। কথা হলো, ক'জন আর তা কাজে লাগায়? চরম বাস্তবতা হলো, আমরা অবসর সময়কে অলসতায় পরিণত করি। অবসর সময়ের মূল্যায়ন করি না। এখন অবসরতা মানে অলসতা আর অলসতা মানে কর্মবিমুখতা, উদ্যমহীনতা, আলসেমি। আর এই অলসতাই নিজের ও সমাজের অবক্ষয় ডেকে আনে। মোটকথা, অলসতা একটি জাতির উন্নতির পথে হুমকিস্বরূপ। তাই আমাদের অবসর সময়ের মূল্যায়ন করতে হবে।

অতএব, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক যদি এ বিষয়ে পূর্ণ সচেতন হন, তার সন্তান এই লকডাউনকালে অবসর সময়ে ঠিকমতো পড়াশোনা করছে কিনা! অবসর সময়ের মূল্যায়ন করছে কিনা! অবসর সময়ে কোনো বাজে অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ছে কিনা! নাকি অবসর সময়ে অলসতায় গা ভাসিয়ে বিপথগামী হচ্ছে! (শিক্ষকরাও যদি শিক্ষার্থীদের মাঝেমধ্যে একটু খোঁজ-খবর নেন।) তাহলে আশা করা যায়, শিক্ষার্থীরা লকডাউনকালে এই অবসর সময়েও অলসতা নামক বিপজ্জনক পথ থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হবে এবং অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তেও সক্ষম হবে। ইনশাআলস্নাহ।

নাসরিন জাহান

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

সময়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলতে গেলে প্রথমেই শুরু করি বিখ্যাত লেখক অ্যালান লাকেইনের একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে 'সময়=জীবন। তাই সময় নষ্ট মানে জীবনের একটা অংশ নষ্ট করা। সময়কে কাজে লাগাও জীবনও অর্থপূর্ণ হবে।' সময় আমাদের জীবনের এমন একটি মূলধন বা পুঁজি, যা বিনিয়োগ করলে আমরা ইহকাল এবং পরকালে উপকৃত হবো। আর এটি হেলায়-খেলায় নষ্ট করলে উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। কেননা, সময়ের সদ্ব্যবহার করে সম্পদ অর্জন করা যায়। কিন্তু সম্পদ দিয়ে কখনো সময় অর্জন করা যায় না। পবিত্র কোরআনে আলস্নাহতায়ালা বলেন, 'সময়ের শপথ'। তিনি আরও বলেন 'নিশ্চয়ই নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা মুমিনদের জন্য আবশ্যক'। (সুরা আন-নিসা:১০৩)। তেমনিভাবে রোজা, হজ, জাকাতের সময়ও নির্ধারিত রয়েছে। এ সবকিছুই সময়ের গুরুত্ব বোঝায়।

আমরা প্রতিনিয়ত দৈনন্দিন জীবনের নানান ব্যস্ততায় ব্যতিব্যস্ত থাকি। ফলে আমাদের জীবনে যে কোনো উপলক্ষে অবসর সময় আসুক, তা আমাদের জন্য হয়ে ওঠে এক অমূল্য নিয়ামত। সেই নিয়ামতস্বরূপ অবসর সময়ে আমরা যে কাজগুলো করতে পারি। তা হলো, বিভিন্ন জ্ঞানমূলক ও ধর্মীয় বই পড়ে নিজেকে জ্ঞান অন্বেষণে নিয়োজিত রাখা। আবার নানান ধরনের হাতের কাজে নিজেকে পারদর্শী করে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে ভূমিকা রাখা। এছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করার পাশাপাশি নফল, তাহাজ্জত, ইশরাক, চাশত নামাজ ইত্যাদি আমলগুলো আদায় করা। মনে রাখা উচিত, একজন ভালো ছাত্র হওয়া কিংবা কর্মজীবনে একজন সফল মানুষ হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে ছাত্র, ছাত্রজীবনে সময়ের পড়া সময়ে, আর একজন কর্মজীবী মানুষ কর্মজীবনে সময়ের কাজ সময়ে করা ও অবসর সময়কে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো। কেননা, প্রবাদ আছে, সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। জীবন থেকে যে সময় একবার চলে যায় তা আর ফিরে আসে না। মানবজীবন সময়েরই সমষ্টি।

অতএব, আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনে যে যত বেশি সময়কে কাজে লাগাবে, সে ততবেশি সফল মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। কাজেই আমরা আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে জ্ঞানের উচ্চতর স্থানে নিজেদের অধিষ্ঠিত করি ও সময়ের সদ্ব্যবহার করে দূর্ভোগ হতেও বাঁচি। আর আমাদের জীবনের মুক্তার মতো দামি প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাই, ইনশাআলস্নাহ সফলতা আমাদের পদচুম্বন করবেই, করবে।

আব্দুল কাদের

কর্মী, ফ্রিল্যান্সার ও ডিজাইনার, চৌহালী, সিরাজগঞ্জ।

বর্তমান সময়ে অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা আছে, যারা চাকরি, ব?্যবসা ইত?্যাদি বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কিছু করার স্বপ্ন দেখে। এরকম স্বপ্ন দেখা মানুষের জন?্য অনলাইন পস্ন্যাটফর্ম সবচেয়ে উপযোগী। কারণ, অনলাইন ক?্যারিয়ার বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো- ঘরে বসে মোবাইল বা কম্পিউটার ব?্যবহার করার মাধ্যমে পার্ট টাইম বা ফুল টাইম কাজ করে উপার্জন করা। আর বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা অনলাইন পস্ন্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে নিজের কর্মসংস্থান খুঁজে নিচ্ছে আর অন্যদেরও কর্মসংস্থান দেখিয়ে দিচ্ছে। তাই অনলাইন ক?্যারিয়ারেরও অনেক গুরুত্ব আছে। তার কারণ, আপনি আমি ঘরে বসে কাজ করব, তাও আবার টাকার বিনিময়ে। এর চেয়ে সুযোগ-সুবিধা আছে!

এছাড়া অনলাইনে নিজের স্বাধীনতা অনুযায়ী কাজ করা যায়। কোথায় কখন কতক্ষণ কাজ করবেন তা ইচ্ছামতো করা যায়। কোন কাজ কীভাবে করবেন তা আপনার হাতে থাকবে। ইচ্ছা থাকলে একসঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠানেও কাজ করার সুযোগ থাকে। আবার টিম নিয়েও কাজ করা যায়। যার দৃষ্টান্ত বলা যায়, ফ্রিল্যান্সার হওয়া।

তাই আমরা লকডাউনকালে এই অবসর সময়কে অপচয় না করে অনলাইন পস্ন্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করতে পারি। নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করতে পারি। তাই তৈরি হই, অবসর সময়কে কাজে লাগাই। আগামী জীবন উজ্জ্বল করি।

হযরত আলী

শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের ব্যস্তময় জীবনে বিভিন্ন রকমেরই পরিস্থিতি আসে। সব পরিস্থিতি সবসময় আমাদের কাছে বাঞ্ছিত হয় না। কবির ভাষায় বলতে গেলে, 'নদীতে বাতাস সবসময় মাঝিমালস্নার ইচ্ছার অনুকূলে প্রবাহিত হয় না।' বিপরীত দিকেও প্রবাহিত হয়। তবুও মাঝিকে দাঁড় টেনে যেতে হয়। গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে হয়। আমাদের জীবন-নদীতেও কখনো অনুকূল বাতাস প্রবাহিত হয়, কখনো প্রতিকূল। চারপাশের পরিস্থিতি কখনো বাঞ্ছিত ও প্রীতিকর হয়, কখনো আবার অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর। তবে সচেতন মানুষের কর্তব্য হলো, সর্বাবস্থায় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্মরণ রেখে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। কারণ, এতেই কল্যাণ নিহিত। সচেতন মানুষের অবস্থা কী অপূর্ব! তার সবকিছুর বেশির ভাগই তার জন্য কল্যাণের। আর এ শুধু সচেতন মানুষেরই বৈশিষ্ট্য। যদি সে সুখ-সচ্ছলতা পায়। তাহলে শোকর করে, ফলে তা তার জন্য কল্যাণের হয়। আর যদি দুঃখ-অনটনের শিকার হয়। তাহলে সবর করে, ফলে তা-ও তার জন্য কল্যাণের হয়।

মেহেদী হাসান সিয়াম

শিক্ষার্থী, মানবিক বিভাগ, সরকারি কলেজ,

চৌহালী, সিরাজগঞ্জ।

মানবজীবন আলস্নাহর নিয়ামতে পরিপূর্ণ। সময় ও জীবন আলস্নাহর দান। সময়ের ইতিবাচক ব্যবহারই জীবনের সফলতা। সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। সময়ের যথাযথ ব্যবহার না করা বা অপব্যবহার করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে আলস্নাহর দরবারে। মহাগ্রন্থ কোরআনুল কারিমে আলস্নাহতায়ালা বলেন, 'সময়ের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়'।(সূরা- আসর) পরকালে মানুষ যে বিষয়ে সবচেয়ে অনুতপ্ত হবে তা হলো, অবসর সময়ের সদ্ব্যবহার না করা। সময়ে নেক আমল করলে বান্দার অবস্থার উন্নয়ন হবে, বদ আমল করলে তার অবনতি হবে। আমল ছাড়া সময় পার করলে তা-ও তার জন্য প্রকারান্তরে ক্ষতি হিসেবেই গণ্য হবে। কারণ, মানুষের আয়ুষ্কাল প্রবহমান সময়। তা যদি সৎকর্মে ব্যয়িত হয়, তবে নেক আমল হিসেবে গণ্য হবে; আর যদি নেক আমলবিহীন চলে যায়, তা বদ আমল হিসেবেই পরিগণিত হবে। যেহেতু নিষ্ক্রিয়তা বা অকর্মণ্যতাও একটি ক্রিয়া। আর আমরা প্রায় সময় নানান ব্যস্ততায় ব্যতিব্যস্ত থাকি। যে কোনো উপলক্ষে অবসর যখন আসে, তা আমাদের জন্য মহামূল্যবান নিয়ামত। সময় আমাদের জীবনের এমন একটি মূলধন বা পুঁজি, যা বিনিয়োগ করলে আমরা ইহকাল ও পরকালে লাভবান ও উপকৃত হব; আর এটি হেলায় নষ্ট করলে উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হব। সময় চলে গেলে তা আর কখনো ফিরে আসে না। অতঃপর, অবসরে পারিবারিক পরিমন্ডলে নিয়মিত দ্বীন-ই তালিমের আয়োজন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে পরিবারের সদস্যরা একদিকে একঘেয়েমি থেকে যেমন মুক্তি পাবেন, অন্যদিকে নানা রকম মন্দ আকর্ষণ, আসক্তি ও হতাশা থেকেও রক্ষা পাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে